ধানমন্ডি ২৭ নম্বর বেঙ্গল গ্যালারি, মুনেম ওয়াসিফের একক প্রদর্শনী– ‘ক্রমশ’ বর্তমানে চলমান। দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, এই বয়সে তরুণ শিল্পী মুনেম ওয়াসিফ কাজ করছেন শূন্য দশক থেকে। শিল্পে তাঁর প্রধান হাতিয়ার আলোকচিত্র। প্রায় দু’দশক ধরে পুরান ঢাকা নামের একটা ভৌগোলিক পরিসরে কাজ করে চলছেন। তাঁর সাদাকালো ছবির পুরান ঢাকা, যেন টানটান উত্তেজনার সার্কাস। ওয়াসিফ মুগ্ধ দর্শকের মতন হাঁ করে তাকিয়ে দেখছেন, পুরান ঢাকার সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা, মানুষ, শরীর, রুটি, অবসর, রিকশা, কাক, ছাদ।
পুরোনো আর্কিটেকচারে স্মৃতি সঞ্চিত থাকে আর সঞ্চিত স্মৃতির প্রতি আমাদের এক ধরনের মোহ আছে। পুরান ঢাকার পুরোনো ইমারত ঘরবাড়ি ‘স্পেইস’-এ মানুষের জীবনের গতিপথের টক্কর, সেই মোহে আবিষ্ট ওয়াসিফ রেকর্ড করছেন লুকিয়ে লুকিয়ে, স্বনির্ধারিত, স্বনির্বাচিত দূরত্বে। হ্যাঁ, ফটোগ্রাফি যতটা না, ফাইন প্রিন্ট, কালার, কনট্রাস্ট কলা, তার চেয়ে বেশি দেখা, অবলোকন করার আর্ট। ওয়াসিফের এই সাদাকালো ছবিগুলো, আলো-ছায়া আর জীব-জড় বস্তুর বিভিন্ন সম্পর্কের নাটকীয় মুহূর্তের স্মৃতি। যার ভেতরে তাকিয়ে আমরা একটা জনপদের জীবনপ্রবাহ, বার্ধক্য, বেদনা, উৎসবে শিল্পীর বয়ানে একটা সামগ্রিক বাস্তব অভিজ্ঞতার আমন্ত্রণ পাই।
অন্যদিকে আছে রঙিন ছবি, জড় বস্তুর। একটা ফ্লুরোসেন্ট রঙের পাইপ এঁকেবেঁকে জড়িয়ে যাচ্ছে, চকচকে স্টেইনলেস স্টিল কাঠামো, বহুস্তরীয় জটিলতায় আক্রান্ত টেলিফোন ইন্টারনেটের তার এমন ছবিগুলো, ওই সাদাকালো ছবিগুলোর পাশে, ওপরে নিচে, সমন্বয় রেখে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করা। এমনিতে আলোকচিত্রীরা যখন জড় বস্তুর ছবি তোলেন, তখন আমরা প্রায়শই দেখি সেগুলো বিমূর্তের দিকে ধাবিত হয়। উইলিয়াম এগলস্টন, স্টিফেন শোর, মোরিয়ামা দাইদো এমন আরও কিংবদন্তি শিল্পীর উদাহরণ দেওয়া যাবে, যাদের ‘অবজেক্টের’ ছবিগুলো কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর নানান পার্সস্পেক্টিভ থেকে দেখা এবং একেবারে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট।
ওয়াসিফের ছবিতেও এদের অনেকের অনুপ্রেরণা খুঁজলে পাওয়া যাবে কিন্তু অন্য অনেকের চেয়ে ওয়াসিফের এই জড় বস্তু বা অবজেক্টের ছবিগুলো ‘সহি’ বিমূর্ত থাকতে পারে না। তাদের অর্থ উদ্ধার করতে হয় ওই সাদাকালো ছবিগুলোর সাপেক্ষে। দুটো ছবি পাশাপাশি থাকলেই তৃতীয় আরেকটি অর্থ উৎপন্ন হয়ই। সাদাকালো এবং রঙিন এই বৈপরীত্য নিয়ে তৈরি ‘স্টেরিও’ মনে হয় যেন ওয়াসিফের শিল্পচিন্তার ক্রমবিবর্তনের রূপ। ওয়াসিফ একসময় যেমন ছবিতে পুরান ঢাকার রূঢ বাস্তবতার চিত্রণ করতেন, পুরান ঢাকার গ্যাঞ্জামে যেভাবে তাৎক্ষণিক আলো-ছায়া আর এক্সপ্লোরার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো তা ঠিক তারুণ্যের মনোদৈহিক ক্ষিপ্রতার মতন। আর রঙিন ছবিগুলো শান্ত, ক্যালকুলেটেড রিস্কের মতন তাকে তুলনা করতে পারি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দৃঢ় ব্যাটারের মতন। ডিফেন্সে সচেতন, অ্যাটাকে সাবধানি।
স্মৃতি আর বর্তমানের দ্বন্দ্ব ছাড়াও এই দুই ধরনের ছবির একটা অভ্যন্তরীণ মিল আছে। সেটি হলো কুড়িয়ে পাওয়ায়। ওয়াসিফ সাদাকালো ছবিতে পুরান ঢাকার ভূগোলে ঘুরে ঘুরে নানান মানবিক চিত্র সংগ্রহ করেন, আর রঙিন ছবিতে একই মানচিত্রের গণ্ডিতে অর্থ উৎপন্ন করতে পারে, এমন নানান জড় বস্তুর ছবি সংগ্রহ করেন।
স্মৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত আরেকটি কাজ তাঁর এই প্রদর্শনীতে আছে। সাদাকালো সিনেমা ‘খেয়াল’। এই খেয়ালের মঞ্চও পুরান ঢাকা। যার শুরু-শেষ নেই। যেখান থেকে দেখা শুরু করবেন সেখান থেকেই শুরু, আবার সেখানে এসেই শেষ। এখানেও গল্প স্মৃতিকাতর। কখনও কখনও, কোনটা অতীত আর কোনটা বর্তমান তা গুলিয়ে যাচ্ছে। সংলাপ নেই সুর আছে। সেই সুরও যেন কোনো অতীত থেকে আসে। আর আছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের নানান রেফারেন্স। ইলিয়াস আসেন, শহীদুল জহির আসেন। দৃশ্যকল্প, ষাট-সত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত বিচরণ করে। ওয়াসিফ মনোক্রোমে আমাদের অদ্ভুত কুহকের মতন গল্প বলেন, ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য নিয়ে। নানান প্রতীক, স্টিল লাইফ, একাকী মানুষের জীবনের মুহূর্ত, গল্প আগে বাড়িয়ে নিয়ে যায়। হয়তো ধারাভাষ্যের অনুপস্থিতি সিনেমাটির অর্থ আরও নৈর্ব্যক্তিক করে। সিনেমায় শব্দও হাজির হয় গল্পের চরিত্র হিসেবে। স্বপ্ন, স্মৃতি, কল্পনা সবকিছু একসাথে নিয়ে খেলতে থাকেন ওয়াসিফ।
ওয়াসিফের আর্টের মধ্য দিয়ে জীবন দেখানোর এবং দেখাবার তরিকার মধ্যেও বৈপরীত্য দেখা যাবে। কখনও জীবনের সত্য বাস্তবতা অনুসন্ধান করেন, আবার কখনও যেন খেলাচ্ছলে দেখেন। এই যে তাঁর পেপার নেগেটিভ নামের কাজটি যেন ফটোগ্রাফির আদিম পন্থা নিয়ে এক ধরনের খেলা। একদম বেসিক একটা কালো বাক্স, তাতে লেন্স আঁটা, পেছনে কালো পর্দার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে কাগজের নেগেটিভে ফটোগ্রাফার সামনে বসে থাকা মানুষের মুখের ছবি ধরছেন। নব্বইয়েও গুলিস্তানের মোড়ে এসব ক্যামেরায় লোকে পাসপোর্ট ছবি তুলতেন। মিনিটেই ছবি প্রিন্ট। বর্তমানে অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা যেন চিন্তা করার আগেই ছবি তুলে ফেলতে পারে! বাক্স ক্যামেরায় এমনটা সম্ভব না। এর একটা লম্বা প্রক্রিয়া আছে, ফটোগ্রাফার আর সিটারের, কেমিক্যাল আর কাগজের এমন সম্পর্ক, শুধু নিবিড় শ্রমলগ্ন শিল্পেই সম্ভব। ওয়াসিফ তাঁর আর্টিস্ট স্টেইটমেন্টে বলছেন এই দুই চরিত্রের একে অপরের প্রতি আগ্রহ আর মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক তাঁর কাজের বিষয়।
ওয়াসিফ আরও প্লেফুল হয়ে ওঠেন তাঁর ‘কুড়িয়ে পাওয়া’ ভাস্কর্যে। ছবির দ্বিতল মাধ্যম থেকে বেরিয়ে স্থপতি রূপ ধারণ করেন। ওই পুরান ঢাকার পথে প্রান্তরে, মোটর গ্যারেজে, বাজারে, অলিগলিতে, নির্মাণসামগ্রী, সংসারের উচ্ছিষ্ট বস্তু সংগ্রহ করেন। ক্ষয়ে যাওয়া আসবাবের টুকরো, জুতোর ফিতে, স্প্রিং আরও যত মালপত্র গোলকায়নের নিশানা, ভোক্তা সমাজের প্রতীক অথবা নেহাতই বিশিষ্টতাহীন হিসেবে অর্থ করা যায় তাদের একসাথে জুড়ে নতুন রূপ দেন। এমন মূল উদ্দেশ্য হারানো বস্তুসমূহের নতুন ত্রিমাত্রিক সংযোগ, সমাবেশ ও সংযোজনের মাধ্যমে ওয়াসিফ নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেন তাঁর ২০২০ থেকে শুরু করা কাজ ‘সামান্য’-এ। এই অ্যাসেমব্লিজ ঘরানার কোন ইনস্টলেশনে কোনটি পরিচিত অবয়বের প্রতিরূপ আর কোনটি নেহাতই বিমূর্ত ও নির্লিপ্ত। কিন্তু এই বিমূর্ততাও শেষ পর্যন্ত নির্দোষ না থাকতে পেরে সম্পর্ক করে নেয় সেই পুরান ঢাকায় তোলা সাদাকালো জীবনঘনিষ্ঠ ছবিগুলোর সাথে, আত্মিক এবং পদ্ধতিগতভাবে।
ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতে যেমন করে ছবি খুঁজতে হয়, ওয়াসিফ সামান্যর জন্যও খোঁজেন। ছবি তোলার প্রক্রিয়ায় যেমন সামান্য মুহূর্ত একটা বিশেষ মর্যাদা পায়, যে মুহূর্তগুলো আমরা সচরাচরই উপেক্ষা করে যাই। তেমনি ‘সামান্য’ও উপেক্ষিত বস্তুর সমাবেশ। আগেই বলেছিলাম শিল্পে ওয়াসিফের প্রধান হাতিয়ার আলোকচিত্র। এই ডকুমেন্টারি আলোকচিত্রণ প্রক্রিয়াই তিনি ব্যবহার করেন অপরাপর শিল্প মাধ্যমে। তাঁর চলচ্চিত্র খেয়ালের স্টাইল ও ডকুমেন্টারি ভাষার মতন। ওয়াসিফ পুরান ঢাকায় ঘুরে ঘুরে মুহূর্ত, স্মৃতি, জীবনের ফসিল সংগ্রহ করেন, তাদের জুড়ে জুড়ে নতুন মানে করেন।
কোনো কোনো শিল্পীর হয়তো আলাদা একটা মাতৃভূমি থাকে, যেখানে সে সবচেয়ে স্বাধীন, সবচেয়ে উদ্যমী, সৃষ্টিশীল। পুরান ঢাকা হয়তো ওয়াসিফের শিল্পের মাতৃভূমি। এখানেই শিল্পী হিসেবে তাঁর বেড়ে ওঠা। স্মৃতি, বিবর্তন আর নতুন সংযোগ স্থাপন এসবই ওয়াসিফের শিল্পের মূলে আর পটভূমিতে পুরান ঢাকা। ওয়াসিফের শিল্পীসত্তা একটা সময়ের ভাঙাগড়া, নতুন চিন্তা নতুন পথে হাঁটা, পরিবর্তন– এসবেরই প্রামাণ্য দলিল যেন প্রদর্শনী ‘ক্রমশ’। প্রদর্শনী শেষ হবে ৩১ মে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কানাডা কখনোই বিক্রির জন্য নয়, ট্রাম্পকে কার্নি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, ‘কানাডা কখনোই বিক্রির জন্য নয়।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানাডা দখলের হুমকি ও বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। এর মধ্যে মঙ্গলবার দুই দেশের নেতা মুখোমুখি বৈঠক করেন। এ সময় ট্রাম্প কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হওয়ার সুবিধাগুলো নতুন করে কার্নির সামনে তুলে ধরলে তিনি ওই কথা বলেন।
ট্রাম্পকে কার্নি বলেন, যেমন আপনি জানেন রিয়েল এস্টেটে কিছু জায়গা আছে যেগুলো বিক্রির জন্য নয়। কানাডাও বিক্রির জন্য নয়। এটি কখনোই বিক্রি করা হবে না। তবে অংশীদারিত্বের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা আছে এবং আমরা একসঙ্গে তা গড়ে তুলতে পারি। অতীতেও আমরা সেটি করেছি।
জবাবে ট্রাম্প বলেন, কখনও কথাটি কখনোই বলবেন না। সময়ই বলে দেবে। আমার অনেক, অনেক কিছুই আছে যেটি করা সম্ভব ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি করা সম্ভব হয়েছে এবং কেবল খুব বন্ধুত্বপূর্ণভাবেই করা সম্ভব হয়েছে।
ট্রাম্পবিরোধী বার্তা দিয়ে কানাডার নির্বাচনে মার্ক কার্নির জয়ের পর এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার প্রথম বৈঠক। কানাডায় এবারের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কার্নির লিবারেল দলের জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কানাডা দখলের হুমকি ও বাণিজ্য যুদ্ধ।
ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কা সামলাতে এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১ তম ‘রাজ্য’ বানানোর হুমকি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি নির্বাচনের আগে জাতির কাছে 'শক্তিশালী ম্যান্ডেট' চেয়েছিলেন। এরপর নির্বাচনে জয় ঘোষণার পরই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কড়া ভাষণ দিয়েছিলেন কার্নি। বলেছিলেন তার দেশ ‘কখনও’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করবে না। সেই বক্তব্যের পর তিনি এবার ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করলেন। খবর বিবিসি