সাতক্ষীরার চরম বেকারত্ব ঘুচবে কীভাবে
Published: 2nd, April 2025 GMT
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি সম্ভাবনাময় জেলা। বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,কৃষি ও মৎস্য চাষের জন্য বিখ্যাত এ জেলা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)–এর তথ্য অনুযায়ী ২২ লাখ জনসংখ্যার এ জেলাটিতে ২০-২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এ জেলায় রয়েছে একটি মেডিকেল কলেজ, দুটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৪৪টি কলেজ। ৮টি উপজেলায় বিভক্ত এই জেলা পিষ্ট হচ্ছে বেকারত্বের কবলে। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে ফিরছে মা–বাবার কাছে। মিলছে না কাঙ্ক্ষিত চাকরির দেখা। হাজার হাজার বেকার যুবক হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বিসিএস আর সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে শেষ হচ্ছে অনেকের বয়স। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও মিলছে না পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ।
বিশাল এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাপ-দাদার পেশা হিসেবে কৃষি ও মৎস্য চাষ বেছে নিলেও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ আর সুযোগ-সুবিধার অভাবে হতে পারছেন না উদ্যোক্তা। সমাজের চোখে ছোট হওয়ার ভয়ে শিক্ষিত বেকারেরা কৃষি বা মৎস্য চাষকেও গ্রহণ করেন না। দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করে বেকারের তকমা নিয়ে শূন্য পকেটে ঘুরছেন এক অফিস থেকে অন্য অফিসে চাকরির সন্ধানে। বেকার নামক অভিশাপ থেকে বাঁচতে অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন গার্মেন্টে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় একটি বিশাল যুব সমাজ। অর্থের অভাব,পারিবারিক চাপ, হীনম্মন্যতা আর হতাশায় অনেকে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প পথ। মানসিক শান্তির খোঁজে কেউ যুক্ত হচ্ছেন মাদকের আড্ডায়, কেউবা অর্থের অভাবে বিসর্জন দিচ্ছেন নীতিনৈতিকতা; করছেন চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো মানবতাবিবর্জিত কাজ। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ৬২ লাখের বেশি,যেখানে শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৫৪ লাখ।
বিশালসংখ্যক এই বেকার যুবসমাজ তৈরি হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। এ জেলায় ২২ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে পাঁচ লক্ষাধিক মৌসুমি বেকার রয়েছেন। কারণ, বর্ষার মৌসুমে আশাশুনি, শ্যামনগর ও তালা উপজেলার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। ফলে কর্মসংস্থান হারানোর পাশাপাশি শত শত পরিবার ভূমিহীন হয়ে পড়েন। ভূমিহীন এ জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করলেও বড় একটি অংশ শ্রম বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে, যারা মৌসুমি বেকারে পতিত হয়। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী দেশে মোট ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সর্বশেষ জেলা হওয়ায় প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছে জেলাটি। শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য গড়ে ওঠেনি বড় কোনো শিল্পকারখানা। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। এ ছাড়া জেলার বেশির ভাগ মানুষ কৃষি ও মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশীল হলেও তৈরি হচ্ছে না উদ্যোক্তা। প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে মিলছে না চাকরি। সাম্প্রতিককালে কিছু যুবক ব্যক্তি পর্যায়ে মৌ চাষ ও মধু সংগ্রহের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে সেটিও ব্যাহত হচ্ছে।
২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি কর্তৃক সাতক্ষীরাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি বাস্তবায়িত হলে এ জেলার কৃষিপণ্য দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হবে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়াও কৃষি ও মৎস্য খাতকে আধুনিকায়ন, কারিগরি শিক্ষা, বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও শিক্ষিত এ বেকার জনগোষ্ঠীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তারা নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হতে পারবে, পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
অলিউর রহমান
শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’