নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের ৯ সুপারিশে আপত্তি জানিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আইন সংস্কার ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হস্তান্তরের বিষয়টিও রয়েছে। ইসি মনে করে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে তাদের স্বাধীনতা খর্ব হবে।

সোমবার ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। সরকার গঠিত পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস।     

ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা ইসির অধীনে রাখাসহ মোট ৯টি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। এতে আরও বলা হয়, ইসি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু ইসি মনে করছে, নির্বাচনের পরে সংসদ সদস্যদের প্রতিহিংসার আশঙ্কায় শক্ত অবস্থান নেওয়া তাদের জন্য কঠিন হতে পারে। এ ছাড়া সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে স্বাধীন কমিশন গঠনের বিরোধিতা করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ইসি নিজেই স্বাধীন এবং এটা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছে, এতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে।

জাতীয় নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিষয়ে কমিশন বলছে, ইসির বিবেচনা অনুযায়ী সক্ষমতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অনুশীলন করে নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় চার মাসের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে ইসি বলছে, এত কম সময়ে এতগুলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। জাতীয় পরিচয়পত্র নিজেদের অধীনে রাখার পক্ষে মতামত জানিয়েছে ইসি। 

সংস্থাটি চিঠিতে বলেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার জন্য আলাদা কমিশন গঠন না করে এটি নির্বাচন কমিশনে রাখার পক্ষে তারা। এ ছাড়া আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সশরীরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে ইসি বলেছে, সশরীরে জমার পাশাপাশি অনলাইনেও জমা দেওয়ার বিধান রাখতে হবে, তা না হলে ২০১৪-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়েও নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে ইসি। তারা বলছে, এটি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে বলেছে, কমিশন ফলাফল গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একটি ঘোষণা প্রদান করবে। এ ছাড়া নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করতে হইবে। সাংবিধানিক কাউন্সিল/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ কার্যদিবসের মধ্যে উক্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। এই সুপারিশের আপত্তি জানিয়ে নির্বাচন কমিশন বলেছে, এতে নির্বাচনকে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এদিকে চিঠির বিষয়ে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এর প্রয়োজন নেই। ইসি সচিব বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণের যে ফর্মুলার কথা বলা হয়েছে, সেটি হলে শহর অঞ্চলে আসন বেড়ে যাবে। ইসি মনে করে, ভোটার সংখ্যা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিবেচনা করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। 

তিনি বলেন, ভোটের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সার্টিফাই করার বিষয়ে একটি সুপারিশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এর প্রয়োজন নেই। কারণ ফলাফলের যে গেজেট প্রকাশিত হয়, সেটাই সার্টিফিকেশন। নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও নির্বাচন কমিশনারদের শাস্তির বিষয়ে সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তাতেও ভিন্ন মত রয়েছে। ইসি সচিব আরও বলেন, রিটার্নিং অফিসার সন্তুষ্ট হয়েই ফলাফল ঘোষণা করেন। ভোটের পর তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে কমিশনারদের শাস্তির সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আপত্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, এ জন্য একটি ব্যবস্থা এখনই রয়েছে– সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। যদি নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ বছর, দশ বছর পর নির্বাচন কমিশনারদের আদালতে দৌড়াতে হয়, সেটি কি যৌক্তিক হবে? নির্বাচনে জয়ী হবেন একজন, বাকিরা সংক্ষুব্ধ হয়ে যে কোনো অভিযোগই করতে পারেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স প র শ কর ব যবস থ আপত ত

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার বসার দাবি উচ্ছেদ হওয়া হকারদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে সম্প্রতি উচ্ছেদের শিকার হকাররা আবারও আগের জায়গায় বসার দাবি জানিয়েছেন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে শাহবাগে বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন ভবনের ২ নম্বর কক্ষে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ ও ভুক্তভোগী হকারদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাশরুমচাষি ও ক্যাম্পাসে হকারদের কাছে মাশরুম সরবরাহকারী রুবি আক্তার। সঞ্চালনা করেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন ঢাকা জেলার আহ্বায়ক শবনম হাফিজ। এতে বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম, ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য ইকবাল কবির ও আঁখি মনি এবং ভাসমান উদ্যোক্তা নুরুজ্জামান কমলসহ উচ্ছেদের শিকার কয়েকজন হকার।

মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শবনম হাফিজ। তিনি বলেন, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক হকার কাজ করতেন। গত অক্টোবরে মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগ এনে ডাকসুর সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। এতে অসংখ্য হকার বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।

শবনম হাফিজ আরও বলেন, এই মানুষগুলোকে উচ্ছেদের নামে হয়রানি করা হলো, জিনিসপত্র নষ্ট করা হলো। এই ক্ষতির জবাবদিহি চাই, ক্ষতিপূরণ চাই এবং তাঁদের যেন সসম্মানে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়, সেটি চাই। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ যেন তাঁদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেয়।

আয়োজকেরা বলেন, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন ও ভুক্তভোগী হকাররা উচ্ছেদের পর নিজেদের কার কী পরিস্থিতি ও কীভাবে তাঁদের বর্তমান জীবন চলছে, তা জানতে একটি জরিপ পরিচালনা করছেন। এর আওতায় এ পর্যন্ত তাঁরা ৫০ জনের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছেন। এর মধ্য দিয়ে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা তুলে ধরার লক্ষ্যেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে রুবি আক্তার নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারির সময় স্বামীর গাড়ি ভাড়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা মাশরুম চাষ শুরু করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চাহিদার ওপরই নির্ভর ছিল তাঁদের সংসার। হকার উচ্ছেদের পর সেই বাজার প্রায় হারিয়ে গেছে।

রুবি আক্তার বলেন, ‘একজন হকারের সঙ্গে আরও অনেকের আয় জড়িয়ে থাকে—সরবরাহকারী, পানিওয়ালা ও সবজিওয়ালা। একজনের আয় বন্ধ হলে বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা চাই, হকারদের কাজের জায়গা আবারও ফিরিয়ে দেওয়া হোক, বসতে দেওয়া হোক আগের জায়গায়। তাতে আরও অনেক পরিবার বেঁচে যাবে।’

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, হকার উচ্ছেদ ডাকসুর দায়িত্ব নয়। এটি মানবিক বা ন্যায়সংগত কোনো পদক্ষেপ নয়। হকারদের সম্মানজনক ব্যবসার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা করা সম্ভব।

ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম বলেন, জনগণের মৌলিক অধিকার ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করা অন্যায় ও অমানবিক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও কয়েকজন হকার নিজেদের বর্তমান সংকটের কথা জানান।

চার দফা সুপারিশ

অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা চার দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো হলো উচ্ছেদ করা হকারদের আগের কাজের জায়গায় ফেরার সুযোগ দেওয়া; কিছুদিন পরপর উচ্ছেদের নামে হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ করা এবং যাঁরা এই নির্যাতন করেছেন, তাঁদের বিচার করা; প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সিটি করপোরেশন বা নিজেদের সমবায় বা ট্রেড ইউনিয়নের পরিচয়পত্র ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা এবং কয়েক দফায় ভাসমান উদ্যোক্তাদের হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য যে মালামাল প্রক্টরিয়াল টিম নিয়ে গেছে, তা দ্রুত ফেরত দিতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার বসার দাবি উচ্ছেদ হওয়া হকারদের
  • গৃহকর্মী নিয়োগের আগে যে চেকলিস্ট অবশ্যই দেখে নেবেন