আয়ারল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি দ্বীপদেশ, যার রাজধানী ডাবলিন। এটি একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। দেশটি কেলটিক সংস্কৃতি, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উন্নত অর্থনীতির জন্য পরিচিত। অর্থনৈতিকভাবে আয়ারল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ। তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যাল, আর্থিক পরিষেবা, কৃষি ও পর্যটন দেশটির প্রধান খাত। গুগল, অ্যাপল, ফেসবুকসহ অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানির ইউরোপীয় সদর দপ্তর এখানে। দেশটিতে দুগ্ধ ও গবাদিপশু খাতও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত।

আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্য খাত বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সের সংকট মোকাবিলার জন্য। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে কর্মরত মোট চিকিৎসকদের প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশি, যা দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর তাদের নির্ভরশীলতার প্রমাণ। একই বছরের হিসাব অনুযায়ী, নার্সদের ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ডের নার্সিং কর্মীদের প্রায় ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিলেন বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি। আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও মিসরের মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাওয়া কঠিন।

আয়ারল্যান্ডে স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, মিসর, সুদান ও নাইজেরিয়ার মতো দেশ থেকে হাজারো স্বাস্থ্যকর্মী এখানে কাজ করছেন। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলাদেশি চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম, আর নার্সদের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। যেসব বাংলাদেশি চিকিৎসক এই দেশে কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসছেন। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেন ভারত-পাকিস্তান কিংবা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীরা সহজেই আয়ারল্যান্ডের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছেন অথচ বাংলাদেশিরা পিছিয়ে রয়েছেন? এর পেছনে বেশ কিছু কাঠামোগত ও প্রশাসনিক কারণ রয়েছে, যা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি। আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল (IMC) ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও মিসরের মেডিকেল ডিগ্রি সহজেই স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি পাওয়া কঠিন। যার ফলে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অতিরিক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। একইভাবে নার্সদের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়। আয়ারল্যান্ডের নার্সিং বোর্ড (NMBI) ফিলিপাইন, ভারত ও নাইজেরিয়ার নার্সদের স্বীকৃতি দেয়, কারণ এসব দেশের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক চুক্তি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সেই ধরনের কোনো চুক্তি না থাকার ফলে বাংলাদেশি নার্সরা আবেদন করলে তাঁরা নানা জটিলতার সম্মুখীন হন।

আরও পড়ুনরোমানিয়ায় বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা, সুযোগ-সুবিধা ও আবেদনের পদ্ধতি জেনে নিন১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের আয়ারল্যান্ডে কাজ করতে হলে সাধারণত তিনটি প্রধান ধাপে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করতে হয়। যেমন—

১.

আইএমসি রেজিস্ট্রেশন: আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিলে নিবন্ধন করতে হয়, যা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে।

২. প্রেস (PRES) পরীক্ষা: যদি ডিগ্রি স্বীকৃত না হয়, তাহলে PRES (Pre-Registration Examination System) পরীক্ষা দিতে হয়, যার মধ্যে লিখিত পরীক্ষা, ক্লিনিক্যাল স্কিলস পরীক্ষা ও সুপারভাইজড ইন্টার্নশিপ অন্তর্ভুক্ত থাকে।

৩. বিকল্প পথ: যদি কোনো ডাক্তার PLAB বা MRCP পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তাহলে তাঁরা PRES পরীক্ষা ছাড়াই IMC রেজিস্ট্রেশন পেতে পারেন। স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করতে চাইলে CESR (Certificate of Eligibility for Specialist Registration) বা সমমানের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে PRES পরীক্ষা বা PLAB/MRCP/FRCS পাস করলেও IMC রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার জন্য তাঁদের ভাষার দক্ষতার পরীক্ষা (IELTS বা OET) বাধ্যতামূলক।

আয়ারল্যান্ডে কাজ করার জন্য চিকিৎসক ও নার্সদের আইইএলটিএস বা ওইটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা বাধ্যতামূলক। IELTS-এ অন্তত ৭.০ স্কোর ও OET-তে ‘বি’ গ্রেড প্রয়োজন। ভারতের মতো দেশগুলোর চিকিৎসকেরা ও নার্সরা ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণের কারণে সহজেই এই পরীক্ষাগুলোয় উত্তীর্ণ হতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এটি তুলনামূলক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে এটি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তির অভাবও আরেকটি বড় সমস্যা। ফিলিপাইন, ভারত, নাইজেরিয়া ও সুদানের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকায় তাদের চিকিৎসক ও নার্সরা সহজেই অনুমোদন পান। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চুক্তি না থাকায় তাঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।

বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাকরির সংযোগ বা স্পনসরশিপ পাওয়া। আয়ারল্যান্ডের হাসপাতালে সরাসরি আবেদন করতে হলে স্পনসরশিপ প্রয়োজন, যা বাংলাদেশিদের জন্য পাওয়া বেশ কঠিন। ভারত বা অন্য দেশের জন্য নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি রয়েছে, যারা হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য তেমন কিছু নেই। যার ফলে তাঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছেন।

আরও পড়ুনহার্ভার্ডে বৃত্তি নিয়ে এমবিএ’র সুযোগ বাংলাদেশিদের ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কী করতে পারে বাংলাদেশ

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত, সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল (IMC) ও নার্সিং বোর্ডের (NMBI) সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। ভারতের মতো বাংলাদেশকেও স্বীকৃতি পেলে চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য চাকরি পাওয়া সহজ হবে;

দ্বিতীয়ত, সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিপাইন ও ভারতের মতো বাংলাদেশকেও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করতে হবে। এটি হলে বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সদের জন্য কাজের সুযোগ সহজ হবে;

তৃতীয়ত, IELTS ও OET পরীক্ষার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারিভাবে থাকলেও সরকারি পর্যায়ে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোয় ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান চালু করলে ভবিষ্যতে এই বাধা অনেকটাই দূর করা সম্ভব;

চতুর্থত, চাকরির সংযোগ ও স্পনসরশিপ পেতে নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি তৈরি করা দরকার। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য রিক্রুটমেন্ট সংস্থা গঠন করতে হবে, যারা আয়ারল্যান্ডের হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশকে বিশেষায়িত চিকিৎসক তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আয়ারল্যান্ডে বর্তমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চাহিদা অনেক বেশি, বিশেষ করে অ্যানেসথেসিয়া, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি ও সার্জারির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ যদি এ বিষয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসকদের তৈরি করতে পারে, তাহলে তাঁরা সহজেই আয়ারল্যান্ডের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে ভিসা–সুবিধা সহজীকরণের জন্যও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে ‘Critical Skills Employment Permit’ নামের একটি বিশেষ কর্মসংস্থান প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট পেশাজীবী সহজেই কাজের অনুমতি পান। বাংলাদেশ যদি এই প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তাহলে চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য আয়ারল্যান্ডে প্রবেশ করা আরও সহজ হবে।

আয়ারল্যান্ডে চিকিৎসক ও নার্সদের বেতনকাঠামোও বেশ আকর্ষণীয়। একজন এন্ট্রি-লেভেলের চিকিৎসক বছরে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ইউরো আয় করতে পারেন, যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আয় ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ইউরোর মধ্যে হয়ে থাকে। কনসালট্যান্ট পর্যায়ের চিকিৎসকদের বেতন আরও বেশি, যা ২ লাখ ১০ হাজার ইউরোর বেশি হতে পারে। নার্সদের ক্ষেত্রেও একইভাবে বেতনকাঠামো ভালো, যা এন্ট্রি-লেভেলে বছরে প্রায় ৩০ হাজার ইউরো থেকে শুরু হয় এবং সিনিয়র পর্যায়ে ৫৫ হাজার ইউরোর বেশি হতে পারে।

বাংলাদেশ যদি আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্য খাতে প্রবেশের জন্য পদক্ষেপ নেয়, তাহলে একদিকে যেমন চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সুযোগ তৈরি হবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো আয়ারল্যান্ডও দক্ষ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এটি দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

আরও পড়ুনউচ্চশিক্ষায় বিদেশে যেতে প্রস্তুতি কেমন, জেনে নিন ধাপগুলো১৪ এপ্রিল ২০২৪

এই লক্ষ্যে সরকারের প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করা, যাতে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও নার্সরা আয়ারল্যান্ডসহ অন্য উন্নত দেশে কাজের সুযোগ পান। প্রথমত, মেডিকেল ও নার্সিং ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে;

দ্বিতীয়ত, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি;

তৃতীয়ত, সরাসরি চাকরির সুযোগ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি রিক্রুটমেন্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে আইরিশ হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করাও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও আগামী দিনের রাজনৈতিক সরকার যদি এ সম্ভাবনাময় খাতের উন্নতির জন্য উদ্যোগ নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সরা আয়ারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে কাজের সুযোগ পেয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবেন।

*সৈয়দ আতিকুর রব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ যকর ম দ র চ ক ৎসক ও ন র স র স ব স থ যকর ম চ ক ৎসকদ র হ জ র ইউর র চ ক ৎসক ফ ল প ইন ন র জন য র জন য প কর ম দ র দ র জন য ব সরক র পর য য় পর ক ষ ক জ কর সহজ ই ইউর প র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

৭,৫০০ চিকিৎসকের পদোন্নতি হচ্ছে, স্বাচিপ সদস্যরা বাদ

নিয়মিত পদোন্নতি থেকে বেশ কিছু চিকিৎসক বাদ পড়েছেন। পাশাপাশি সুপারনিউমারারি পদেও কয়েক শ চিকিৎসক পদোন্নতি পাননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পদোন্নতি না পাওয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। বাস্তবে দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে পারছে না চিকিৎসা খাত।

আবার পদোন্নতি পেয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর সেই পদোন্নতি বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। এমন সাতজন চিকিৎসক বুঝতে পারছেন না, তাঁদের পদোন্নতি কেন বাতিল হলো। তাঁরা বলছেন, এটা অন্যায়। মন্ত্রণালয় বলছে, এই পদোন্নতি ভুল ছিল।

রাজনৈতিক বিভাজন দেশের চিকিৎসা খাতকে দুর্বল করেছে। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে একক প্রাধান্য বিস্তার করেছিল আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। মহাপরিচালক, অধ্যক্ষ, পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক, প্রকল্প পরিচালকসহ স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন স্বাচিপের সদস্য বা আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসকেরা। ছুটি পাওয়া, বিদেশ যাওয়া, গবেষণার ফান্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরাই এগিয়ে ছিলেন।

ওই ১৫-১৬ বছরে কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন বিএনপি–সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এবং জামায়াত–সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সদস্যরা। এ ছাড়া বাম রাজনীতির সমর্থক চিকিৎসকেরা এবং কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এমন চিকিৎসকেরা ঠিক সময়ে পদোন্নতি, প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা বা স্বীকৃতি পাননি। এটা ছিল অন্যায়। অনেকে মনে করছেন, এখনো একই ধরনের অন্যায় হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেওয়া বা বঞ্চিত করা অথবা বৈষম্য করা ঠিক নয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষা। মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

পদোন্নতি পেয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর সেই পদোন্নতি বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। এমন সাতজন চিকিৎসক বুঝতে পারছেন না, তাঁদের পদোন্নতি কেন বাতিল হলো। তাঁরা বলছেন, এটা অন্যায়। মন্ত্রণালয় বলছে, এই পদোন্নতি ভুল ছিল।

হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে কিছু ক্ষেত্রে স্থবিরতা দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসকের সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে শুরু করেছে। যে পদ আছে, তার চেয়ে বেশি পদে পদোন্নতি দেওয়াই সুপারনিউমারারি পদোন্নতি। যেমন মেডিসিন বা সার্জারি বিষয়ে পদ আছে ১০টি। ওই পদে কাজ করছেন ৫ জন। ৫টি পদ খালি। কিন্তু সার্জারি বিষয়ে যোগ্য মানুষ আছেন ১৫ জন। শূন্য ৫ পদসহ বাকি সবাইকে পদোন্নতি দেওয়াই হচ্ছে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি।

পদোন্নতি কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ৮২টি বিষয়ে সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক পদোন্নতি দেওয়ার নজির নেই।

গত ২৭ অক্টোবর স্বাস্থ্যসচিব মো. সাঈদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদোন্নতি না পাওয়া কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অভিযোগগুলো তদন্ত হবে। এ ছাড়া কেউ যদি মনে করেন কাগজপত্র সবকিছু ঠিক থাকার পরও পদোন্নতি হয়নি, তাহলে তিনি আমাদের জানাতে পারেন। এ নিয়ে কাজ এখনো শেষ হয়নি।’

কেন বাদ পড়লেন

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে নতুন কর্মকর্তা বসানো হয়। সরকারি সব মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও সরকারি হাসপাতালের পরিচালক পদ থেকে স্বাচিপের সদস্য বা আওয়ামী লীগ–সমর্থকদের সরিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি চাকরিতে থাকা আওয়ামী লীগ–সমর্থিত বা স্বাচিবের সদস্য চিকিৎসকদের বড় বড় শহর থেকে বদলি করে পাঠানো হয় উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে। অনেক চিকিৎসককে ওএসডি করা হয়। কয়েকজনকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত চিকিৎসক ১ লাখ ৩৪ হাজার। এর মধ্যে কিছু চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে, কিছু চিকিৎসক বিদেশ থাকেন। সরকারি চাকরিতে আছেন ৩৪ হাজার চিকিৎসক। একটি সূত্র জানিয়েছে, স্বাচিপের সদস্য প্রায় ১৩ হাজার। এঁদের প্রায় ৪০ শতাংশ সরকারি চাকরিতে আছেন। স্বাচিপের সদস্যদের নাম–পরিচয় স্বাচিপের ওয়েবসাইটে ছিল। এখন সেই ওয়েবসাইট বন্ধ।

পদোন্নতি না পাওয়া কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অভিযোগগুলো তদন্ত হবে। এ ছাড়া কেউ যদি মনে করেন কাগজপত্র সবকিছু ঠিক থাকার পরও পদোন্নতি হয়নি, তাহলে তিনি আমাদের জানাতে পারেন। এ নিয়ে কাজ এখনো শেষ হয়নি।স্বাস্থ্যসচিব মো. সাঈদুর রহমান

ওই তালিকায় নাম থাকা একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর তাঁকে ঢাকা থেকে একটি জেলায় বদলি করা হয়। এর মধ্যে সরকার শূন্য পদে পদোন্নতি দেয়। ওই চিকিৎসক অভিযোগ করেছেন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত দু-তিন মাসে শূন্য পদে নিয়মিত পদোন্নতি দিয়েছে ৭৬৮ জনকে। এই সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন ১৩০ জন। তাঁদের প্রায় সবার নাম ছিল স্বাচিপের তালিকায়।

অন্যদিকে মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে প্রায় ৭০টি বিষয়ে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে। গাইনি সহকারী পদে পদোন্নতি দিয়েছে ৫৯২ জনকে। এ ক্ষেত্রে ২৮৫ জনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যোগ্যতা থাকলেও পদোন্নতি হয়নি। এভাবে কলোরেক্টাল সার্জারি, নাক-কান-গলা, নেফ্রোলজি, থোরাসিক সার্জারি, দন্তরোগ বিষয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন অন্তত ১২ জন চিকিৎসক।

সাড়ে ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক পদোন্নতি দেওয়ার নজির নেইঅধ্যাপক আবু জাফর, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ড্যাবের সদস্য ৩ হাজার ১৪৯ জন। এনডিএফের সদস্য ৬ হাজার। ড্যাব ও এনডিএফের সদস্যদের পদোন্নতিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে চিকিৎসকদের সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে একটি অভিযোগ উঠেছে যে ড্যাব ও এনডিএফের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে স্বাচিপের সদস্যদের পদোন্নতিতে বাধা দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, পদোন্নতির তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে ও তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চিকিৎসক সংগঠনগুলো বিশেষ করে সোসাইটিগুলো (যেমন মেডিসিন সোসাইটি, ওজিএসবি) সক্রিয় ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দু-একজন কর্মকর্তাও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন।

জানতে চাইলে ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তালিকা দিয়ে তার ভিত্তিতে পদোন্নতি থেকে কাউকে বাদ দিতে বলিনি। একসঙ্গে অনেক পদোন্নতি হচ্ছে, কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলে নিশ্চয়ই মন্ত্রণালয় তা শুধরে নেবে।’

এনডিএফের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, তাঁদের সদস্যদের কারও কারও পদোন্নতি হচ্ছে না এমন অভিযোগও তিনি পাচ্ছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার তো মনে হয় মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো ঠিক হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে পদোন্নতিতে কোনো ধরনের প্রভাব রাখার চেষ্টা করা হয়নি, হচ্ছে না।’

লজ্জায় কোথাও যেতে পারছি না

পদোন্নতি না পাওয়া চিকিৎসকদের কেউ কেউ প্রথম আলোতে ফোন করে অভিযোগ করছেন যে অন্যায় করে পদোন্নতি থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেক চিকিৎসক নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসছেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং স্বাস্থ্যসচিবের কার্যালয়ে ভিড় করছেন। তাঁরা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনুরোধ জানাচ্ছেন পদোন্নতি দিতে। অনেকে সুপারিশ নিয়ে আসছেন, কেউ আসছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি সঙ্গে নিয়ে।

গত ২৭ অক্টোবর বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দুজন এবং সিলেট থেকে একজন নারী চিকিৎসক এসেছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিজীবনে তিনি ৯ বছর কাজ করেছেন উপজেলা হাসপাতালে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেওয়ার সময় তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে তিনি স্বাচিপের সদস্য নন বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এখন তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি এই অভিযোগে যে তিনি স্বাচিপের সদস্য। ওই নারী চিকিৎসক বলেন, ‘আমার ছাত্রীকে পদোন্নতি দিয়ে আমার ওপরে বসানো হয়েছে। আমি লজ্জায় কলেজে যেতে পারছি না, বাসাতেও মুখ দেখাতে পারছি না।’

স্বাচিপের তালিকায় নাম থাকা ও পদোন্নতি না পাওয়া একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনেক চিকিৎসককে জোর করে স্বাচিপের সদস্য করা হয়েছিল। কেউ কেউ হয়তো জানেনই না স্বাচিপের সদস্য তালিকায় বা ওয়েবসাইটে তাঁর নাম আছে বা ছিল।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাচিপের সদস্য নন এমন দাবি করা চিকিৎসক ৫০ হাজার টাকা চাঁদা হিসেবে স্বাচিপকে দিয়েছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে।

ওই নারী চিকিৎসক বলেন, ‘আমার ছাত্রীকে পদোন্নতি দিয়ে আমার ওপরে বসানো হয়েছে। আমি লজ্জায় কলেজে যেতে পারছি না, বাসাতেও মুখ দেখাতে পারছি না।’

বিড়ম্বনায় তাঁরা সাতজন

গত ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গাইনি অ্যান্ড অবস্‌ বিষয়ে ৫৯৯ জন চিকিৎসককে সুপারনিউমারারি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর এক দিন পর সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু কেন এই সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি মন্ত্রণালয়।

পদোন্নতি বাতিল হওয়া একজন চিকিৎসক ও দুজন চিকিৎসকের অভিভাবকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। পদোন্নতি বাতিল হওয়ায় এসব চিকিৎসক বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাঁদের একজন বলেন, এই চিকিৎসকেরা নিজেরা পদোন্নতির জন্য আবেদন করেননি। তবে তাঁরা উপযুক্ত। পদোন্নতি দেওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কথা হয়নি। কিন্তু পদোন্নতি বাতিল হওয়ায় তাঁরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কেউ কেউ তাঁদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন।

স্বাস্থ্যসচিব মো. সাঈদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই সাতজনকে ভুল করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশের প্রথম চিকিৎসকদের ডিজিটাল ডিরেক্টরি DoctorBangladesh.com
  • ৭,৫০০ চিকিৎসকের পদোন্নতি হচ্ছে, স্বাচিপ সদস্যরা বাদ