Samakal:
2025-09-18@08:25:12 GMT

আইনজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

Published: 19th, January 2025 GMT

আইনজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যৌক্তিক বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে রাষ্ট্রের নাম ও মূলনীতি পরিবর্তন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা, প্রার্থীর বয়সসীমা ও তরুণ-তরুণীদের জন্য ১০ ভাগ প্রার্থিতা সংরক্ষণসহ বেশ কিছু বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সার্বভৌম। অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি নির্বাচিত পরবর্তী সরকারের এখতিয়ার। সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও আলোচনা প্রয়োজন। জনমতকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হলে সংস্কারের বিষয়টি আরও জটিল হতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও এর কার্যকারিতা নিয়ে সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আইন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড.

শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদের মেয়াদ চার বছর করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন খসড়া প্রস্তাবনা দিয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু বিষয়ে খসড়ার সঙ্গে তারা একমত হবেন। আর কিছু বিষয়ে হয়তো ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের মাধ্যমে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। সময় আছে, আমরা নিশ্চিয় কিছু ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব এবং পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ এগুলো কার্যকরে উদ্যোগী হবে।

সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে শাহ্দীন মালিক বলেন, পৃথিবীতে দেশের সাংবিধানিক নাম বদলানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। মূলনীতির ক্ষেত্রেও তাই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ছিল না। সেখানে এটি যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু কোনো মূলনীতি বাতিল করা হয়নি। তবে মূলনীতির কার্যকারিতা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। এখন যদি আমাদের মূলনীতি পরিবর্তন হয়, তা আপত্তিতেও টিকবে না। পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে, অন্য সরকার সেটি পুনর্বহাল বা ভিন্নভাবে পরিবর্তন করবে। তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যেটা বারবার বদলানোর পরিস্থিতি হয়। অর্থাৎ, মীমাংসিত বিষয়গুলো যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে অনেক কিছুই অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। এটা রাষ্ট্র বা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যসহ সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এতে কিছু ভালো সুপারিশ রয়েছে। বিএনপিও রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা সুপারিশ করেছে। দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না, এমন সুপারিশ আছে। এটি কমিশনের সুপারিশেও আছে। তাই কমিশনের সুপারিশ এবং বিএনপির সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই নির্বাচিত সংসদ লাগবে। তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে জনগণ কী চায়, সেটা বুঝতে হবে। আর এটি বুঝতে হলে দ্রুত নির্বাচন করা দরকার। কারণ, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন রাজনীতিবিদরা।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি সমকালকে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন যারা করছেন, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের এটি করার কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধান সংশোধন কখনও অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা যায় না। তাই সংবিধানসহ অন্যান্য সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তা কার্যকর করতে হলে অবশ্যই সংসদ কার্যকর থাকতে হবে। সেখানেও এই সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কিছু বিষয় আছে যেগুলো জনগণ চায়, অর্থাৎ জনপ্রিয় ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী দু’বারের বেশি থাকতে পারবেন না। নির্বাচন হতে হবে দল নিরপেক্ষভাবে, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা। এই প্রস্তাবনাগুলোর জন্য কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে কমিশনের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ও সুপারিশ অত্যন্ত নিন্দনীয়।

তাঁর মতে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলোর মূল ভিত্তি। এটা বাদ দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপরিষদ রচিত সংবিধানের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটি কখনও পরিবর্তনযোগ্য নয়। উপরন্তু মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিটকে অস্বীকার করার শামিল, যা কখনও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের জনগণও এটি হতে দেবে না।

অন্যদিকে, এমনভাবে মূলনীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির চিন্তাচেতনা সঠিক ছিল না। এসব সুপারিশের মাধ্যমে কমিশনের সংশ্লিষ্টরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংবিধানসহ যাবতীয় বিষয়কে বিতর্কিত করার হীন চেষ্টা চালিয়েছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংসদ গঠন থেকে শুরু করে কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণ এবং সার্বিক ব্যবস্থা এর জন্য উপযোগী কিনা, তা বিবেচনা করা হয়নি। 

উচ্চ আদালতে সংবিধান-সংক্রান্ত একাধিক মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে আরও বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ দিতেই নির্বাচনের প্রার্থিতা ১০ ভাগ তরুণ-তরুণীর জন্য সংরক্ষণসহ প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ২১ বছর করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, তারা কি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে যাবে। কারণ, ২১ বছর বয়সে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি বা স্নাতক পর্যায়ে প্রথম বর্ষে থাকার কথা। এসব হাস্যকর প্রস্তাবনা কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করেছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং এর মাধ্যমে প্রণীত প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ কিছু বিষয় অপরিবর্তনযোগ্য। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এগুলো অর্জিত। এসব বাতিল বা সংশোধন করার অনুমোদন এই সরকারকে কেউ দেয়নি। কমিশনের সুপারিশে ভালোমন্দ যাই থাকুক, তা কার্যকর বা সংস্কারের বিষয় নির্বাচিত সরকারের। এই সরকারের মূল কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। জনগণের এটাই এখন প্রধান আকাঙ্ক্ষা। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের অর্থ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে আরও কালক্ষেপণ করা। যা কিছু সংস্কার প্রয়োজন তা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সংবিধান অনুযায়ী করবে। এর ব্যত্যয় আইনানুগ কিছুতেই হবে না। কমিশনের কর্মকাণ্ডে বরং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কমিশনের সুপারিশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ কিছু বিষয় আছে অত্যন্ত যৌক্তিক। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়াটা একেবারেই অযৌক্তিক। এটি মুক্তিযুদ্ধেরও একটা প্রেক্ষাপট।’ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সংশোধনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইনজ ব র ষ ট রপত র জন ত ক সরক র র ক র যকর পরবর ত আইনজ ব র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে

ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।

স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।

আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।

২.

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।

তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।

এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।

১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।

এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।

৩.

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.

আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।

‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.

তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?

লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।

আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।

 এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।

আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫

আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।

পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।

কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি: জামায়াত
  • ‘ভোটারদের আস্থা নিশ্চিত করা বিএনপির দায়িত্ব’
  • পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি