ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যাবে না। তবে কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে হবে এবং কোনগুলো পরবর্তী সরকারগুলো করবে, তা চিহ্নিত করা দরকার। এর জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির ঐকমত্য দরকার।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বানে আয়োজিত এক ‘চা-চক্রে’ এই মতামত উঠে এসেছে। বুধবার বিকেল থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এই চা-চক্রটি ছিল মূলত উন্মুক্ত আলোচনা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে—মোটামুটি এমন একটা ধারণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন যেভাবে কাজ করছে, তাতে মে মাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে। আগে নির্বাচন নয় কেন? তিনি বলেন, অনেকেই বলছে বিএনপি নির্বাচন ছাড়া কিছু বলছে না কেন? নির্বাচন না হলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কে করবে? আর সংস্কার না হলে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কীভাবে?

তবে সালাহ উদ্দিন আহমদ মনে করেন, যেকোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। জাতীয় ঐক্যকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে চর্চা করতে হবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে ফলাফল বিবেচনায় বিএনপি ভালো করবে। তারাই হয়তো পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র চালাবে। শহীদের রক্তের ওপর ভিত্তি করে সংস্কারের যে গণ–আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বিএনপি যেন বিচ্যুত না হয়—এ আহ্বান জানান তিনি। এ জন্য সবাইকে বিএনপির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখারও পরামর্শ দেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ৫ আগস্টের পর অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের দায়িত্ব নেওয়াকে একটা আশীর্বাদ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ক্যানভাসটা বড় করে ফেলেছে। এত বড় ক্যানভাস প্রয়োজন ছিল না। তিনি মনে করেন, নির্বাচন ও এ–সংক্রান্ত সংস্কার, বাজারদর ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়ে সরকারের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। সংস্কারের জন্য নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়ার হলে প্রতি–অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেন তিনি।

জাতীয় নাগরিক কমিটির দুজন নেতা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্যের আগে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্রনেতৃত্বের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন।

জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা আরিফুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলও অংশ নিয়েছে। কিন্তু সরকারে আছে শুধু নাগরিক সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধি। অথচ শুরুতেই রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আগ্রহ দেখানো হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোই তাতে সাড়া দেয়নি। এখন যদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বা সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলের পছন্দ না হয়, তাদের সরকারের অংশীদার হওয়া উচিত।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আরেক নেতা রাফে সালমান রিফাত বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান ধ্বংস করেছে। এগুলোর সংস্কার দরকার—এ বিষয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে আসতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে সবাইকে ঐকমত্যের জায়গায় আসতে হবে। সংশোধন, বিচার, অনুতাপ-অনুশোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগ কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ঐকমত্য হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সেটাকে বাদ দিলে নতুন নতুন সংকট তৈরি হবে। সরকারের বিবৃতির পরও বিভিন্ন স্থানে বুলডোজার নিয়ে ভাঙচুরের ঘটনার সমালোচনা করেন তিনি।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার গঠনের ছয় মাস পরও ‘মবতন্ত্র’ মেনে নিতে কষ্ট হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বুলডোজার দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে হামলার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পরোক্ষভাবে এগুলো ঘটতে দিয়েছে বলে মনে হয়েছে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করা। এর বেশি কিছু করতে চাইলে তারা বিরোধিতা করবেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতার ছায়াতলে নয়, জনগণের ভেতর থেকে দল গঠন করতে হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ কিংবা কাউকে ‘মাইনাস’ করতে চাইলে জনগণ তুড়ি মেরে তা ছুড়ে ফেলবে। নির্বাচনকে সংস্কারের অংশ উল্লেখ করে কোন কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে এবং কোন সংস্কার নির্বাচনের পরে করা হবে, তা চিহ্নিত করার পরামর্শ দেন।

আলোচনার শুরুতে উন্নয়নকর্মী রুবি আমাতুল্লাহ তিউনিসিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাত্রার নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন।

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তাক হোসেন, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ। বক্তাদের অনেকেই ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর তৈরি করা সংস্কার প্রস্তাব পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র পরবর ত কম ট র ব এনপ দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জনতার প্রত্যাশা পরবর্তী কর্মপরিকল্পনায় কাজে লাগাতে চাই : মাসুদুজ্জামান

নারায়ণগঞ্জের জনগণের প্রত্যাশা, অভিজ্ঞতা ও উন্নয়নমূলক চাহিদাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত “মাসুদুজ্জামানের প্রত্যাশার ক্যানভাস” ৪ দিন ব্যাপী কার্যক্রমের সমাপনী অনুষ্ঠান বুধবার সকালে চাষাড়া শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়। 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, বিশিষ্ট সমাজসেবী, ও ক্রীড়ানুরাগী মাসুদুজ্জামান। বিগত চার দিন যাবৎ সদর ও বন্দরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারী হাজী ইব্রাহীম আলমচান স্কুল এন্ড কলেজ ও মদনপুর নাজিম উদ্দিন ভূইয়া কলেজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দিনব্যাপী জনমত গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

যেখানে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন এবং মাদক, যানযট, ছিনতাই ও সন্ত্রাস-সহ শিক্ষা, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা, যুব উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও স্থানীয় সেবা–ব্যবস্থা বিষয়ে প্রায় ২,০০০ মানুষ তাদের প্রত্যাশা ও মতামত লিখিতভাবে ক্যানভাসে তুলে ধরেন।

আজকের সমাপনী অনুষ্ঠানে মাসুদুজ্জামান বলেন, “নারায়ণগঞ্জের মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা জানাই আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য। যে পরিবর্তন মানুষ দেখতে চায়, তাদের কাছ থেকেই তা সরাসরি জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” 

তিনি জানান, গত চারদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত “জনতার প্রত্যাশার ক্যানভাস” কার্যক্রমে সংগ্রহ করা সব লিখিত মতামত ইতোমধ্যে নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং এগুলো ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, গবেষণা ও নীতি–প্রস্তাবনার ভিত্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো, সড়কব্যবস্থা, নগরসেবা ও স্থানীয় সুযোগ–সুবিধার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অনেক সময় নাগরিকের প্রকৃত চাহিদা পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয় না, যার ফলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নকশা, এবং উন্নয়ন অবকাঠামোয় সীমাবদ্ধতা দেখা দেয় যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নারায়ণগঞ্জেও এমন উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় বিভিন্ন প্রকল্প টেকসই হয়নি বা সাধারণ মানুষের উপকারে আসেনি।

জনসাধারণের মতামতের গুরুত্ব আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমরা বিশ্বাস করি নাগরিকদের প্রত্যাশা, অভিজ্ঞতা ও বাস্তব সমস্যাকে ভিত্তি করে টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনবান্ধব উন্নয়নের পথ তৈরি হয়।

এই উদ্যোগে মানুষ সরাসরি লিখিতভাবে জানিয়েছেন তারা কোন পরিবর্তন চান, কোন সমস্যার সমাধান জরুরি এবং স্থানীয় উন্নয়ন নিয়ে তাদের অভিমত কী। সব মতামত অগ্রাধিকার অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা পরবর্তী কর্মপরিকল্পনার জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজে লাগাতে চাই।

আজকের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দরের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।

জনতার প্রত্যাশার ক্যানভাস” নারায়ণগঞ্জের মানুষের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ স্বাধীনভাবে তাঁদের চাহিদা, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।

সংগৃহীত এই লিখিত মতামতই নারায়ণগঞ্জের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন–অগ্রাধিকার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হবে— মনটাই বিশ্বাস করেন নারায়ণগঞ্জের সাধারন জনগণ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রিয়ালের ৪ তারকা ফুটবলার নিষিদ্ধ
  • ২২টি যুদ্ধের পর শত্রুমুক্ত হয় কুষ্টিয়া
  • গত ১৫ বছর ছিল ‘মানবাধিকার সংকটের ভয়াবহ সময়’
  • জনতার প্রত্যাশা পরবর্তী কর্মপরিকল্পনায় কাজে লাগাতে চাই : মাসুদুজ্জামান