Samakal:
2025-12-13@13:14:58 GMT

আইনজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

Published: 19th, January 2025 GMT

আইনজ্ঞদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যৌক্তিক বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে রাষ্ট্রের নাম ও মূলনীতি পরিবর্তন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা, প্রার্থীর বয়সসীমা ও তরুণ-তরুণীদের জন্য ১০ ভাগ প্রার্থিতা সংরক্ষণসহ বেশ কিছু বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সার্বভৌম। অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি নির্বাচিত পরবর্তী সরকারের এখতিয়ার। সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও আলোচনা প্রয়োজন। জনমতকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হলে সংস্কারের বিষয়টি আরও জটিল হতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও এর কার্যকারিতা নিয়ে সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আইন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড.

শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদের মেয়াদ চার বছর করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন খসড়া প্রস্তাবনা দিয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু বিষয়ে খসড়ার সঙ্গে তারা একমত হবেন। আর কিছু বিষয়ে হয়তো ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের মাধ্যমে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। সময় আছে, আমরা নিশ্চিয় কিছু ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব এবং পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ এগুলো কার্যকরে উদ্যোগী হবে।

সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে শাহ্দীন মালিক বলেন, পৃথিবীতে দেশের সাংবিধানিক নাম বদলানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। মূলনীতির ক্ষেত্রেও তাই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ছিল না। সেখানে এটি যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু কোনো মূলনীতি বাতিল করা হয়নি। তবে মূলনীতির কার্যকারিতা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। এখন যদি আমাদের মূলনীতি পরিবর্তন হয়, তা আপত্তিতেও টিকবে না। পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে, অন্য সরকার সেটি পুনর্বহাল বা ভিন্নভাবে পরিবর্তন করবে। তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যেটা বারবার বদলানোর পরিস্থিতি হয়। অর্থাৎ, মীমাংসিত বিষয়গুলো যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে অনেক কিছুই অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। এটা রাষ্ট্র বা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যসহ সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এতে কিছু ভালো সুপারিশ রয়েছে। বিএনপিও রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা সুপারিশ করেছে। দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না, এমন সুপারিশ আছে। এটি কমিশনের সুপারিশেও আছে। তাই কমিশনের সুপারিশ এবং বিএনপির সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই নির্বাচিত সংসদ লাগবে। তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে জনগণ কী চায়, সেটা বুঝতে হবে। আর এটি বুঝতে হলে দ্রুত নির্বাচন করা দরকার। কারণ, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন রাজনীতিবিদরা।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি সমকালকে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন যারা করছেন, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের এটি করার কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধান সংশোধন কখনও অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা যায় না। তাই সংবিধানসহ অন্যান্য সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তা কার্যকর করতে হলে অবশ্যই সংসদ কার্যকর থাকতে হবে। সেখানেও এই সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কিছু বিষয় আছে যেগুলো জনগণ চায়, অর্থাৎ জনপ্রিয় ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী দু’বারের বেশি থাকতে পারবেন না। নির্বাচন হতে হবে দল নিরপেক্ষভাবে, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা। এই প্রস্তাবনাগুলোর জন্য কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে কমিশনের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ও সুপারিশ অত্যন্ত নিন্দনীয়।

তাঁর মতে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলোর মূল ভিত্তি। এটা বাদ দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপরিষদ রচিত সংবিধানের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটি কখনও পরিবর্তনযোগ্য নয়। উপরন্তু মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিটকে অস্বীকার করার শামিল, যা কখনও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের জনগণও এটি হতে দেবে না।

অন্যদিকে, এমনভাবে মূলনীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির চিন্তাচেতনা সঠিক ছিল না। এসব সুপারিশের মাধ্যমে কমিশনের সংশ্লিষ্টরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংবিধানসহ যাবতীয় বিষয়কে বিতর্কিত করার হীন চেষ্টা চালিয়েছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংসদ গঠন থেকে শুরু করে কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণ এবং সার্বিক ব্যবস্থা এর জন্য উপযোগী কিনা, তা বিবেচনা করা হয়নি। 

উচ্চ আদালতে সংবিধান-সংক্রান্ত একাধিক মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে আরও বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ দিতেই নির্বাচনের প্রার্থিতা ১০ ভাগ তরুণ-তরুণীর জন্য সংরক্ষণসহ প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ২১ বছর করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, তারা কি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে যাবে। কারণ, ২১ বছর বয়সে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি বা স্নাতক পর্যায়ে প্রথম বর্ষে থাকার কথা। এসব হাস্যকর প্রস্তাবনা কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করেছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং এর মাধ্যমে প্রণীত প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ কিছু বিষয় অপরিবর্তনযোগ্য। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এগুলো অর্জিত। এসব বাতিল বা সংশোধন করার অনুমোদন এই সরকারকে কেউ দেয়নি। কমিশনের সুপারিশে ভালোমন্দ যাই থাকুক, তা কার্যকর বা সংস্কারের বিষয় নির্বাচিত সরকারের। এই সরকারের মূল কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। জনগণের এটাই এখন প্রধান আকাঙ্ক্ষা। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের অর্থ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে আরও কালক্ষেপণ করা। যা কিছু সংস্কার প্রয়োজন তা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সংবিধান অনুযায়ী করবে। এর ব্যত্যয় আইনানুগ কিছুতেই হবে না। কমিশনের কর্মকাণ্ডে বরং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কমিশনের সুপারিশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ কিছু বিষয় আছে অত্যন্ত যৌক্তিক। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়াটা একেবারেই অযৌক্তিক। এটি মুক্তিযুদ্ধেরও একটা প্রেক্ষাপট।’ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সংশোধনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইনজ ব র ষ ট রপত র জন ত ক সরক র র ক র যকর পরবর ত আইনজ ব র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ভোটের মাঠে জোটের ভিড়ে জনপ্রত্যাশা কোথায় গেল 

বাংলাদেশে ভোটের মৌসুম শুরু হলেই জোট গঠনের মৌসুমও শুরু হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নতুন দল এবং নবগঠিত শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো সাধারণত জোটে মিলিত হয়ে রাজনৈতিক হিসাব কষে নতুন সমীকরণ তৈরি করে। তবে এবার বাস্তবতা ছিল অনেকটাই ভিন্ন।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশ যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গেছে, তা রাজনৈতিক মহলে প্রধান আলাপের বিষয় হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু দেখা যাচ্ছে একেবারে উল্টো চিত্র। নতুন বা পুরোনো কোনো দলই তাদের জোট গঠনের এজেন্ডায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বা জীবনযাত্রার সংকটকে অগ্রাধিকার দেয়নি; বরং আদর্শিক পরিচয়, সাংগঠনিক বিস্তার কিংবা পদ্ধতিগত সংস্কারের মতো তাত্ত্বিক বিষয়ের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

জুলাইয়ের পর যে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং যে স্বচ্ছ অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা জোট গঠন নিয়ে দলগুলোর আলোচনায় প্রতিফলিত হয়নি। মানুষ আশা করেছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু রাষ্ট্র পুনর্গঠন নয়, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করবে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ভোটের প্রস্তুতি ও জোট গঠনের ব্যস্ততায় জনগণের এই প্রত্যাশা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট, কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়, মুদ্রাস্ফীতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়া, বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা সব মিলিয়ে দেশের সামনে যে বাস্তব সংকট দাঁড়িয়ে আছে, তা কোনো জোটের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। যেসব আদর্শিক অঙ্গীকার বা আসন সমঝোতা এসব জোটের চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে, তা কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে, বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়।

ভোটের আগে জোটের মৌসুম

এখন পর্যন্ত চারটি নতুন জোট গঠনের খবর পাওয়া গেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি ধর্মভিত্তিক দল ওয়ান বক্স নীতিতে আসন সমঝোতার জোট করেছে। বাম প্রগতিশীল ৯টি দল মিলে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছে। জাতীয় পার্টির একটি অংশসহ ১৮টি দল মিলে গড়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। এর পাশাপাশি এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি মিলে গঠন করেছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট। এই সর্বশেষ জোট ঘিরে ছিল সবচেয়ে বেশি মানুষের মনোযোগ। বিশেষ করে এনসিপি কোন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবে, তা নিয়ে এক মাস ধরে বহু জল্পনা ছিল। বিভিন্ন সূত্রে সংবাদমাধ্যমে এসেছে যে এনসিপি বেশ কয়েকবার বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করে আসন সমঝোতার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাড়া পায়নি।

গণ–অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থাকা কয়েকজন ছাত্রনেতার নেতৃত্বে গঠিত হওয়ায় এনসিপির প্রতি সাধারণ মানুষের একসময় বেশ উৎসাহ ছিল। দলটির নেতারাও বলেছিলেন, তাঁরা এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন; কিন্তু সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

সম্প্রতি প্রথম আলোর উদ্যোগে করা বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কিমেকারস কনসাল্টিং লিমিটেডের এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষই মনে করেন, এনসিপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। যাদের সঙ্গে তারা জোট করেছে, সেই দুটি সংগঠন এখনো জনসমর্থনের দিক থেকে কোনো শক্ত অবস্থান অর্জন করতে পারেনি।

প্রচলিত দলগুলো থেকে ভিন্ন এক রাজনৈতিক ধারা তৈরির সুযোগ এনসিপির সামনে ছিল। ছাত্রনেতৃত্ব, বহুত্ববাদ এবং নতুন মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ধারণার কারণে তারা সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। কিন্তু বহুত্ববাদী অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করা মুখগুলো দল ছাড়ায় এবং বিভিন্ন ইস্যুতে ডানপন্থী শক্তির বিপরীতে স্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, যেই ‘সংস্কার’ এনসিপি ও তাদের জোটের মূল এজেন্ডা, ‘গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপ ২০২৫’-এ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২২ শতাংশ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম আরও সফল না হওয়ার জন্য এনসিপিই দায়ী।

নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্য জনগণের আস্থা অর্জনের অন্যতম উপায় হলো মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধানমুখী নীতি প্রস্তাব করা। অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে মানুষের প্রধান আশা থাকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের দাম কমানো, কৃষি ও বাজারব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।সাবেক জামায়াত ভালো, সাবেক শিবির খারাপ

এনসিপির সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে কয়েকটা দল ও সংগঠনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এনসিপির সম্ভাব্য জোট সঙ্গীদের মধ্যে ছিল এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ ও আপ বাংলাদেশ। এসব সংগঠনের সঙ্গে এনসিপির সম্পর্ক দলটি গঠনের আগেই ছিল। এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ আগে এসব সংগঠনের কর্মী ছিলেন। আপ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মটির নেতাদের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছিলেন এনসিপির বর্তমান নেতারা। কথিত আছে, এনসিপি গঠনের সময় শীর্ষ পদ নিয়ে দর-কষাকষির দ্বন্দ্বে পিছিয়ে পড়ে আলাদা প্ল্যাটফর্ম গড়েছিলেন শিবিরের সাবেক নেতারা।

জোট গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই গণ অধিকার পরিষদ সরে দাঁড়িয়েছে জোটের ‘পন্থা ও পদ্ধতি’ নিয়ে ভিন্ন অবস্থানের ফলে। এদিকে আপ বাংলাদেশের সঙ্গে জোট করা নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে যথেষ্ট তোপের মুখে পড়েছিল এনসিপি। প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে উঠে এসেছিল আপ বাংলাদেশের মতাদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবস্থান।

এসব সমালোচনার মধ্যেই ঘোষণা এল, শেষ মুহূর্তে আপ বাংলাদেশকে জোটে নেয়নি এনসিপি। কিন্তু যেই সমালোচনা আপ বাংলাদেশকে নিয়ে আছে, সেই একই আলাপ তো এবি পার্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দলটি তো গঠিতই হয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামী থেকে বের হওয়া নেতাদের দ্বারা। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা জুলাই অভ্যুত্থানের পর নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে বোঝা যায়নি, কোন নৈতিকতার ভিত্তিতে জোট থেকে সাবেক শিবির নেতাদের বাদ দেওয়া হলো; কিন্তু সাবেক জামায়াত নেতাদের গ্রহণ করা হলো।

যেমন জোট দরকার

নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্য জনগণের আস্থা অর্জনের অন্যতম উপায় হলো মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধানমুখী নীতি প্রস্তাব করা। অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে মানুষের প্রধান আশা থাকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের দাম কমানো, কৃষি ও বাজারব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এসব বিষয়ে স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা ছাড়া জোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দেশের তৃণমূলে থাকা সংগঠনের ওপর নির্বাচনী রাজনীতি নির্ভর করে। গ্রাম, শহর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে সংগঠন ছাড়া ভোটারদের সমর্থন পাওয়া যায় না। পুরোনো দলগুলোর সংগঠন এখনো অত্যন্ত শক্তিশালী। নতুন জোট যদি তাদের বিকল্প শক্তি হতে চায়, তবে তাদের প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং জনগণের আস্থাভাজন বাস্তব কর্মসূচি। মানুষের জীবনের সঙ্গে সংযোগহীন তাত্ত্বিক রাজনীতি স্থায়ী সমর্থন তৈরি করতে পারে না।

ভোটাররা নিশ্চয়ই নতুন রাজনীতি চান, তবে সেই নতুনত্ব শুধু অবস্থানগত ভিন্নতা বা আদর্শিক বাগ্‌যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তা জনমনে আশা জাগায় না। গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটসহ অন্যান্য নতুন জোট যদি সংকট-সমাধানমুখী এজেন্ডা জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারে, তাহলে তারা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে একটি কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তারা যদি শুধু আনুষ্ঠানিকতা এবং রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণে ব্যস্ত থাকে এবং মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গী না হয়, তাহলে তাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ব্যালটে রূপ নেবে না।

সৈকত আমীন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানে নোবেলজয়ী মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি গ্রেপ্তার
  • ভোটের মাঠে জোটের ভিড়ে জনপ্রত্যাশা কোথায় গেল 
  • বিপিএলে ফিক্সিং: অভিযুক্তদের বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে
  • আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর–৪ আসনে অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ
  • বিয়ে-তালাকের তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক: হাইকোর্ট
  • মানিকগঞ্জ শহরে ককটেল বিস্ফোরণ
  • রিট খারিজ, জোটে গেলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান বহাল
  • মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যা: গৃহকর্মী ৬ দিন, তাঁর স্বামী ৩ দিনের রিমান্ডে
  • গাজীপুর কারাগারে ‘আয়নাবাজির’ ঘটনায় আদালতে মামলা, আইনজীবীকে শোকজ
  • পঞ্চদশ সংশোধনী পুরো বাতিল পঞ্চদশ সংশোধনী পুরো বাতিল হলে বাকশাল ফিরে আসবে: আপিল শুনানিতে শিশির মনির