পোপ ফ্রান্সিসের শেষ আহ্বান কেউ কি শুনবেন
Published: 23rd, April 2025 GMT
দীর্ঘ অসুস্থতার পর পোপ ফ্রান্সিস গতকাল ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে ইস্টার সানডের ভাষণে রোমান ক্যাথলিকদের এই শীর্ষ ধর্মগুরু বলেছিলেন, তিনি ‘ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের খ্রিষ্টানদের কষ্ট এবং ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি সব মানুষের দুঃখের’ সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করছেন।
এই বক্তব্য ছিল গাজায় ইসরায়েলের চলমান নিধনযজ্ঞ নিয়ে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫১ হাজার ২০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন সেখানে। এই ভয়াবহ সংঘাত নিয়ে পোপের শেষ বার্তা ছিল, ‘আমি যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আহ্বান জানাই, যুদ্ধবিরতি করুন, জিম্মিদের মুক্ত করুন এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ কামনা করছে যে ক্ষুধার্ত জনগণ, তাদের পাশে দাঁড়ান।’
গাজায় চলমান বিভীষিকার চিত্র তুলতে পোপ ফ্রান্সিস যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাকে যথাযথ বলা যায় না। কারণ, গণহত্যাকে ‘সংঘাত’ বলা যায় না। যেমনভাবে ইসরায়েলি ঘাতক বাহিনী ও ফিলিস্তিনি গণহত্যার শিকার জনগণকে এককথায় ‘যুদ্ধরত পক্ষ’ বলা যায় না। তা সত্ত্বেও পোপের প্রশংসা প্রাপ্য। কারণ, তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এমন একসময়ে এই আহ্বান তিনি জানিয়েছেন, যখন বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যেন ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার হত্যাকে চিরস্থায়ীভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত।
পোপ সরাসরি দায়ী পক্ষের নাম উল্লেখ না করলেও ‘ক্ষুধার্ত মানুষদের’ জন্য সাহায্যের প্রয়োজনের যে কথা তিনি বলেছেন, তা স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে ইসরায়েলের দিকে। কারণ, মার্চের শুরুতে ইসরায়েল গাজায় সব মানবিক সহায়তা প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এটা পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি এবং যুদ্ধাপরাধের শামিল।
১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। জাতিসংঘের এক তদন্তে উঠে আসে যে এরপর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৩৬টি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবাই ছিলেন নারী ও শিশু। এমন বাস্তবতায় পোপের ভাষ্যমতে ‘একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা’ যেন কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ।১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। জাতিসংঘের এক তদন্তে উঠে আসে যে এরপর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৩৬টি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবাই ছিলেন নারী ও শিশু। এমন বাস্তবতায় পোপের ভাষ্যমতে ‘একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা’ যেন কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ। কারণ, যখন কোনো সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উঠেপড়ে লাগে, আর সেই সেনাবাহিনীর পেছনে থাকে বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ দ্বিদলীয় সমর্থন, তখন ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্নই টিকে থাকা কঠিন।
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনের শেষ দিনটিতেই তাঁর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ হয় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে। এই একই মার্কিন সরকারের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে পোপ অতীতেও একাধিকবার প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিকে তিনি ‘একটি বড় সংকট’ বলে আখ্যা দেন। কারণ, এই অভিবাসন নীতি ‘নারী-পুরুষের মর্যাদাকে পদদলিত করে’। এ মন্তব্য তিনি ফেব্রুয়ারির এক ভাষণে দিয়েছিলেন।
ইস্টার ভাষণে পোপ ফ্রান্সিস চলমান বিপর্যয়ের মুখে মানুষের দুর্দশার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দুর্বল, প্রান্তিক মানুষ আর অভিবাসীদের প্রতি কী অবহেলা আর কী পরিমাণ ঘৃণা ছড়ানো হয়!’ এরপর পোপ ফ্রান্সিস আবারও শান্তির প্রতি নিজের আশাবাদের কথা বলেন, ‘শান্তি এখনো সম্ভব। চলুন, এই আশা আমরা নতুন করে গড়ে তুলি।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ঘৃণা ও মানবতাবিরোধী আচরণই আজকের বৈশ্বিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আর এই পৈশাচিক ব্যবস্থার নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যবস্থা মুনাফা ও শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব ছাড়া আর কোনো কিছু গুরুত্ব দেয় না। মানবিকতা সেখানে তুচ্ছ। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার পেছনে অস্ত্র ব্যবসা লাভবান হচ্ছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের মধ্যে সেসব ‘অবৈধ’ শ্রমিককে দমন করছে, যাঁদের শ্রমেই চলে তাদের অর্থনীতি। এই অবহেলা ও বৈষম্য ব্যবসার জন্য লাভজনক। তাই একে টিকিয়ে রাখা হয়।
আরও পড়ুনশান্তি অসম্ভব, যত দিন অস্ত্রের ঝনঝনানি পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে৫ ঘণ্টা আগেএবারের ইস্টার সপ্তাহে ‘শান্তি সম্ভব’ এমন আশাবাদ ফিলিস্তিনের খ্রিষ্টানদের জন্যও যেন অর্থহীন এক কথা। গাজার ধ্বংসস্তূপে, ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে কিংবা জেরুজালেমে, যেখানে বাইবেলের মতে যিশুকে ক্রুশে চড়ানো হয়েছিল—কোথাও কেউ নিরাপদ নয়।
গাজা শহরের সেন্ট পোরফিরিয়াস গির্জায় এবারের ইস্টার সানডেতে ভয়ে ভয়ে প্রার্থনায় অংশ নেন খ্রিষ্টানরা। কারণ, এ গির্জাই ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার শিকার হয়। সেই হামলায় অন্তত ১৮ জন গৃহহীন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন খ্রিষ্টানও ছিলেন। তাঁরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বহু খ্রিষ্টানকে পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। খ্রিষ্টানরা ক্রমাগত ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা ও রাষ্ট্র-সমর্থিত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
চলতি বছর ইস্টার উপলক্ষে পূর্ব জেরুজালেমের অধিকৃত এলাকায় অবস্থিত ‘চার্চ অব দ্য হোলি সেপালখার’-এ অংশ নিতে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের মাত্র ছয় হাজার ফিলিস্তিনিকে অনুমতি দিয়েছে। সেখানে ইস্টারকে ঘিরে পুরো পরিবেশ ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর চাদরে মুড়ে দেওয়া এক সামরিক চেহারায়। এমনকি ফিলিস্তিনে ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি পর্যন্ত ওই গির্জায় ঢোকার অনুমতি পাননি।
এর ঠিক এক দিন পর পৃথিবীর বুকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রতিনিধি পোপ ফ্রান্সিস নিজেই বিদায় নিলেন। মৃত্যুর আগে রেখে গেলেন এক আবেগঘন আবেদন—গাজায় যুদ্ধবিরতি হোক।
প্রশ্ন এখন একটাই, এই আহ্বানে কেউ কি সাড়া দেবে?
● বেলেন ফার্নান্দেজ লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কমিটি নেই, সবাই নেতা
কয়রা উপজেলা বিএনপির কমিটি নেই একযুগ। দীর্ঘদিন ধরে চলেছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। সেটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে ৪ মাস আগে। কমিটি না থাকায় দলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। ভেঙে পড়ছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাও। কেউ কারও কথা শুনছেন না। অবস্থা এমন, যেন সবাই নেতা– অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীর।
কমিটি না থাকলেও উপজেলার একশ মিটারের মধ্যে পৃথক দুটি কার্যালয় রয়েছে। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে বহিষ্কৃত) নুরুল আমিন বাবুল। আরেকটি কার্যালয় চলছে খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য এম এ হাসানের নেতৃত্বে। নেতৃত্বের এ দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি নেই। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছাড়া অন্যান্য কর্মসূচিতে কার্যক্রমও সীমিত। এ অবস্থায় দ্রুত কমিটি দেওয়ার দাবি দলীয় নেতাকর্মীর।
পৃথক কার্যালয়ের বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য এম এ হাসান বলেন, উপজেলায় একটি দলীয় কার্যালয় ছিল। পরে স্থানীয় একজন নেতা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে আরেকটি কার্যালয় খুলেছেন; যা সংগঠনবিরোধী কাজ। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই নেতাকে বহিষ্কার করা হলেও এখন পর্যন্ত তিনি কার্যালয়টি বন্ধ করেননি।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি মনজুর আলম বলেন, ৫ আগস্টের পর দুই নেতার বিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। আগে দলে বিভক্তি থাকলেও আলাদা কার্যালয় ছিল না। এখন দুটি কার্যালয় থাকায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন কর্মী-সমর্থকরা।
২০১৩ সাল পর্যন্ত উপজেলায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল। এরপর দুই দফায় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ মোমরেজুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও নুরুল আমিন বাবুলকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় জেলা বিএনপি। এরপর থেকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে নুরুল আমিনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এ অবস্থায় চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু।
এদিকে কমিটি না থাকায় বেশির ভাগ নেতা স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েকজনের বিরুদ্ধে হাট, ঘাট, খাল দখলের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি সুবিধায় হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ আছে। এতে দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ অবস্থায় দ্রুত কমিটি গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন বিএনপির সাবেক নেতা আব্দুস সামাদ।
সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আমিন বলেন, ভিত্তিহীন অভিযোগে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে দলীয় কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না। আশা করছি খুব দ্রুতই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে। তখন গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠনের চেষ্টা করব।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোমরেজুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে কয়রায় বিএনপির কোনো কমিটি নেই। কমিটি হলে দলীয় সব বিরোধ মিটে যাবে বলে আশা করছি।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু বলেন, কয়রায় কমিটি গঠনের জন্য জেলা বিএনপি থেকে ৫ সদস্যের সার্চ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি নেতাকর্মীর বিরোধও নিষ্পত্তি করবে। দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ একটি কমিটি উপহার দেওয়া হবে।