বাংলাদেশে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার একটা বড় দুর্বলতা হলো এখানে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিদ্যমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যে একচেটিয়া ক্ষমতা রয়েছে, তার ফলে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এমনকি সাংবিধানিক সংস্থাগুলোও তার বাইরে থাকতে পারে না।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে সব সময় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের সব অঙ্গের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সমন্বিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রয়োজন। এ লক্ষে৵ই সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে। 

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী এনসিসি গঠিত হবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল থেকে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং তৃতীয় একটি (সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে) দল থেকে একজন সংসদ সদস্য নিয়ে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও এই সুপারিশ করেছে।

সুপারিশ অনুযায়ী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ হবে এনসিসির সুপারিশের ভিত্তিতে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের একক কর্তৃত্বে এখন যেভাবে নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদি পদে নিয়োগ হয়, তা আর সম্ভব হবে না। সরকারি দল, বিরোধী দলসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নিয়োগ করা হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এক ব্যক্তি বা এক দলের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। 

আইনসভা ভেঙে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন। এ সময় এনসিসির সদস্য থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, বিচারপতি ও প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুজন সদস্য। ফলে যেকোনো ধরনের জাতীয় ও রাজনৈতিক সংকটের সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এনসিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মতো এই সাংবিধানিক কমিশন বা এনসিসি গঠনেরও বিরোধিতা করেছে। বিএনপি মনে করে, এসব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই থাকা উচিত, যথাযথ আইন করেই নাকি এসব নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এর জন্য এনসিসির প্রয়োজন নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, নির্বাহী, আইন ও বিচার—এই তিন বিভাগের বিষয়ে এবং কিছু কমিশন, বিশেষ করে সাংবিধানিক কাউন্সিল করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের যেসব এখতিয়ার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন একটা ভূমিকা থাকবে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে, এটা হচ্ছে সংবিধানের মূল চেতনা। সাংবিধানিক কাউন্সিল করা হলে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অথচ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এনসিসির যে ৯ সদস্যের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি ছাড়া আর সবাই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাহলে এনসিসিকে কীভাবে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত বলা যায় তা বোধগম্য নয়।

এনসিসির নয়জন সদস্যের মধ্যে সরাসরি সরকারি দলের প্রতিনিধি হলেন প্রধানমন্ত্রী, উচ্চকক্ষের স্পিকার ও নিম্নকক্ষের স্পিকার। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকেও সরকারি দল ঘনিষ্ঠ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রধান বিরোধী দল থেকে থাকবেন বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার। প্রধান বিরোধী দলের বাইরে আরেকজন বিরোধী সংসদ সদস্য এর সদস্য থাকবেন। এর বাইরে এনসিসি সদস্য থাকবেন প্রধান বিচারপতি। 

সাংবিধানিক কমিশন থাকলে কী করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় বা বিতর্কিত নিয়োগ থেকে রক্ষা করা যায়, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথা বলা যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক কাউন্সিলের গঠন ও দায়িত্ব অনেকটা বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের মতোই। পার্থক্য হলো সেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সরকারি দল ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বাইরে নাগরিক সমাজের তিনজন প্রতিনিধি থাকেন, যে বিধান বাংলাদেশের প্রস্তাবিত এনসিসিতে নেই।

দেখা যাচ্ছে, এনসিসির সদস্য সরকারি দল বা দলঘনিষ্ঠ চারজন, প্রধান বিরোধী দলের তিনজন, অন্য একটি বিরোধী দলের একজন এবং নিরপেক্ষ সদস্য প্রধান বিচারপতি। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় এনসিসির গঠন বেশ ভারসাম্যমূলক বলেই প্রতীয়মান হয়। এনসিসি যেহেতু মূলত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশ করবে, তাই এনসিসি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাধা প্রদানের আশঙ্কাও অমূলক।

এনসিসির মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছে। এই ব্যাখ্যা অনুসারে—

এক.

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে এনসিসি প্রয়োজন। যেন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।

দুই. এনসিসির গঠনে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নির্বাহী বিভাগের পাশাপাশি কাউন্সিলের কাঠামোতে বিচার বিভাগ এবং আইনসভার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি, আইনসভার দুই কক্ষের স্পিকারগণ, বিরোধী দল মনোনীত ডেপুটি স্পিকারগণ এবং বিরোধীদলীয় নেতাকে সম্পৃক্ত করে কাউন্সিলটি প্রতিনিধিত্বশীল করা হয়েছে। আইনসভার প্রধান দুই দলকে বাদ দিয়ে অন্য সব সংসদ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত একজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করায় জনপ্রতিনিধিদের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুনপ্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা না কমালে কিসের সংস্কার ০৩ এপ্রিল ২০২৫

তিন. জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেকোনো রাজনৈতিক ও জাতীয় সংকটে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বা দিকনির্দেশনা দিতে এনসিসি হবে একটি অনন্য আশ্রয়স্থল। 

চার. ফ্রান্স, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, ঘানা, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কাজাখস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধান বিভিন্ন আদলে সাংবিধানিক কাউন্সিলের ধারণা গ্রহণ করেছে।

সাংবিধানিক কমিশন থাকলে কী করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় বা বিতর্কিত নিয়োগ থেকে রক্ষা করা যায়, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথা বলা যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক কাউন্সিলের গঠন ও দায়িত্ব অনেকটা বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের মতোই। পার্থক্য হলো সেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সরকারি দল ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বাইরে নাগরিক সমাজের তিনজন প্রতিনিধি থাকেন, যে বিধান বাংলাদেশের প্রস্তাবিত এনসিসিতে নেই।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক কাউন্সিল নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগেরও অনুমোদন দিয়ে থাকে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে বিতর্কিত এক বিচারক নিশাংকা বান্দুলা করুণারত্নেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করতে চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক কাউন্সিল সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করে। এ নিয়ে মামলা হলে সুপ্রিম কোর্টও সাংবিধানিক কাউন্সিলের মতামতকেই বৈধ ও চূড়ান্ত বলে রায় দেয়। 

বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় নিয়োগের সংস্কৃতি বহুদিনের। এ ধরনের দলীয়করণের ফলাফল কী হতে পারে, তার চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের হয়েছে গত দেড় দশকের স্বৈরশাসনের আমলে। কাজেই ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুশীলন করবার এখনই উপযুক্ত সময়।

সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত এনসিসি গঠন করলেই যে রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তার হয়তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। 

কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব ত র ষ ট রপত ন ম নকক ষ র জন ত ক সদস য র র সদস য এনস স র ত এনস স উপদ ষ ট গ রহণ সরক র র গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

সকালের সবচেয়ে বরকতময় সময় ব্যবহারের ৭ কৌশল

সকাল মানুষের জীবনের একটি মূল্যবান সময়, যা দিনের বাকি অংশের জন্য সুর নির্ধারণ করে। সকাল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার, শরীর ও মনকে প্রস্তুত করার এবং দিনের লক্ষ্য অর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ।

সামাজিক মাধ্যম, কাজের চাপ এবং পারিবারিক দায়িত্ব আমাদের অনেক সময় কেড়ে নেয়, তাই সকালকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা জীবনকে আরও উৎপাদনশীল করতে পারি।

১. আল্লাহর সঙ্গে দিনের শুরু

ফজরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া এবং দোয়া করা জীবনকে আমূল বদলে দিতে পারে। এই সময়টি শান্ত ও পবিত্র, যখন আল্লাহর সঙ্গে কোনো বাধা থাকে না।

কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি রাতে, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের রব নিকটতম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আছে আমাকে ডাকার, আমি সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাওয়ার, আমি দান করব? কে আছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আমি ক্ষমা করব?”’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,১৪৫)।

তাহাজ্জুদের সময় আপনার হৃদয়ের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করুন। এতে মানসিক শান্তি বাড়বে এবং দিনের জন্য ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। যদি আপনি নতুন হন, সপ্তাহে এক দিন থেকে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত করুন।

ফজরের আগে অবশিষ্ট সময়ে কোরআন তিলাওয়াত করুন, কারণ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ভোরে কোরআন পড়া (ফেরেশতাদের) দ্বারা প্রত্যক্ষ করা হয়।’ (সুরা ইসরা. আয়াত: ৭৮)।

আরও পড়ুনইশরাকের নামাজ: সকালের আলোয় আল্লাহর নৈকট্য ০৪ জুলাই ২০২৫২. ফজরের পর ঘুম থেকে দূরে থাকুন

ফজরের নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়া অনেকের অভ্যাস, কিন্তু এটি সকালের বরকতময় সময় নষ্ট করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১)।

এই সময়ে বড় বড় কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়, কারণ এতে আল্লাহর বিশেষ বরকত রয়েছে।

আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়কে বরকতময় করেছেন। মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬,৪৮১

ফজরের পর ঘুমের প্রলোভন এড়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। এই সময়ে পড়াশোনা, কোরআন মুখস্থ করা বা কোনো ব্যক্তিগত প্রকল্পে কাজ করা যায়। এটি দিনের বাকি সময়ে অবসরের জন্য সময় বাঁচায় এবং আগামী দিনে আরও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করে।

বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।

৩. করণীয় তালিকা তৈরি করুন

একটি করণীয় তালিকা তৈরি করা দিনের পরিকল্পনাকে সুসংগঠিত করে। আমরা প্রায়ই মনে মনে কাজের পরিকল্পনা করি, কিন্তু মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা সীমিত। একটি ডায়েরি বা ফোনের নোট অ্যাপে কাজের তালিকা লিখে রাখলে সময় ও শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। সম্পন্ন হওয়া কাজগুলো তালিকা থেকে কেটে দেওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে।

এই তালিকায় দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত করুন। যেমন কোরআনের একটি নির্দিষ্ট অংশ মুখস্থ করা বা একটি নতুন দক্ষতা শেখার পরিকল্পনা। এটি আপনাকে দিনের শুরুতে ফোকাসড রাখবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।

আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫বিশ্বের সফল ব্যক্তিরাও ভোর চারটা বা পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করার কথা বলেন, যা তাদের সাফল্যের একটি রহস্য।৪. সকালে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন

সকালের মূল্যবান সময় সামাজিক মাধ্যমে বা ফোনে অযথা স্ক্রল করে নষ্ট করা উচিত নয়। অনেকে সকালে ফোন হাতে নিয়ে ‘শুধু একটু দেখে নিই’ ভেবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে ফেলেন। এটি মানসিক চাপ বাড়ায় এবং সকালের শান্তি নষ্ট করে।

নিয়ম করুন, সকালের নাশতা বা কিছু কাজ শুরু না করা পর্যন্ত ফোন বা সামাজিক মাধ্যমে যাবেন না। সকালে খবর পড়া এড়িয়ে চলুন। কারণ, এটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারে। যখন ফোন ব্যবহার করবেন, তখন ইতিবাচক ও প্রেরণাদায়ক কনটেন্ট দেখুন, যা আপনার দিনকে উজ্জ্বল করবে।

৫. শরীরচর্চা করুন

শরীরচর্চার উপকারিতা আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন অনেকে বাড়ি থেকে কাজ করছেন, শরীরচর্চা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। বাড়িতে কাজ করার ফলে ঘাড়ে ও পিঠে ব্যথা, পেশির সমস্যা বাড়ছে।

সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।

ইউটিউবে হাজারো ধরনের ব্যায়ামের ভিডিও পাওয়া যায়, যা বাড়িতে সামান্য জায়গায় করা যায়। যদি বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সকালে ৩০ মিনিট হাঁটুন। লক্ষ্য হলো শরীরকে সচল রাখা এবং শক্তি বৃদ্ধি করা।

আরও পড়ুনসুস্থ জীবন যাপনে মহানবী (সা.)-এর ৯ অভ্যাস২৪ জুলাই ২০২৫সকালে মাত্র ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, যেমন যোগ, পাইলেটস, হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং বা ব্রিস্ক ওয়াক, আপনার শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে এবং মনকে সতেজ করবে।৬. পুষ্টিকর নাশতা গ্রহণ

ব্যস্ততার কারণে অনেকে সকালের নাশতা বাদ দেন, কিন্তু গবেষণা বলছে, পুষ্টিকর নাশতা দিনভর মনোযোগ বাড়ায়, অপ্রয়োজনীয় চিনির লোভ কমায় এবং শক্তি জোগায়। নাশতায় উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, যেমন ওটস বা মাল্টিগ্রেইন রুটি, স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন অ্যাভোকাডো বা বাদাম, গ্রিক ইয়োগার্ট এবং ফল অন্তর্ভুক্ত করুন।

সময় কম থাকলে একটি স্মুদি তৈরি করুন—পালংশাক, আপেল এবং হিমায়িত কলা ব্লেন্ড করে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর নাশতা তৈরি করা যায়। এটি দিনের শুরুতে সবুজ শাকসবজি গ্রহণের একটি সহজ উপায়।

৭. নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন

বাড়ি থেকে কাজ করার সময় অনেকে ক্যাজুয়াল পোশাকে থাকেন। বরং সকালে সুন্দর পোশাক পরুন, যা আপনার মেজাজ উজ্জ্বল করবে। একটু পছন্দের সুগন্ধি ব্যবহার করলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১

নবীজি (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং এটি আপনার মানসিক প্রস্তুতি ও দিনের জন্য উৎসাহ বাড়ায়।

সকাল আমাদের দিনের ভিত্তি। ইসলাম আমাদের শেখায় যে সকাল আল্লাহর বরকত নিয়ে আসে। তাহাজ্জুদ, ফজরের পর জাগ্রত থাকা, করণীয় তালিকা তৈরি, স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা, শরীরচর্চা, পুষ্টিকর নাশতা এবং নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন—এই সাতটি অভ্যাস আমাদের সকালকে উৎপাদনশীল করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সূত্র: দ্য মুসলিম ভাইব ডট কম

আরও পড়ুনরহমতের দুয়ারে হাজিরা১৫ জুন ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ