ঘানি থেকে মিল: শর্ষের তেলে নমিরদের তিন প্রজন্ম
Published: 20th, May 2025 GMT
দাদা বাহার আলী শাহ চালাতেন কাঠের ঘানি। গরু দিয়ে ঘানি টেনে বিন্দু বিন্দু করে শর্ষের তেল বের করতেন। সেই তেল বিক্রি করে সংসার চালাতেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর এই পেশায় যান ছেলে মীরজান আলী শাহ। আর এখন সেই পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন মীরজানের ছেলে নমির উদ্দিন শাহ (৬৪)। রাজশাহীর বাগমারার গোপালপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি।
যুগ পাল্টেছে, বদলেছে পদ্ধতি; কিন্তু পেশার প্রতি নমির উদ্দিনের ভালোবাসা বদলায়নি। প্রযুক্তির যুগে এসে কাঠের ঘানির জায়গা নিয়েছে মেশিন, তবে পেশাটা তিনি ছাড়েননি। তাঁর মৃত্যুর পর আর কেউ নেই এই পেশায়। তাই শেষ হতে পারে তিন প্রজন্মের এই ঐতিহ্য।
নমির উদ্দিনের জন্ম গোপালপুর গ্রামে। লেখাপড়া করেননি। ছোটবেলা থেকেই ঘানিতে শর্ষে ভাঙানোর কাজ করতেন পরিবারের বড়দের সঙ্গে। ২১ বছর বয়স থেকে পুরোদমে জড়িয়ে পড়েন কাঠের ঘানির সঙ্গে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আছেন একই পেশায়।
সম্প্রতি গোপালপুর মোড়ে টিনের বেড়ায় ঘেরা ছোট্ট এক মিলঘরে একা কাজ করতে দেখা গেল নমিরকে। নিজ হাতে শর্ষে থেকে তেল ও খইল তৈরি করে প্রক্রিয়াজাত করছেন। তিনি বলেন, একসময় তাঁদের বাড়িতে চারটি গরু দিয়ে দুটি কাঠের ঘানি চলত। ওই সময়ে তাঁর মা–বাবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই কাজ করতেন। তাঁর বাবার তিন স্ত্রীর মোট ১৫ জন সন্তান ছিল। সবাই বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন ঘানি থেকে তেল তৈরিতে।
নমির উদ্দিন বলেন, ‘হাটবাজার ঘুইর্যা শর্ষে কিনা আনি, তারপর দিন-রাইত মিইল্যা ৯-১০ সের তেল বানাইতাম। সেই তেল মাথায় কইর্যা নিয়া গেছি হাটে বিক্রি করতে। শুধু আমি না, ভাইয়েরা-বোনেরাও ভাগ ভাগ হইয়া তেল বিক্রি করত।’
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরেন নমির উদ্দিন। ২০০১ সাল পর্যন্ত গরু দিয়ে কাঠের ঘানি চালিয়ে তেল বের করেছেন। পরে ঘানি বন্ধ হলেও পেশা ছাড়েননি। বিভিন্ন এলাকা থেকে তেল সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। একসময় কাজ করেন নওগাঁর আত্রাইয়ের বান্দাইখাঁড়া এলাকার একটি তেল মিলে। সেখানে মেশিনে তেল তৈরির কৌশল শেখেন। ২০১১ সালে গ্রামে ফিরে নিজের তেল ভাঙানোর মিল স্থাপন করেন। কিছু ধারদেনা করে মিল চালু করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিদিন প্রায় ১০০ কেজি তেল তৈরি করেন মিল থেকে।
নিজ হাতে শর্ষে থেকে তেল ও খইল তৈরি করে প্রক্রিয়াজাত করেন নমির উদ্দিন.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একসময়ের সর্ববৃহৎ প্রকল্প এখন ‘যশোরের দুঃখ’
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের ভবদহে শ্রী নদীর ওপর ২১ কপাট, ৯ কপাট ও ৬ কপাটের স্লুইসগেট পাকিস্তান আমলে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল। সময়ের ব্যবধানে সেই প্রকল্প দেখা দিয়েছে ‘যশোরের দুঃখ’ হয়ে।
সরেজমিনে নদী ঘুরে দেখা গেছে, ২১ গেটের ওপর ১৩টি এবং ৯ গেটের ওপর পাঁচটি মোটর পাম্প বসানো আছে। সঙ্গে আছে চারটি পাওয়ার পাম্প।
দীর্ঘদিন ধরে নদী খনন করে সে মাটি নদীর মধ্যেই রাখা হয়েছে। ফলে, নদী পরিণত হয়েছে নালাতে। ৯ গেটের সামনে দেখা যায়, নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে আছে, কোনোরকমে নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
কপালিয়া সেতুর কাছে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুট এবং গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট। মনে হয়, লাফিয়ে পার হওয়া সম্ভব।
বরণী শশ্মান ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীর গভীরতা আছে ৪ থেকে ৫ ফুট। জোয়ারের সময় প্রস্থ হয় ১০ থেকে ১২ ফুট।
রানায় পালপাড়া ব্রিজের নিচে দেখা যায়, প্রস্থ ২০ থেকে ২৫ ফুট এবং গভীরতা মাত্র ৪ থেকে ৫ ফুট।
যশোর জেলার মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর, সদর উপজেলা, খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া প্রভৃতি এলাকা মুক্তেশ্বরী-টেকা-শ্রী-হরি এবং আপারভদ্রা-হরিহর- বুড়িভদ্রা নদী দিয়ে বেষ্টিত।
যশোর শহরসহ এ অঞ্চলে বৃষ্টির পানি এসব নদী ও এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে ভাটিতে নিষ্কাশিত হয়। মুক্তেশ্বরী-টেকা-শ্রী-হরি এবং আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদীর জলপ্রবাহ কেশবপুর উপজেলার কাশিমপুরে মিলিত হয়েছে এবং মিলিত প্রবাহ ভদ্রা-তেলিগাতী-গ্যাংরাইল নামে শিপসা নদীতে পতিত হয়েছে।
মুক্তেশ্বী-টেকা-হরি ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা এবং এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোর মাধ্যমে অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর ও যশোর সদরের (অংশিক) প্রায় ৫৩টি ছোট-বড় বিলের পানি নিষ্কাশিত হয়।
সমুদ্রের নোনা পানি প্রতিরোধে এবং কৃষিযোগ্য মিঠাপানি ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকে হরি-টেকা-শ্রী নদীর অভয়নগর উপজেলার ভবদহ নামক স্থানে ২১ কপাটের স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। আশির দশক পর্যন্ত ভবদহ স্লুইসের সুফল ভালোভাবে পাওয়া যায়। সত্তরের দশকের পর থেকে এই অঞ্চলের নদীগুলোর মূল উৎস প্রবাহ পদ্মা থেকে বিছিন্ন হওয়ায় সাগরবাহিত পলি উজানের দিকের নদী ও খালের তলদেশে জমা হতে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে ভদ্রা-তেলিগাতি নদীর মাধ্যমে সাগর থেকে প্রচুর পলি বাহিত হয়ে হরি-টেকা-মুক্তেশ্বরী নদী ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদী এবং এগুলোর সংযুক্ত খালগুলোর তলদেশে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা জানিয়েছেন, বছর চারেক আগেও ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শিপসা নদী হয়ে বড় বড় মাছ ধরার ট্রলার চলাচল করতে পারত। কিন্তু, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুল সিদ্ধান্তে ভবদহের স্লুসগেট বন্ধ করে সেখানে মোটর ব্যবহার করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে, জোয়ারের সাথে আসা পলি নদীতেই থেকে যায়। এ সেচ প্রকল্পের ফলেই নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
নদীর পাশে পলি জমে থাকা স্থান দখল হতে শুরু করেছে। নদীর পাশ জুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে ছোট-বড় মাছের ঘের ও স্থাপনা। এমনকি সরকারি আবাসন প্রকল্পও করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালী বলেছেন, নানা ষড়যন্ত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ জনপদকে জিম্মি করে লাভবান হতে চেয়েছে। তবে, তা আর হতে দেওয়া হবে না।
ডুমুরতলা গ্রামের শিবপদ বিশ্বাস বলেছেন, ভবদহের জলাবদ্ধতার সমাধান হলে একটি মহলের আয়ের উৎস বন্দ হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে প্রজেক্ট নিয়ে দুর্নীতি করতে পারবে না।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেছেন, টিআরএম (নদীতে অবাধ জোয়ার–ভাটার ব্যবস্থা) ছাড়া বিকল্প কোনো উপায়ে ভবদহের জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব নয়।
ঢাকা/রফিক