তিব্বতের লুনজে বিমানঘাঁটিতে চীন ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার, নতুন প্রশাসনিক ব্লক এবং একটি নতুন অ্যাপ্রন নির্মাণ করেছে। এই ঘাঁটিটি অরুণাচল প্রদেশের ভারত ও চীন সীমান্তের ম্যাকমোহন লাইন থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

অরুণাচল প্রদেশের কৌশলগত শহর তাওয়াং থেকে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার দূরে লুনজে ঘাঁটিতে নতুন বিমান বাংকার নির্মাণের ফলে চীন এখন তাদের যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন সিস্টেমকে আরও সামনে মোতায়েন করার সুযোগ পাবে। এতে অরুণাচল প্রদেশ ও আসামে অবস্থিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) ঘাঁটি থেকে আকাশপথে যেকোনো হুমকির দ্রুত জবাব দিতে সক্ষম হবে চীন।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) সাবেক প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বি এস ধানোয়া এনডিটিভিকে বলেন, লুনজেতে ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার নির্মাণ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে কোনো ঘটনা ঘটলে তাদের কৌশলগত ফাইটার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার লুনজে ঘাঁটি থেকেই তাদের সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেবে।

ধানোয়া আরও বলেন, এ এলাকার ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলোতে সম্ভবত ইতিমধ্যেই গোলাবারুদ ও জ্বালানি মজুত করে রাখা হয়েছে।

ভারতের সাবেক এই বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালে ডোকলাম ঘটনার সময় আমার কর্মীদের বলেছিলাম, তিব্বতে পিএলএএএফের (পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ারফোর্স) সমস্যা বিমান নয়, সমস্যা হলো মোতায়েন। তখন আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তারা তিব্বতের বিমানঘাঁটিগুলোতে মজবুত বিমান বাংকার তৈরি শুরু করার অর্থ হবে তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিব্বতে তাদের মূল দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে।’

ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান এয়ার মার্শাল অনিল খোসলা বলেন, এসব বিমানঘাঁটির নির্মাণ ও আধুনিকীকরণ চীনের ভবিষ্যতের যুদ্ধ পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি ভারতের জন্য ‘গুরুতর কৌশলগত হুমকি’। বিশেষত, ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, চীনের সামরিক সক্ষমতার বিকাশ এবং অবকাঠামো তৈরির ধরন বিশ্লেষণ করলে এই ঝুঁকি স্পষ্ট।

তখন আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তারা তিব্বতের বিমানঘাঁটিগুলোতে মজবুত বিমান বাংকার তৈরি শুরু করার অর্থ হবে, তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেবিএস ধানোয়া, সাবেক প্রধান, ভারতের এয়ার চিফ মার্শাল

অনিল খোসলা বলেন, ‘লুনজেতে চীনের এই আধুনিকীকরণ আঞ্চলিক নিরাপত্তায় গভীর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ২০২০ সাল থেকে ভারত ও চীন সীমান্তে অচলাবস্থা চলছে। ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার তাদের সরঞ্জামগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখতে, কেন্দ্রীভূত আক্রমণের ঝুঁকি কমাতে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী অপারেশন চালানোর সুবিধা দেবে।’

এয়ার মার্শাল খোসলা বলেন, মজবুত বিমান বাংকারগুলো নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদী গোলাবারুদ, ভারতীয় বিমান হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে সুরক্ষা দেবে, যার ফলে ‘সংঘর্ষের শুরুতে ঘাঁটিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা অনেক বেশি কঠিন হবে।

বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, টিংরি, লুনজে ও বুরংয়ের মতো বিমানঘাঁটিগুলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) খুব কাছে, ৫০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এত কাছে থাকার কারণে পিএলএ বিমানবাহিনীর সরঞ্জামগুলো সামনের অবস্থানে দ্রুত মোতায়েন এবং সীমান্তে কোনো উত্তেজনা দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে সাড়া দিতে পারবে। এসব বিমানক্ষেত্র অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, উত্তরাখন্ড ও লাদাখে ভারতীয় অবস্থানকে নিশানায় আনতে সক্ষম হবে।

বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, টিংরি, লুনজে ও বুরংয়ের মতো বিমানঘাঁটিগুলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) খুব কাছে, ৫০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এত কাছে থাকার কারণে পিএলএ বিমানবাহিনীর সরঞ্জামগুলোকে সামনের অবস্থানে দ্রুত মোতায়েন এবং সীমান্তে কোনো উত্তেজনা দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে সাড়া দিতে পারবে।

চীন তাদের সিএইচ–৪ মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি) ব্যবহার করছে, যা ১৬ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা থেকে স্বল্পপাল্লার আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর থাকার কারণে সিএইচ–৪ ড্রোনটিকে তিব্বতের অনেক উচ্চতার অঞ্চলে হামলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভারতের দিকে সবচেয়ে সরাসরি জবাব ২০২৯ সালে আসা শুরু করবে, যখন আইএএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহরে জেনারেল অ্যাটমিক্স-নির্মিত স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন যুক্ত হবে। দুটি বাহিনীর প্রতিটি আটটি করে ড্রোন পাবে। স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন, যার ১৫টি ভ্যারিয়েন্ট ভারতীয় নৌবাহিনীও কিনছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত ড্রোনগুলো হিমালয় অঞ্চলজুড়ে ভারতের গোয়েন্দা ও নজরদারি সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানার সুবিধা দেবে। বর্তমানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম ইসরায়েলের নির্মিত হেরন এবং সার্চার ইউএভি ব্যবহার করছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান এয়ার মার্শাল এসপি ধারকর বলেন, চীনের মজবুত বিমান বাংকার নির্মাণ ভারতের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হবে।

ধারকার বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের উত্তরের সীমান্তজুড়ে নানা ঘটনাপ্রবাহ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করি। ঐতিহাসিকভাবে, আমরা এই বিষয়টি ভেবে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম, সেই অঞ্চলের ভূগোল, ভূখণ্ড এবং উচ্চতা বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সুবিধা দিত। আমরা এখন দেখছি, চীনের আধুনিক ও আরও সক্ষম প্ল্যাটফর্ম তৈরি এবং বৃহত্তর অবকাঠামো ও লম্বা রানওয়েসহ আরও বেশি বিমানক্ষেত্র তৈরির ফলে আমাদের সেই সুবিধা কিছুটা সংকুচিত হচ্ছে।’

ভূ-গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ড্যামিয়েন সাইমন বলেন, ভারতের তাওয়াং সেক্টরের বিপরীতে এই বিমান বাংকারগুলোর দ্রুত নির্মাণ ঐতিহাসিক স্পর্শকাতর অঞ্চলে চীনের বিমানশক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

সাইমন বলেন, ভারত এলএসির এই অংশে শক্তিশালী বিমান অবকাঠামো বজায় রাখলেও লুনজেতে চীনের সামরিকীকরণের মাত্রা বেইজিংয়ের সেই ব্যবধান কমিয়ে আনার পরিকল্পনাকে তুলে ধরছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান এয়ার মার্শাল এসপি ধারকর বলেন, চীনের মজবুত বিমান বাংকার নির্মাণ ভারতের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হবে।

লুনজে ঘাঁটির এই আধুনিকায়ন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন চীন হিমালয় সীমান্ত বরাবর ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আরও ছয়টি নতুন বিমানঘাঁটির আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এ বছরের এপ্রিলে এনডিটিভি স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছিল, যাতে চীনের টিংরি, লুনজে, বুরং, ইয়ুটিয়ান এবং ইয়ারকান্তের ঘাঁটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। হ্যাঙ্গার ও রানওয়ের সম্প্রসারণ ছাড়াও বিমানঘাঁটিগুলোতে নতুন অ্যাপ্রন স্পেস, ইঞ্জিন পরীক্ষার প্যাড এবং সহায়তা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

গত এপ্রিলে চীনের বিমানক্ষেত্র নির্মাণের ছবি পর্যালোচনা করার পর ভারতীয় বিমানবাহিনী এনডিটিভিকে এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘আমাদের প্রক্রিয়া চালু আছে এবং আমরা বিষয়গুলো নজরে রাখছি।’

চীনের বিদ্যমান বিমানঘাঁটিগুলোর অব্যাহত আধুনিকায়ন এবং নতুন ঘাঁটি নির্মাণ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বহু দশক ধরে হিমালয় বরাবর ভারতীয় বিমানবাহিনীর উত্তর দিকে লেহ থেকে পূর্বে চাবুয়া পর্যন্ত ১৫টি প্রধান বিমানঘাঁটির মোকাবিলায় বেইজিং এসব কিছু নির্মাণ করছে।

২০২০ সালের ১৫ ও ১৬ জুন ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে গালওয়ানে সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্কে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পরে বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারত ও চীন বিমানঘাঁটি আধুনিকায়ন করছে। দুই দেশের এসব উদ্যোগ এই অঞ্চলে একটি নতুন কৌশলগত বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ম নব হ ন র স মজব ত ব ম ন ব স ঘর ষ র অবস থ ত ক শলগত আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

ইমরানের পতন ও আসিম মুনিরের উত্থানে ভারতের জন্য যে বিপদ ডেকে আনছে

পাকিস্তান অদ্ভুত থমথমে অবস্থার মধ্যে আছে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর যেমন এক ধরনের নীরবতা থাকে, কিন্তু তার মধ্যে আবার নতুন অস্থিরতার গন্ধ থাকে, পাকিস্তানে এখন সে রকম একটি পরিস্থিতি।

পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান এখন আদিয়ালা জেলে বন্দী। ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির পুরো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে। শাহবাজ শরিফ নামমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

এ অবস্থায় একটি ব্যর্থ গণতন্ত্রের জাহাজ সামনে এগোতে চেষ্টা করছে। ভারতের জন্য (যে দেশ মাত্র কিছুদিন আগে পেহেলগামে এক মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে এবং পরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়েছে) পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দূরের ঘটনা নয়। কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ার নড়বড়ে নিরাপত্তা ভারসাম্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

ইমরান খানের পতন পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাটকীয় ঘটনা। দুর্নীতির মামলায় ইমরানের সাজা এবং তাঁর দলকে ভেঙে দেওয়ার নানা উদ্যোগ—এ সবকিছু দেশটিতে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

তবু অদ্ভুতভাবে ইমরান এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক। জেলে থাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি; বরং তিনি এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যেটিকে বহু মানুষ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করে।

যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে আপাতত ইমরানের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কারণ নির্বাচনী প্রতীক হারিয়ে ইমরানের দল পিটিআই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলীয় কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সভা-সমাবেশ বন্ধ। দলটির নেতা-কর্মীদের হয় চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠদের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

ইমরানের দল পিটিআই যতই দমন-পীড়নের শিকার হোক, শহুরে তরুণ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী; বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ার তরুণেরা এখনো পিটিআইকেই ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ শক্তি মনে করেন।

ইমরানের দলকে দমন করে রাখার পেছনে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ আসিম মুনির। দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থপতি তিনিই। ইমরানের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান কঠোর। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কঠিন। পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি—সবকিছু একাই নিয়ন্ত্রণ করেন।

পাকিস্তানে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আগে থেকেই সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে ছিল। মুনির সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকাপোক্ত করেছেন। শাহবাজ শরিফ এমন এক ম্যান্ডেটে সরকার চালাচ্ছেন যা জনগণের উচ্ছ্বাস থেকে নয়; বরং সেনাবাহিনীর কৌশলগত প্রয়োজন থেকে এসেছে। তিনি নির্বাচিত নেতার মুখোশ পরে বাস্তবে সেনাপ্রধানের নির্দেশনায় হাঁটছেন।

মুনির-শাহবাজের এই সমঝোতা কার্যকর হলেও ভেতরে-ভেতরে তা ভীষণ ভঙ্গুর। কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি ঋণে জর্জরিত, আইএমএফের কঠোর শর্তে নিঃশেষ, আর প্রবৃদ্ধি খুবই কম।

বাইরের দিকেও পাকিস্তানের সমস্যা বাড়ছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে তালেবান আশ্রয় দিচ্ছে। টিটিপির হামলাও বেড়েছে। জবাবে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে, সীমান্ত বন্ধ করেছে এবং লাখো অনথিভুক্ত আফগানকে ফেরত পাঠিয়েছে।

এদিকে ভারত কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটিও পাকিস্তানের জন্য এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।

চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) এখনো পাকিস্তান-চীন সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তবে চীন এখন অনেক বেশি সতর্ক এবং শর্তসাপেক্ষ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে মূলত সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা এবং কৌশলগত কারণ থেকে। ওয়াশিংটনে শাহবাজ ও মুনিরের যৌথ উপস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হলেও পুরোপুরি লেনদেননির্ভর। এই পুরো ছবিতে সৌদি আরবও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ত্রাতা হিসেবে কাজ করেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর, অবকাঠামো, মসজিদ, মাদ্রাসা—বহু জায়গায় সৌদির অবদান আছে। এখনো তারা পাকিস্তানকে বিলম্বিত তেল মূল্য পরিশোধ সুবিধা দেয় আর রাজনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তানকে রক্ষা করে।

মুনির ও শাহবাজের জন্য সৌদির সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। এটা না থাকলে আইএমএফের সঙ্গে শর্ত আরও কঠিন হতো। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমে যেত। কিন্তু একই সময়ে সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে, পাকিস্তান আর আগের মতো সহজে সৌদির বন্ধুত্বের ওপর ভরসা করতে পারে না।

এই বিস্তৃত কূটনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। ভারতের কাছে পেহেলগাম হামলাটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সীমা অতিক্রমের ঘটনা। এরপর পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীর ওপর ভারতীয় হামলা, পাকিস্তানের পাল্টা আঘাত এবং তারপর যুদ্ধবিরতি—সব মিলিয়ে এক কঠিন ‘নতুন স্বাভাবিক’ তৈরি হয়েছে। এখন এই অঞ্চলে সীমিত সামরিক সংঘর্ষ, ড্রোন যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্রভিত্তিক প্রতিরোধ—সবকিছুই পারমাণবিক হুমকির ছায়ার সঙ্গে পাশাপাশি চলছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে স্থিতিশীল রাখতে বহু বছর ধরে যে দুইটি বড় কূটনৈতিক চুক্তি কাজ করত তার একটি হলো সিন্ধু পানিচুক্তি, আরেকটি হলো শিমলা চুক্তি। তবে দুটো চুক্তিই এখন কার্যত অচল বা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। ফলে আগের মতো কোনো নিয়ম বা কাঠামো নেই যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

এখন অঞ্চলটি এমন এক কৌশলগত মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, যা গত দুই দশকে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পিত নয়; বরং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-নির্ভর হয়ে পড়েছে। ভারতের জন্য এর মানে হলো, পাকিস্তান এখন শুধু একটি দুর্বল দেশ নয়, বরং এটি একটি অনিশ্চয়তার দেশ।

আর দক্ষিণ এশিয়ায় সরাসরি শত্রুতা যতটা বিপজ্জনক, অনিশ্চয়তা অনেক সময় তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। ভারতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো পাকিস্তানের নানা কথা, প্রচারণা বা হুমকির ভিড় থেকে কোনটি আসল বার্তা—তা ঠিকভাবে বোঝা।

ইসলামাবাদে যেসব রাজনৈতিক নাটক চলে, তার আড়ালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে যে গভীর পরিবর্তন হচ্ছে, সেটাও আলাদা করে চিনতে হবে। ভারত যদি পাকিস্তানের বিশৃঙ্খলাকে নিজের জন্য সুবিধা মনে করে, সেটা ভুল হবে।

কারণ এমন একটি অনিরাপদ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা প্রতিবেশী দেশ যেকোনো সময় হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারে যা তার বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। সেই সিদ্ধান্তের ফল ভারতকে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।

ভারতের কাজ পাকিস্তানকে ঠিক করা নয়, বরং নিশ্চিত করা যে, পাকিস্তানের অস্থিরতা যেন ভারতের সীমান্তে সমস্যা না তৈরি করে এবং ভারতের বড় কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলোকে যেন ব্যাহত না করে।

দিল্লিকে এখন নিশ্চিত করতে হবে, ভারত এখন ইন্দো-প্যাসিফিক, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং আফগানিস্তানে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা যেন সেই বড় কাজগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।

দিল্লিকে মাথায় রাখতে হবে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোনো বড় চুক্তি বা নাটকীয় কূটনৈতিক সাফল্যে বদলে যাবে না। তাই দুই দেশের মধ্যে যে ঝুঁকি আছে, ভারত কত শান্তভাবে এবং বুদ্ধি দিয়ে তা সামলাতে পারে—তা দিয়েই ভারতকে সম্পর্কের প্রকৃতি ঠিক হবে।

নাজিব জং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইমরানের পতন ও আসিম মুনিরের উত্থানে ভারতের জন্য যে বিপদ ডেকে আনছে