Prothomalo:
2025-12-13@08:14:37 GMT

‘চায়না দুয়ারি’ নিষিদ্ধ করুন

Published: 28th, October 2025 GMT

নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়গুলোতে দেশের ঐতিহ্যবাহী মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিধিমালা আছে। তা সত্ত্বেও বরেন্দ্র অঞ্চলে আজকের বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। সেখানে ‘চায়না দুয়ারি’ নামে পরিচিত ছোট ফাঁসযুক্ত একধরনের জালের অবাধ ও নিয়মবিরোধী ব্যবহার নদ-নদী ও খাল-বিলের বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এ সংকটকে আরও জটিল ও সুদূরপ্রসারী করে তুলেছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলেদের পর্যবেক্ষণভিত্তিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই জাল দিয়ে মাছের পোনাসহ সব প্রজাতির দেশীয় মাছ নির্বিচার নিধন হচ্ছে। এটি একধরনের ‘নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ’। এটি শুধু খাদ্যনিরাপত্তা বিপন্ন করছে না, এটি বরং জলজ উদ্ভিদ, পাখি, ব্যাঙ, কচ্ছপসহ সম্পূর্ণ জলজ বাস্তুসংস্থানকে ভয়ংকর হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিধি অনুযায়ী, সাড়ে চার সেন্টিমিটারের কম আয়তনের ফাঁসের জাল নিষিদ্ধ হলেও মাঠপর্যায়ে এই বিধির কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই। এই ব্যবস্থাপনার অভাবই ‘চায়না দুয়ারি’ জালের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।

পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর এই জালের ক্ষতিকর প্রভাব গভীর। ক্ষুদ্র ফাঁসের কারণে পোনা মাছ নিধন হয়। এতে মাছের প্রজনন হ্রাস পায়। দীর্ঘ মেয়াদে নদ-নদীর মাছের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বিলুপ্তির পথে চলে। পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী, যেমন ব্যাঙ, কচ্ছপ এবং জলজ পাখির প্রজনন চক্র বিঘ্নিত হয়।

এটি শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি করছে না, বরং স্থানীয় জেলেদের জীবিকা ও খাদ্য সুরক্ষার ওপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে।

সম্প্রতি রাজশাহীতে ভুক্তভোগী জেলেরা এ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছেন। তাঁরা চায়না দুয়ারি জালের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করা, জাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, জলজ বাস্তুসংস্থান রক্ষায় সমন্বিত নীতি গ্রহণসহ কিছু দাবি তুলেছেন।

তাঁদের দাবিগুলো সংগতিপূর্ণ ও অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ, সমস্যার সমাধান একমাত্র কার্যকর সমাধান নীতিনির্ধারণ ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে নিহিত। সে কারণে প্রাথমিকভাবে চায়না দুয়ারি জালের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কারখানা ও উৎপাদন কেন্দ্রও বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে আইন প্রয়োগ িনশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, জলজ বাস্তুসংস্থান রক্ষা শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, এটি জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও স্থানীয় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চায়না দুয়ারির অবাধ ব্যবহার বন্ধ করা হলে বরেন্দ্র অঞ্চলের নদ-নদী পুনরায় প্রাণবন্ত হবে, দেশীয় মাছের প্রজনন স্বাভাবিক হবে ও স্থানীয় জেলেদের জীবনমান উন্নত হবে। ফলে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ সুস্পষ্ট: প্রশাসনিক কার্যকারিতা, আইন প্রয়োগ ও নাগরিক অংশগ্রহণের সমন্বয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র নদ নদ

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থই থই করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জলের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সেদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদ—বাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে।

আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?

হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতা

বেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে।

আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের—পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।

কেন এই বিষণ্নতা

মাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই; বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।

কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

এখন মূল প্রশ্ন এখানেই—মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো চরম বিপর্যয় ঘটবে।

খাদ্যশৃঙ্খলে ধস: স্বাদুপানির মাছ কেবল মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়ে। ইতিমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পানির গুণ রক্ষা: অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন আবর্জনাভুক মাছ) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ডেড জোনে পরিণত করতে পারে।

সুতরাং মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়; বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকট

গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ–এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া যারা বংশপরম্পরায় জেলে পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তাঁরা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

হতাশার মধ্যে ও আশার আলো হলো প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ—

মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি: হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

দূষণ রোধ: শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ইটিপি ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ: কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জলাশয় পুনরুদ্ধার: ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

স্বাদু পানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে; আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে—একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিঁকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে