ব্যাংক আমানত বীমা আইন রহিত করে আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ নামে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ অধ্যাদেশের খসড়া গত বৃহস্পতিবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে অংশীজনের মতামত চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। জনগণের আস্থা বাড়িয়ে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেওয়া আমানতের সুরক্ষা প্রদানই আইনের উদ্দেশ্য বলে খসড়ায় বলা হয়। 
আমানত সুরক্ষা-সংক্রান্ত যথাযথ আইন কাঠামো নির্ধারণের জন্য ব্যাংক আমানত বীমা আইন আরও যুগোপযোগী করে এ নতুন অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক আগেই ‘আমানত সুরক্ষা আইন’ করতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২ সালের খসড়া এই আইনটিকে অনুমোদন দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা, আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তা সংসদেও পাঠানো হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এটি আর চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে খসড়া আইনটি সংশোধন করে এটিকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডিপোজিট ইন্স্যুয়ার্স (আইএডিআই)-এর মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়। সেটিই এখন অধ্যাদেশ আকারে জারি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 
আইনটি কার্যকর করা হলে ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)-এর আমানতকেও বীমা সুরক্ষা দেবে এ আইন। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যাংক বিলুপ্ত হলে প্রত্যেক আমানতকারীকে আমানতের অর্থ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। তবে আইনের বিধান অনুযায়ী তা ২ লাখ টাকার বেশি হবে না।
খসড়ায় আমানত সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের আমানত সুরক্ষা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। আর আমানত সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন হবে। পর্ষদই হবে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ। সুরক্ষিত আমানত পরিশোধ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়, প্রত্যেক আমানতকারীর জন্য সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমা হবে ২ লাখ টাকা। তবে পর্ষদ প্রতি তিন বছরে অন্তত একবার সুরিক্ষিত আমানতের সীমা পুনর্বিবেচনা করতে পারবে। 
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকে জমা রাখা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা বাড়ানো তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য ব্যাংকের আমানত বীমার আওতা হিসাবপ্রতি ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। ফলে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে ৯৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী পুরো টাকা ফেরত পাবেন।

আইনের খসড়ায় বলা হয়, ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত সুরক্ষায় এ অধ্যাদেশের অধীন আমানত সুরক্ষা তহবিল গঠিত হবে। এ তহবিল গঠনে ব্যাংক থেকে প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম, বার্ষিক ঝুঁকি ভিত্তিক ও বিশেষ প্রিমিয়াম নেওয়া যাবে। লাইসেন্স পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম হিসেবে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এককালীন এ তহবিলে জমা দেবে। তবে ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০-এর আওতাধীন বীমাকৃত ব্যাংক আমানত সুরক্ষা ব্যবস্থার সদস্য বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম প্রযোজ্য হবে না। 
আমানতের সুরক্ষা তহবিলের অর্থ পর্ষদের অনুমোদনক্রমে বিনিয়োগে আলাদা নীতিমালা হবে। এ ক্ষেত্রে অধিক মুনাফা অর্জন অপেক্ষা নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র, বৈচিত্র্যময়তা ও তহবিলের তারল্য সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিনিয়োগ কার্যক্রমের যথাযথ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে প্রয়োজনে কোনো পেশাগত পরিসম্পদ ব্যবস্থাপক নিয়োগ করা যাবে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ মন ত র খসড় য় আইন র তহব ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তদন্ত ছাড়া সরকারি কর্মচারীকে আট দিনে চাকরিচ্যুত করা যাবে

সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর কঠোর হতে সাড়ে চার দশক আগের একটি অধ্যাদেশের কিছু ধারা ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি করা হচ্ছে মূলত সরকারি কর্মচারীদের রাজপথে সভা-সমাবেশ, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি বন্ধ করতে। অন্য কর্মচারীকে তাঁর কর্মস্থলে যেতে বাধা না দিতে। সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ বন্ধ করতে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো কর্মচারীর কারণে দাপ্তরিক শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটলে তদন্ত ছাড়া তাঁকে আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করতে পারবে সরকার। কেউ বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাঁকেও তদন্ত ছাড়া আট দিনের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে কোনো কর্মচারী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো কর্মচারীর কারণে দাপ্তরিক শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটলে তদন্ত ছাড়া তাঁকে আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করতে পারবে সরকার। কেউ বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাঁকেও তদন্ত ছাড়া আট দিনের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে কোনো কর্মচারী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না।

‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ সংশোধনের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো যুক্ত করা হচ্ছে। আর এ-সংক্রান্ত ধারাগুলো আনা হচ্ছে ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯’ থেকে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে নতুন সরকারি আইন পাস করার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ের অধ্যাদেশটি বাতিল হয়ে যায়।

সরকারি চাকরিতে এখন প্রায় ১৫ লাখ কর্মচারী রয়েছেন। কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, ছুটি, শাস্তি—সবকিছুই নির্ধারিত হয় ‘সরকারি চাকরি আইন ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮’-এর মাধ্যমে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এসব বিষয় বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে। অন্তর্বর্তী সরকার চায়, কর্মচারীরা অপরাধ করলে দ্রুত শাস্তি পাবেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষাসহ কয়েকটি ক্যাডারের কর্মচারীদের অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অনেক কর্মচারী বিনা অনুমতিতে দিনের পর দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছেন না। অন্য কর্মচারীদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে।

আইনটি সংশোধনের কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ। সংশোধিত আইন অনুমোদনের জন্য শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করা হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

অনিবার্য কারণে যদি সরকার আইনটি সংশোধন করতে চায়, তাহলে তাদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে আইনের অপব্যবহার হবে না।মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের প্রধান ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব এ এন এম মঈনুল ইসলাম কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন।

গত রোববার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমানের দপ্তরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে গত সোমবার মন্ত্রণালয়ের বিধি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সংশোধিত আইনটি তোলার প্রক্রিয়া চলছে।

প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনতে আইনটি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কর্মচারী বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারেন না। অন্যকে প্ররোচিত করতে পারেন না। সচিবালয়ে গিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়তে পারেন না। কর্মচারীরা মাঝেমধ্যে যুক্তি মানেন না। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

আইনে যা যুক্ত হচ্ছে

সরকারি কর্মচারী বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৯-এর চারটি ধারা সরকারি চাকরি আইনে সংযোজন করা হচ্ছে। অধ্যাদেশের তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীর জন্য যেসব বিষয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে—

১. একজন কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, যার কারণে অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি হয়, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি হয়।

২. কোনো কর্মচারী যদি ছুটি ছাড়া বা যুক্তিসংগত কারণ না দেখিয়ে নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা অন্যভাবে বিরত থাকেন এবং নিজের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন।

৩. কোনো কর্মচারী যদি তাঁর নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, একই সঙ্গে অন্য কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচিত করেন। কোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্তব্য পালন না করতে উসকানি দেন।

৪. যদি কোনো কর্মচারী আরেক কর্মচারীকে কাজে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য পালনে নিবৃত্ত করেন। কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এসব কর্মকাণ্ড করে থাকেন, তাহলে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এবং নিচের যেকোনো দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

অধ্যাদেশের ৪ নম্বর ধারায় অপরাধের দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, সরকার তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে। সরকার চাইলে অব্যাহতি দিতে পারবে। অথবা কোনো কর্মচারীর পদের অবনমন বা বেতন কমাতে পারবে।

৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, যখন কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য মামলা হবে, তখন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বিশেষ আদেশবলে তাঁর বিষয়ে অভিযোগ গঠন করবেন। কর্মচারীকে নোটিশের মাধ্যমে অভিযুক্ত করে ৫ দিনের বেশি নয়, ২ দিনের কম নয়—এমন সময়ের মধ্যে কারণ দর্শানোর কথা বলা হবে। ওই কর্মচারী ব্যক্তিগত শুনানিতে ইচ্ছুক কি না, সেটি জানতে চাওয়া হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অনেক কর্মচারী নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতি চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হচ্ছেন। কেউ কেউ দাবি আদায়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ছেন। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতেই সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করা হচ্ছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তি কারণ দর্শানোর পর ব্যক্তিগত শুনানিতে হাজির হলে শুনানি গ্রহণের পর যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে, তখন নোটিশের মাধ্যমে প্রস্তাবিত দণ্ড কেন আরোপ করা হবে না—নোটিশ জারির তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হবে। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মচারী কারণ দর্শালে অথবা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারণ না দর্শালে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নোটিশে উল্লিখিত দণ্ড অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর আরোপ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তদন্ত ছাড়া একজন কর্মচারীকে আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কোনো উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তে যদি একজন কর্মচারী ভিন্নমত পোষণ করেন কিংবা নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন, সেটিকে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ বলে চাকরিচ্যুত করার আশঙ্কা থাকবে। এ ভয়ে অনেকে নিজের মত জানাবে না।

আরও পড়ুনসচিবালয়ের ভেতরে ‘পদোন্নতিবঞ্চিত’, বাইরে চাকরিচ্যুতদের বিক্ষোভ১১ আগস্ট ২০২৪

কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক

সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগে কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেক কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের অন্তত ১০ কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ ভালো হচ্ছে না। গত সাড়ে চার দশকে কর্মচারীদের চিন্তায় ও কাজে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সমাজে অনেক মুক্তচিন্তার মানুষ তৈরি হয়েছে। সরকার যত দ্রুত বিচার করবে, তত ক্ষতি বেশি হবে। এ আইনের অপব্যবহার হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা এক জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে যাঁরা ডিসির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি। এ জন্য তাঁদের চাকরি থেকে অবসরে পাঠাতে পারছে না সরকার। সে কারণে সামরিক শাসনামলের অধ্যাদেশের কিছু ধারা নিয়ে আসা হচ্ছে, যাতে সরকারি চাকরিতে ২৫ বছর পূর্ণ না হলেও কোনো একটি কারণ দেখিয়ে তাঁদের চাকরিচ্যুত করা যাবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকারি চাকরিতে কারও ২৫ বছর পূর্ণ হলে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারেন। সরকারও চাইলে তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়া তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারবে।

আইনটি পাস হলে সরকারি চাকরিতে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে নোটিশ দিয়ে কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ আইন মানেই হচ্ছে কালো আইন। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সামরিক শাসনামলেও একই উদ্দেশে অধ্যাদেশটি করা হয়েছিল। ঢালাওভাবে কর্মচারীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রশাসনে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। একজন কর্মচারীকে অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

আরও পড়ুনজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়: অপছন্দের জায়গায় যান না, পছন্দের পদ পেতে তদবির১৩ এপ্রিল ২০২৫

যেসব উদাহরণ সামনে এসেছে

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ৮২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজি), ১৩ জন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), অর্ধশতাধিক অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ১৫ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের অনেকের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি। এ জন্য তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাচ্ছে না। আবার ৫ আগস্টের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১৮০ জন কর্মচারী এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাঁদের অনেকে কর্তৃপক্ষ থেকে ছুটি নেননি। তাঁদের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।

সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে সেখানে ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশের কিছু ধারা সংযোজন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়, দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মচারীদের সরকার বসে বসে বেতন দেবে?

আইনটি পাস হলে কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশের অনেক সদস্য চাকরিচ্যুত হবেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওএসডি হওয়া বিসিএস ২৪তম ব্যাচের পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি থাকবে নাকি চলে যাবে, এ বিষয়ে তিনি এখন ভাবছেন না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি চাকরিজীবীদের বড় একটা অংশ একের পর এক দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করে। রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ-আন্দোলন করায় ঢাকায় ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কর্মচারী ডিসি হওয়ার দাবিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ করেছেন, হট্টগোল করেছেন।

‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ নামে ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল, নিজ নিজ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া এবং সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে। আইনটি পাস হলে তাঁদের আন্দোলন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যারা ফ্যাসিস্ট, তারা মানুষের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান সরকার তো ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। তাহলে তারা কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে চায় কেন?

মফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘আইনটি পাস হলে ভালো হবে না। কোনো সরকারি কর্মচারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুত করা প্রশাসনে ভালো বার্তা দেয় না।’

আইনের অপব্যবহার করা যাবে না

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অনেক কর্মচারী নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতি চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হচ্ছেন। কেউ কেউ দাবি আদায়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ছেন। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতেই সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করা হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার কর্মচারীদের বার্তা দিতে চায় যে কোনো ধরনের আন্দোলন করা যাবে না। আন্দোলন করতে কাউকে উসকানিও দেওয়া যাবে না।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধিত আইনটির অপব্যবহার হতে পারে। অনেক নির্দোষ কর্মচারী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তিনি আরও বলেন, অনিবার্য কারণে যদি সরকার আইনটি সংশোধন করতে চায়, তাহলে তাদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে আইনের অপব্যবহার হবে না।

আরও পড়ুন৬৬ শতাংশ নাগরিকের মতে সরকারি কর্মচারীরা শাসকের মতো আচরণ করেন০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তদন্ত ছাড়া সরকারি কর্মচারীকে আট দিনে চাকরিচ্যুত করা যাবে