রংপুর মহানগর ও জেলা কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই কমিটির ১৬ নেতা। 

রোববার রাতে জেলা শিল্পকলা একাডেমির হলরুমে সংবাদ সম্মেলন করে তারা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার ঘোষণা দেন আরও বেশ কয়েকজন কর্মী।

পদত্যাগকারী নেতাদের মধ্যে রংপুর মহানগর কমিটির ১১ জন ও জেলা কমিটির ৬ জন রয়েছেন। তারা হলেন- মহানগর কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব সিয়াম আহসান, সংগঠক আদনান সামির, মাহদী হাসান, গোলাম আযম, এনায়েত রাব্বি, সদস্য আরাফাত সানি, আল-শামস সিয়াম, আল আমিন, সীমান্ত হোসেন, মোজাহিদ ও আল তানজীল আহসান এবং জেলা কমিটির সদস্য মুবতাসিম ফুয়াদ, জুনাইদ ইসলাম, সৃজন সাহ, মাহতাব হোসেন ও সাওম মাহমুদ। 

সংবাদ সম্মেলনে রংপুর মহানগর কমিটির পদত্যাগকারী যুগ্ম সদস্যসচিব সিয়াম আহসান বলেন, ‘সম্প্রতি রংপুর জেলা কমিটির আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ কিছু নেতার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এবং এসবের সপক্ষে পাওয়া প্রমাণ আন্দোলনের মূল চেতনা ও আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এই নেতাদের অপকর্মের দায় আমরা যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছি, তাদের ওপরও বর্তাচ্ছে, যা অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানজনক।’ 

মাহতাব হোসেনের অভিযোগ, গত ফেব্রুয়ারি মাসে রংপুরের ঘাঘট নদের পাড়ে গ্রামীণ কুটির শিল্প মেলায় ব্যাপক জুয়ার অভিযোগ ওঠে। সেখান থেকে মহানগর ও জেলা কমিটি মিলে ১৪ লাখ টাকা চাঁদা নেয়। তখন মহানগর ও জেলার শীর্ষ নেতাদের কাছে কৈফিয়ত দাবি করলেও তারা দেননি। এ ছাড়া মামলাবাণিজ্য, ফেনীর বন্যার সময় ত্রাণের অবশিষ্ট ৮৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৫ কর্মচারীর নিয়োগে কয়েক লাখ টাকা বাণিজ্য করেছেন তারা। পদত্যাগকারী অন্য নেতারাও একই অভিযোগ করেন। 

তারা বলেন, ‘যে মূল্যবোধ ও আদর্শকে ধারণ করে তারা বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছিলেন, তা আজ গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা এই অন্যায়ের দায় নিতে বাধ্য নই। এ কারণে পদত্যাগ করলাম।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমরান আহমদ বলেন, ‘আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার। পুরো প্লাটফর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলন করে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা হবে। 

মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, ‘আমি কোনো অনৈতিক বা দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াইনি। অবশ্যই কারও না কারও স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলে এমনটি করা হচ্ছে।’

এর আগে গত ১৫ মে জেলা কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান পদত্যাগ করেছেন।

গত ২৪ নভেম্বর রাতে ইমতিয়াজ আহমেদকে আহ্বায়ক ও রহমত আলীকে সদস্যসচিব করে ১১২ সদস্যের মহানগর কমিটি এবং ইমরান আহমেদকে আহ্বায়ক ও আশফাক আহমেদ জামিলকে সদস্যসচিব করে ১৫৫ সদস্যের রংপুর জেলা কমিটি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সদস যসচ ব পদত য গ য গ কর সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

আম রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অলিগলিতে এখন সুমিষ্ট পাকা আমের মধুর ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাসের আনাগোনা। বাজারে ঢুকে দেখা গেল একপাশে বসে রয়েছেন রাজশাহী থেকে আসা আম ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, দাম একটু কম, কিন্তু বিক্রি বেশ ভালো। রপ্তানি বেড়েছে বলে বাজারে স্থিরতা এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হিমসাগর তো এখন ইউরোপেও যাচ্ছে!

শুধু রাজধানী নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর আর নওগাঁর কৃষকদের চোখেও এখন নতুন স্বপ্ন। কারণ, আম আর শুধুই মৌসুমি ফল নয়। এটি হয়ে উঠছে রপ্তানিযোগ্য এক সম্ভাবনার নাম। চলতি মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে নিরাপদ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বহির্বিশ্বে আম রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে এক অনন্য গতি।

রপ্তানির পালে হাওয়া
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ চার হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। জুন মাসেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ২৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ টনের বেশি আম।

শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল হক বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী আর সাতক্ষীরার গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও হিমসাগরের বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। প্যাকেজিং আর কোল্ড চেইনের উন্নয়ন হলে আরও বাড়বে এই বাজার।”

ফ্রুট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইমরান শিকদার জানান, সৌদি আরব, কাতার, জার্মানি আর ইতালিতে এবার বাংলাদেশের আমের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেশি। নিরাপদ উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে।

নিরাপদ উৎপাদনে প্রযুক্তির ছোঁয়া
রাজশাহী ও নওগাঁর প্রায় ১২০০ বাগানে এই মৌসুমে ট্রেসেবলিটি সিস্টেম ও বায়োসেফটি ব্যাগিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে কেমিকেলমুক্ত, গাছে পাকানো নিরাপদ আম উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাষি ওসমান গনি বলেন, “আগে কেমিকেল ছাড়া আম পাকানো যেত না। এখন গাছেই পাকছে, বিদেশেও যাচ্ছে। এটা গর্বের ব্যাপার।”

কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, “আম এখন আর মৌসুমি ফল নয়। এটি রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার নিরাপদ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে আম হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস।”

শত কোটি টাকার সম্ভাবনা প্রক্রিয়াজাতে
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন আম অপচয় হয়, যা দিয়ে তৈরি করা যেতো জুস, আচার, আম পিউরি বা শুকনো আমের মতো পণ্যে বিপুল আয়ের উৎস।
কারওয়ান বাজারে বসে থাকা নারী উদ্যোক্তা মিতা বেগম বলেন, “মাত্র তিন মাসেই আমি ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। যদি সারাবছর কাজ করতে পারি, আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা এই শিল্পে আসতে পারবে।”

নগরজুড়ে ছাদবাগানে বারোমাসি আম
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ নানা শহরে ছাদে গড়ে উঠছে আমবাগান। বারোমাসি জাতের আম ফলাতে ছাদে টবে বা ড্রামে গাছ লাগিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছেন অনেকেই।

আগারগাঁওয়ের সরকারি কর্মকর্তা খালিকুজ্জামান বলেন, “আমার তিনটি কাটিমন গাছে এবার ৩০ কেজি আম পেয়েছি। অসাধারণ ফলন।”

কৃষিবিদরা বলছেন, টবে নিয়মিত পরিচর্যা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে নগরেও আমের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভব।

আম অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৪.৮ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনসহ সরাসরি যুক্ত রয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ মানুষ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমের বাজার রাতারাতি বদলাবে না। তবে আমরা এখন যে কাজগুলো করছি নিরাপদ উৎপাদন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণএই তিনটি ধারা যদি একসঙ্গে এগোয়, আম হবে বাংলাদেশের গর্বের পণ্য।”

কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “নিরাপদ উৎপাদন, বৈচিত্র্যময় বাজার আর নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এই তিনে মিলেই গড়ে উঠছে ‘আম অর্থনীতি’র এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।”

তিনি বলেন, “এক সময় শুধু গ্রীষ্মের স্বাদ হিসেবে পরিচিত আম এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনার নাম। উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উচ্চতায়। যেখানে ‘আম’ মানেই কেবল রসালো ফল নয়, বরং দেশের অর্থনীতির মিষ্টি সফলতার প্রতীক।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ