পথে বিকল ট্রেন, যাত্রীদের খাওয়ালেন গ্রামবাসী
Published: 10th, February 2025 GMT
পথে হঠাৎ বিকল হলো ট্রেনের ইঞ্জিন। আশপাশে স্টেশন বা খাবারের দোকান নেই। বিকল্প আরেকটি ইঞ্জিন এনে ট্রেন সচল করতে লাগবে অনেক সময়। এই দীর্ঘ সময় ট্রেনে বসে থাকতে গিয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে পড়েন যাত্রী ও ট্রেনের স্টাফরা। বিশেষ করে, শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েন মহাবিপাকে। তাদের এমন পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে আসেন ঘটনাস্থলের পাশের গ্রামের বাসিন্দারা। ঘরে থাকা খাবার ও পানি এনে ট্রেনের যাত্রীদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করেন তারা।
এ অবিস্মরণীয় মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তাঁতীবন্ধ এলাকার বাসিন্দারা। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।
পাকশী পশ্চিমাঞ্চল বিভাগীয় রেলওয়ের টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু বলেছেন, “পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলাচল করে ঢালারচর এক্সপ্রেস। রোববার সকাল ৭টার দিকে ট্রেনটি ঢালারচর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। আমি ওই ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার রাজাপুর স্টেশন পার হওয়ার পরে হঠাৎ করেই ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে বিকল্প ইঞ্জিন এনে পুনরায় ট্রেনটি চালু করতে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট বেজে যায়। মাঝখানে সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এই সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় ট্রেনে বসে থাকতে গিয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে ওঠেন যাত্রীরা। বিশেষ করে, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েন স্বজনরা। আশপাশে স্টেশন বা দোকান কিছু ছিল না।”
তিনি বলেন, “ট্রেনের যাত্রী ও স্টাফদের এমন করুণ অবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন রেললাইন থেকে কিছু দূরে বসবাসকারী মানুষগুলো। যার যা সামর্থ্য ছিল, যার ঘরে যা রান্না করা খাবার ছিল, তা দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তারা।”
আব্দুল আলিম মিঠু জানান, পাশের গ্রামের নারীরা বাড়ি থেকে খাবার ও পানি নিয়ে ট্রেনের কাছে পৌঁছান। কারো হাতে ছিল ভাত-ডাল, কারো হাতে খিচুড়ি, কারো হাতে রুটি-সবজি, আবার কারো হাতে পানি। কেউবা আরো কিছু রান্না করে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন। বৃদ্ধ এবং শিশুদের প্রতি তাদের নজর ছিল বেশি।
রেলের ওই কর্মকর্তা বলেন, “পাবনাবাসীর এমন মানবিক দৃষ্টান্ত আমি কোথাও দেখিনি। এসব মানুষকে দেখে মনে হয়েছে, তারা বিত্তবান নন। অথচ, কীভাবে তারা মানুষের কষ্ট দেখে পাশে দাঁড়ালেন। পাবনার মানুষ যে কতটা মানবিক আর অতিথিপরায়ন তা আবারো প্রমাণ হলো।”
ঘটনাস্থল তাঁতীবন্দ গ্রামের বাসিন্দা আবেদ আলী বলেন, “আমি দেখলাম, স্টেশনের বাইরে ট্রেনটা অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি, অনেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছেন। আশপাশে কোনো দোকানপাট ছিল না। তখন আশপাশের সবাইকে সাধ্যমতো খাবার ও পানি নিয়ে আসতে বলি।”
হালিমা খাতুন নামের এক গৃহবধূ বলেন, “মানুষের কষ্ট দেখলি ভালো লাগে না? যেহেনে টেরেন থামিছিল, সেহান থেনে কিছু দূরে আমার বাড়ি। মেলাক্ষণ টেরেন দাঁড়ায়া ছিল। মেলা মানুষ। আগা যায়ে দেহি, কেউ পানি খুঁজতিছে, কেউ খাবার খুঁজতিছে। তহন বাড়িত যায়া পানি আর ভাত-ডাইল লিয়ে এনে দিছি। আমার নিজেরও ভালো লাগিছে।”
মানিক হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, “চিকিৎসার কাজে রাজশাহীতে যাচ্ছিলাম ওই ট্রেনে। হঠাৎ ইঞ্জিন খারাপ হওয়ায় ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। সকালে রওনা হয়েছিলাম ট্রেন ধরতে। তারপর বেলা গড়াতে গড়াতে প্রচণ্ড ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় অস্থির লাগতে শুরু করে। রেললাইনের আশপাশের মানুষগুলো যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল, তা সত্যি অভূতপূর্ব।”
ঢাকা/শাহীন/রফিক
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প বন র আশপ শ
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের একাল-সেকাল
ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।
দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।
সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।
গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।
এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক