দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা
Published: 31st, January 2025 GMT
কয়েক দিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে চীন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিশানায়েকে চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে ১৫টি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। তাঁর সঙ্গে আছে ভারত-চীন পররাষ্ট্র সচিব-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা, পাকিস্তানে সিন্ধু পুলিশের বিরুদ্ধে ছয় চীনা নাগরিকের হয়রানি মামলা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে চীনা সহায়তার উদ্যোগ ইত্যাদি। তাই সংবাদমাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা এবং ভারতের কৌশলগত লাভ-ক্ষতির বিষয় আলোচিত।
চীন সফরকালে দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় একটি তেল শোধনাগারের জন্য সিনোপেক (একটি পেট্রোলিয়াম পরিশোধন করপোরেশন) থেকে ৩.
চীন থেকে ফিরে ২০ জানুয়ারি কাতুকুরুন্ডায় এক জনসভায় দিশানায়েকে বলেছেন, ‘আমাদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত।’ তিনি উত্তর-পূর্ব উপকূলের বন্দরনগরী ত্রিনকোমালিতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার যৌথ পরিচালনায় ৬১টি তেল ট্যাঙ্কের সঙ্গে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ বিষয়ে ভারতীয় কোম্পানি ও সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মধ্যে আলোচনার ফলাফলও তুলে ধরেন।
মজার বিষয় হলো, ভারত-শ্রীলঙ্কা সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে আদানি গ্রিন এনার্জি শ্রীলঙ্কা লিমিটেডকে অনুমোদন দেওয়া মান্নার ও পুনেরিনে বায়ুশক্তি প্রকল্পটি এখন শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভোক্তাদের জ্বালানি প্রদানের মূল্য চুক্তি প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্পষ্টতই উচ্চ শুল্কের প্রকল্পটি শ্রীলঙ্কা সরকার নিযুক্ত একটি কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেখছে। ভারতের উপকূলের কাছাকাছি এ প্রকল্প আগে চীনকে দেওয়া হয়েছিল। নয়াদিল্লি সব যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পে শ্রীলঙ্কার বিলম্বের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাতিল করা হয়েছিল। এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, কলম্বো বন্দরের পূর্ব কনটেইনার টার্মিনাল।
গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় এবং তাঁর পতন ঘটে। এর পর চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরপরই চীন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তার ‘সব ধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের’ ওপর জোর দিয়েছিল।
চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারও। চীনা অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে চীনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ‘অকৃত্রিম বন্ধুত্ব’ তুলে ধরে; অন্যদিকে ভারতীয় প্রকল্পগুলো অন্যায্য ও অসম বলে চিত্রিত। দেশটির ভারতবিরোধী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মিথস্ক্রিয়া এখন ন্যূনতম পর্যায়ে আছে। দেশটির সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে– দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তন চীনের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে না।
চীনারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা হুমকির কারণে পাকিস্তানে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি চারজন চীনা নাগরিক সিন্ধু উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক হয়রানির বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন। তারা দাবি করেছেন, ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে ন্যায্যতা ছাড়া তাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালে একজন স্থানীয় বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের পটুয়াখালীতে চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। একইভাবে ২০২১ সালে শ্রমিকদের বেতন না দেওয়া নিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে স্থানীয়দের সঙ্গে চীনা শ্রমিকদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এতে পুলিশ গুলি চালালে পাঁচজন বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হন।
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে। ভারত এ অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পে সমানভাবে যুক্ত। চীনের বিপরীতে ভারতীয় প্রকল্পগুলো দেশীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং তা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও চীনের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রূপও পরিবর্তিত হয়।
শ্রুতি এস পট্টনায়েক: ভারতের নয়াদিল্লির মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের গবেষণা
ফেলো; দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার আহ্বান
চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে এ আহ্বান জানান তিনি। বিএসইসি ভবনে এ বৈঠকে বিএসইসির কমিশনার মো. আলী আকবর ও ফারজানা লালারুখ, ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ও ডিএসইর পরিচালক ওয়াং হাইয়ের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের আইটি বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার লিন লিন ঝেং চাও, লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জিয়ান ই এবং ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হাও লিংইউ।
বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেছেন, শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও চীনের প্রতিনিধিদের শুধু ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে নয়, আমরা বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করি। এই সম্পর্ককে আমরা বিশেষ গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করি। বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সহযোগিতায় অনেক কিছু অর্জন সম্ভব।
তিনি ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধিদলের পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে কম্প্রিহেনসিভ গ্যাপ অ্যানালাইসিসের পরামর্শ দেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অংশীজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমন্বয় রক্ষা এবং প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান। চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জকে অনুরোধ জানান।
চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ, সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে উল্লেখ করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহযোগিতা করতে বিএসইসি প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।
শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ও ডিএসইর পরিচালক ওয়াং হাই বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে পাঁচ বছর পর আমরা বাংলাদেশে এসেছি এবং এর মাধ্যমে বিগত কিছু সময়ের যোগাযোগের গ্যাপ পূরণ হবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশে চীনের জন্য ভালো পরিবেশ রয়েছে এবং পুঁজিবাজার ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দুই দেশের টিম ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
তিনি বিএসইসির পথনির্দেশনা ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলোতে যথাসম্ভব সহযোগিতার আশ্বাস দেন শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল। ক্রস বর্ডার রোড শো’র বিষয়ে ডিএসই উদ্যোগ গ্রহণ করলে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে বলে জানান তিনি।
ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বৈঠকে পুঁজিবাজার ও ডিএসইর উন্নয়নের ক্ষেত্রে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও রোডম্যাপের বিষয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে ডিএসইর পক্ষ থেকে ভি-নেক্সট প্ল্যাটফর্ম ও চীনের বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ক্রস বর্ডার রোড শোসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ ও সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়াও বৈঠকে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
ঢাকা/এনটি/রফিক