নীরবে চিকিৎসার আলো ছড়াচ্ছে ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন তরী’
Published: 31st, May 2025 GMT
প্রায় দুই দশক ধরে নীরবে চিকিৎসার আলো ছড়িয়ে চলেছে ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন তরী’। দেশের বিভিন্ন নদী ঘুরে ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন তরী’ এখন গাজীপুরের কালীগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে।
কালীগঞ্জ পৌর এলাকার দড়িসোম গ্রামের খেয়াঘাট সংলগ্ন খাদ্য গুদামের সামনে স্থানীয় বাসিন্দাদের নাম মাত্র ফি-তে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে দাতব্য এই হাসপাতালটি। ইতোমধ্যে জীবন তরীর চিকিৎসা স্থানীয়দের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। স্বল্প খরচে মানসম্মত চিকিৎসা পেয়ে প্রান্তিক লোকজন সন্তুষ্ট।
হাসপাতালটি মাত্র ১২ শয্যার। এতে তিনজন চিকিৎসক নাক, কান, গলা ও চক্ষু চিকিৎসা দেন। বিশেষজ্ঞ সার্জন দিয়ে অস্ত্রোপচার এবং হাড়জোড়া, হাড়ভাঙা,পঙ্গু, জন্মগত ঠোঁটকাটা-তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসা, প্লাস্টিক সার্জারিসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংস্থাটি ১৯৯৩ সালের ২৫ জুলাই ট্রাস্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘জীবন তরী’ নামে পরিচিত বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি ভাসমান হাসপাতাল চালু করে।
দেশের প্রধান প্রধান নদীর ধারের মানুষ, যারা শহর বা নগরে খুব কমই যেতে পারে, তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের পরিচালনাধীন হাসপাতালটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নোঙর ফেলে চলতি মাসের গত ৬মে। চিকিৎসা সেবা শুরু করে ১০মে থেকে। সুচিকিৎসা প্রদান করে ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেছে। সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে। এর আগেও ভাসমান এ হাসপাতাল জীবন তরী কালীগঞ্জের শীতলক্ষ্যা পাড়ে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে দুইবার নোঙর করে স্থানীয়দের চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছে।
ভাসমান হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বলেন, মানুষ হাসপাতালে যায় চিকিৎসা নিতে কিন্তু হাসপাতাল রোগীর বাড়ির ঘাটে আসে, তা আগে দেখিনি। দেখলাম, চিকিৎসা নিলাম। সবকিছুই ভালো লেগেছে।
এই হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা করানো কালীগঞ্জ পৌর এলাকার দুর্বাটি গ্রামের নাসির উদ্দিন বলেন, “আমার ডান চোখে ছানি ছিলো। বেশ কয়েক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছি। পুরোপুরি ভালো হয়নি। কিছুদিন আগে ভাসমান হাসপাতালে চোখে অস্ত্রোপচার করিয়েছি। এখন আর চোখে সমস্যা নেই।”
শুধু তিনিই নন তার মত অনেকেই এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভাসমান হাসপাতালে প্রতিদিনই ১৬০ থেকে ১৭০ জন দরিদ্র নারী-পুরুষ ও শিশু দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন। চিকিৎসক দল যত্নের সঙ্গে তাদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। চিকিৎসা নিতে আসা এসব সুবিধাবঞ্চিত রোগী চিকিৎসকদের সেবায় মুগ্ধ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালটি ১২ শয্যার। চিকিৎসক তিনজন। এর মধ্যে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ; একজন চোখের এবং একজন অর্থোপেডিকসের। তিনজন নার্স, দুজন কর্মকর্তাসহ মোট ৩০ জন জনবল আছে হাসপাতালে। মুমূর্ষু রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য একটি স্পিডবোট ও একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে।
এখানে নিয়মিত এক্স-রে, রক্তসহ নাক-কান-গলা, চোখ অর্থোপেডিকস রোগের যাবতীয় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে।
হাসপাতালটিতে স্বল্পমূল্যে চক্ষু রোগের চিকিৎসা করা হয়। লেন্স সংযোজনের মাধ্যমে চোখের ছানি অস্ত্রোপচার করা হয়। ভাসমান হাসপাতালে ফ্যাকো সার্জারিরও ব্যবস্থা আছে। পঙ্গু রোগীদের সহায়ক সামগ্রী দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাইরের একটি ঘর থেকে রোগীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করছেন। আবার সারিতে দাঁড়িয়ে ভাসমান হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অন্য হাসপাতালের মতো এখানে স্বল্প পরিসরে সবই আছে। অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ রুম, রোগীদের শয্যাসহ অন্যান্য সুবিধা আছে।
হাসপাতালের প্রশাসক এ.
ঢাকা/এস
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
জীবিত ভাইকে 'জুলাই আন্দোলনে শহীদ' দেখিয়ে মামলা
জীবিত সোলাইমান হোসেন সেলিমকে (৫০) ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ’ দেখিয়ে মামলা করেছেন তারই বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু (৫২)। গত বছরের ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় সেই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সেলিম ফুলবাড়িয়া উপজেলার ধামর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে। তার ধামর বেলতলি বাজারে একটি মুদিদোকান রয়েছে। ‘গত বছরের ৩ আগস্ট রাজধানীর কাজলা পেট্রোল পাম্পের সামনে সেলিম গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন’—এমন অভিযোগ এনে মস্তু ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলার সাক্ষী হিসেবে তাদের দুই সহোদর হেলাল উদ্দিন (৫৫) এবং আবুল হোসেনকে (৫৪) দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানায়, প্রায় ২০ বছর আগে তাদের বাবা আব্দুল হাকিমের মৃত্যুর পর থেকেই ভাইদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। সেলিমের শুধু দুই কন্যাসন্তান থাকায় তার ভাগের সম্পত্তিতে নজর পড়ে বাকি তিন ভাইয়ের। এদিকে দুটি হত্যাসহ চারটি মামলায় জড়িয়ে আর্থিকভাবে নিঃস্ব মস্তু পূর্বপরিকল্পিতভাবে সেলিমকে নিয়ে মিথ্যা মামলা করেন।
এ বিষয়ে সেলিম বলেন, ‘মস্তু এলাকায় একজন চিহ্নিত ডাকাত এবং তিনি বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গত ১৫ বছর ধরে মস্তু বাড়িতে আসে না। বাড়িতে না এলেও বাকি দুই ভাইকে দিয়ে আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মস্তু। আমার কোনো ছেলেসন্তান না থাকায় তারা আমাকে সব সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দিতে চাপ দিচ্ছে। তাদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে আমি ধামর বেলতলি বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে বাড়ি ও দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছি। বাবার ভিটায় গেলেই ঝগড়া হয়, তাই যাওয়া হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা আমাকে মামলায় মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই হয়তো মেরেই ফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে এখন আমি সতর্ক। কিন্তু পুলিশ কীভাবে একটি মিথ্যা মামলা নিল বুঝতে পারছি না। মামলার কারণে আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে আমি বেঁচে আছি। এই পর্যন্ত পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা এবং ডিবি অফিসে গিয়েছি।’
সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন জানান, ‘সেলিমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তার তিন ভাই এই নাটক সাজিয়েছে। এর আগেও তারা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় আমার স্বামী প্রাণে বাঁচেন। এ ঘটনায় সেলিম ২০২২ সালে হেলাল উদ্দিন এবং আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেন।
সেলিমকে নিহত দেখিয়ে মামলা করার বিষয়ে তার ভাই হেলাল উদ্দিনের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি হওয়ায় প্রায় ১৫ বছর ধরে কাকা মস্তু বাড়িতে আসেন না। বর্তমানে তিনি রাজধানীতে বাস চালান। শুনেছি মামলা হয়েছে, কিন্তু বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো জানি না। আমরা এই ঘটনার জন্য দায়ী নই। মস্তু কাকা এসব করলে করতেও পারে।’
মামলার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহ জেলা শাখার সদস্য সচিব আলী হোসেন সমকালকে বলেন, আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচারের দাবি জানাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেলিমের পাশে আছে এবং প্রয়োজনে তার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে। আমাদের একটাই লক্ষ্য—কোনো মানুষ যেন মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার না হয় এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান বলেন, পারিবারিক বিরোধের কারণেই জীবিত সেলিমকে মৃত দেখিয়ে তার ভাই মামলা করেছেন।
তিনি বলেন, মস্তু এলাকায় একজন ডাকাত বলে পরিচিত। তার নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি এবং একটি মারামারির মামলা রয়েছে। শুনেছি তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে এলাকায় আসেন না। তবে সেলিমের জমিজমা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্যই হয়তো এই মামলাটি করেছে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মামলার বাদী মস্তু নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সেলিম মৃত নন, এটা নিশ্চিত করতে আদালতের মাধ্যমে দুই ভাইকে সামনা-সামনি করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আদালত অনুমতি দিলে সিআইডি ডিএনএ পরীক্ষা করবে। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। মামলাটির তদন্ত কাজ আমি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। মামলার বাদী মস্তুর বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় তিনি পলাতক।