বজ্রপাতে ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের মৃত্যু
Published: 29th, April 2025 GMT
দেশের হাওর অঞ্চলে এখন পুরোদমে চলছে ধান কাটা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকের বিরাম নেই। ব্যস্ততা ছিল ইন্দ্রজিৎ দাস ও স্বাধীন মিয়ারও। ধান কাটতেই গিয়েছিলেন ফসলের মাঠে। দুজন পাশাপাশি মাঠে ফসল কাটছিলেন। হঠাৎ আকাশ কালো করে আসে মেঘ। সঙ্গী কৃষকেরা সেই মেঘ দেখে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান; কিন্তু যাননি এই দুই কৃষক। একটু বাড়তি ধান কেটে সময় বাঁচানো, কিছু বেশি আয় করা, নিজেদের সাশ্রয়? কে জানে!
কিন্তু সেই ফসল কাটাই কাল হলো দুজনের জন্য। সকাল পৌনে ১০টার দিকে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি শুরু হয়। তখন বজ্রপাতে দুজনেরই মৃত্যু হয়। দুই কৃষকের জীবন সমাপ্ত হয়, ব্যস্ততার হয় অবসান।
বজ্রপাতে নিহত দুই কৃষক ইন্দ্রজিৎ দাসের (৩০) বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের হালালপুরে এবং স্বাধীন মিয়ার (১৫) বাড়ি একই উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে।
শুধু এই দুজন নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত রোববার ও গতকাল সোমবার বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত সময়ে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যু বলে জানিয়েছে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম।
বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুসর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লার মুরাদনগর, দেবীদ্বার ও বরুড়া উপজেলায় পাঁচজন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনে তিনজন, নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও মদনে দুজন এবং সুনামগঞ্জের শাল্লা, চাঁদপুরের কচুয়া এবং হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একজন করে বজ্রপাতে মারা আছেন। চলতি বছর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আর এত মৃত্যু হয়নি বলে জানান ডিজাস্টার ফোরামের সমন্বয়কারী মেহেরুন নেছা। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোববার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত বজ্রপাতে এ বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে। এর আগে চলতি মাসের ১৬ তারিখ বজ্রপাতে নয়জনের মৃত্যু হয়েছিল।
ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য, গতকালের এ মৃত্যু নিয়ে বজ্রপাতে চলতি মাসে ৪৫ জনের মৃত্যু হলো। এটিও এ বছরের সর্বোচ্চ। আর এ মাসে বজ্রপাতে ৩০ জন আহত হয়েছেন।
মেহেরুন নেছা বলছিলেন, বজ্রপাতে নিহত হওয়ার সংখ্যাটাই কেবল খবর হয়; কিন্তু এতে যে অনেক মানুষ আহত হয়, তা নিয়ে কথা তেমন হয় না। অথচ বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের ভোগান্তি অনেক।
হাওর এলাকায় বেশি মৃত্যু, কৃষকই বড় ভুক্তভোগীগত রোববার থেকে সোমবার পর্যন্ত বজ্রপাতে নিহত ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনেরই মৃত্যু হয়েছে হাওর এলাকার। নিহত এসব মানুষের বেশির ভাগই কৃষিজীবী।
দেশে প্রায় প্রতিবছর বজ্রপাতে যত জনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে বেশির ভাগ মৃত্যুই হয় জলাভূমির হাওর অঞ্চলে।
গতকাল হাওরের জেলা কিশোরগঞ্জে তিনজন, নেত্রকোনায় দুজন, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে একজন করে মারা যান বজ্রপাতে।
বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন কৃষক। যে দুজনের কথা দিয়ে এ প্রতিবেদন শুরু হয়েছিল, তাঁরা ধান কাটতেই গিয়েছিলেন মাঠে। হাওরের জেলা ছাড়া কুমিল্লায় যে দুজনের মৃত্যু হয়, তাঁরাও কৃষক। দুজনের নাম নিখিল দেবনাথ (৫৮) ও জুয়েল ভূঁইয়া (৩০)। দুজনেরই বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলায়।
দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন হাওরে ধান কাটার সময়। খোলা এই প্রান্তরে কৃষকের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। এখন কৃষকদের সতর্কতা নিতে হবে। মেঘ দেখলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।
বজ্রপাতে প্রাণ হারালেন কৃষিকাজে থাকা ৩ নারীগত ২৪ ঘণ্টায় নিহত ১৩ জনের মধে৵ তিনজন নারী। তাঁদেরই একজন বিশাখা রানী (৩৫)। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের নাহারা গ্রাম। বিশাখা ওই এলাকার কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী।
কচুয়া থানার ওসি আজিজুল ইসলাম জানান, বাড়ির পাশে স্বামী-স্ত্রী মিলে নিজ জমি থেকে ধান তুলছিলেন। এ সময় কাছাকাছি কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। এ সময় বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুগুর হাওরে গতকাল বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধান কাটা শ্রমিক প্রাণ হারান।
মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে বজ্রপাতে ফুলেছা বেগম (৬৫) নিহত হন গতকাল। মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন ফুলেছা বেগম। এ সময় বজ্রপাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
বজ্রপাতের ঝুঁকি সামলাতে যা করতে হবেদেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়ে। দিন দিন দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ‘বজ্রপাতের সতর্কতা’ আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে।
এপ্রিল থেকে মে মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হয় সাধারণত। এর কারণ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এ সময় কালবৈশাখীর প্রকোপ বাড়ে। এ ধরনের ঝড়ের বৈশিষ্ট্য হলো এর সঙ্গে থাকে বজ্রপাত, ঝোড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টি।
বজ্রপাতের ঝুঁকি প্রশমনে একগুচ্ছ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর মধ্যে আছে বজ্রপাতের জানালা ও দরজা বন্ধ রাখতে হবে, গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশগুলোর প্লাগ খুলে রাখতে হবে, জলাশয়ে থাকলে দ্রুত উঠে আসতে হবে এবং অবশ্যই বিদ্যুৎ পরিবাহক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে এবং সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে।
মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এখন যে ঝড়-বৃষ্টি হয়, তা খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। তাই মেঘ দেখলে অন্তত আধা ঘণ্টা সময়ও যদি নিরাপদে থাকা যায়, তবে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
দেশে টানা প্রায় চার দিনের তাপপ্রবাহ শেষে গত রোববার রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গতকালও চট্টগ্রাম বিভাগে কিছুটা কম হলেও অন্য বিভাগের প্রায় সবখানে বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সিলেটে সর্বোচ্চ ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আজ মঙ্গলবার দেশের রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ মো.
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ ও ভৈরব, হবিগঞ্জ; প্রতিনিধি, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও চাঁদপুর]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জন র ম ত য ক শ রগঞ জ ১৩ জন র ম উপজ ল র দ জন র ন র পদ এ সময় গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত, সচিব কমিটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাবে
পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে অধ্যাদেশের খসড়াটি সচিব কমিটির মাধ্যমে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রমের খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন। সদস্য থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ; গ্রেড-২ পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা; পুলিশ একাডেমির একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ; আইন, অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; ১৫ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন একজন মানবাধিকারকর্মী।
আরও পড়ুনপুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন অপরিহার্য৮ ঘণ্টা আগেকমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন।কমিশনের চেয়ারপারসন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমপদমর্যাদার হবেন। সদস্যরা যোগদানের দিন থেকে চার বছর নিজ নিজ পদে থাকবেন। মেয়াদ শেষে কোনো সদস্য আবার নিয়োগের যোগ্য হবেন না।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলা হয়েছে—এই কমিশন যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সত্তাকে কোনো নির্দেশ দিলে উক্ত কর্তৃপক্ষ বা সত্তা অনধিক তিন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। তবে কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা হলে সে ক্ষেত্রে নির্দেশ বা সুপারিশ পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে হবে। কমিশন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে যে নির্দেশ বা সুপারিশ পাঠাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ বা সুপারিশ কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করে কমিশনকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুনকোনো দল নয়, পুলিশের আনুগত্য থাকবে আইন ও দেশের প্রতি৯ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।এই কমিশনের সদস্য পদে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য সাত সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যকে বাছাই কমিটিতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম হওয়া ও বাছাই কমিটির বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবে।
আরও পড়ুন‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা১৭ ঘণ্টা আগেপুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ খসড়ায় কমিশন প্রতিষ্ঠা, কার্যালয়, সদস্যদের নিয়োগ, মেয়াদ, কমিশনের সদস্য হওয়ার জন্য কারা অযোগ্য, সদস্যদের পদত্যাগ, অপসারণ, পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান-নিষ্পত্তি, পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসন, পুলিশপ্রধান নিয়োগ, আইন-বিধি, নীতিমালা প্রণয়ন ও গবেষণা বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পর জুলাই জাতীয় সনদেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১৭ ঘণ্টা আগে