সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের ঐক্য দরকার
Published: 13th, February 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যাবে না। তবে কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে হবে এবং কোনগুলো পরবর্তী সরকারগুলো করবে, তা চিহ্নিত করা দরকার। এর জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির ঐকমত্য দরকার।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বানে আয়োজিত এক ‘চা-চক্রে’ এই মতামত উঠে এসেছে। বুধবার বিকেল থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এই চা-চক্রটি ছিল মূলত উন্মুক্ত আলোচনা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে—মোটামুটি এমন একটা ধারণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন যেভাবে কাজ করছে, তাতে মে মাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে। আগে নির্বাচন নয় কেন? তিনি বলেন, অনেকেই বলছে বিএনপি নির্বাচন ছাড়া কিছু বলছে না কেন? নির্বাচন না হলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কে করবে? আর সংস্কার না হলে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কীভাবে?
তবে সালাহ উদ্দিন আহমদ মনে করেন, যেকোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। জাতীয় ঐক্যকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে চর্চা করতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে ফলাফল বিবেচনায় বিএনপি ভালো করবে। তারাই হয়তো পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র চালাবে। শহীদের রক্তের ওপর ভিত্তি করে সংস্কারের যে গণ–আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বিএনপি যেন বিচ্যুত না হয়—এ আহ্বান জানান তিনি। এ জন্য সবাইকে বিএনপির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখারও পরামর্শ দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ৫ আগস্টের পর অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের দায়িত্ব নেওয়াকে একটা আশীর্বাদ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ক্যানভাসটা বড় করে ফেলেছে। এত বড় ক্যানভাস প্রয়োজন ছিল না। তিনি মনে করেন, নির্বাচন ও এ–সংক্রান্ত সংস্কার, বাজারদর ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়ে সরকারের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। সংস্কারের জন্য নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়ার হলে প্রতি–অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির দুজন নেতা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্যের আগে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্রনেতৃত্বের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন।
জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা আরিফুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলও অংশ নিয়েছে। কিন্তু সরকারে আছে শুধু নাগরিক সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধি। অথচ শুরুতেই রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আগ্রহ দেখানো হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোই তাতে সাড়া দেয়নি। এখন যদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বা সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলের পছন্দ না হয়, তাদের সরকারের অংশীদার হওয়া উচিত।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আরেক নেতা রাফে সালমান রিফাত বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান ধ্বংস করেছে। এগুলোর সংস্কার দরকার—এ বিষয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে আসতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে সবাইকে ঐকমত্যের জায়গায় আসতে হবে। সংশোধন, বিচার, অনুতাপ-অনুশোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগ কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ঐকমত্য হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সেটাকে বাদ দিলে নতুন নতুন সংকট তৈরি হবে। সরকারের বিবৃতির পরও বিভিন্ন স্থানে বুলডোজার নিয়ে ভাঙচুরের ঘটনার সমালোচনা করেন তিনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার গঠনের ছয় মাস পরও ‘মবতন্ত্র’ মেনে নিতে কষ্ট হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বুলডোজার দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে হামলার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পরোক্ষভাবে এগুলো ঘটতে দিয়েছে বলে মনে হয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করা। এর বেশি কিছু করতে চাইলে তারা বিরোধিতা করবেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতার ছায়াতলে নয়, জনগণের ভেতর থেকে দল গঠন করতে হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ কিংবা কাউকে ‘মাইনাস’ করতে চাইলে জনগণ তুড়ি মেরে তা ছুড়ে ফেলবে। নির্বাচনকে সংস্কারের অংশ উল্লেখ করে কোন কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে এবং কোন সংস্কার নির্বাচনের পরে করা হবে, তা চিহ্নিত করার পরামর্শ দেন।
আলোচনার শুরুতে উন্নয়নকর্মী রুবি আমাতুল্লাহ তিউনিসিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাত্রার নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন।
আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তাক হোসেন, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ। বক্তাদের অনেকেই ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর তৈরি করা সংস্কার প্রস্তাব পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র পরবর ত কম ট র ব এনপ দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল বুধবার দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ পরবর্তী ওই দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।