দেশে বাইসাইকেলের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে। দুই যুগ আগে দেশের বাজার পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। সেই চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। মান ও দামের দিক থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে দেশি ব্র্যান্ডের সাইকেল। 
সাইকেল আমদানিকারক ও নির্মাতাদের সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বাইসাইকেলের স্থানীয় বাজার ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে দুই হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হচ্ছে ৪০ শতাংশ বাইসাইকেল। সাইকেলের বাজার ধরতে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড় অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। 
এসব কারখানায় উৎপাদিত সাইকেল দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি এখন আফ্রিকার দেশগুলোতেও যাচ্ছে বাংলাদেশের বাইসাইকেল। প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সাশ্রয়ী দামের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার গ্রাহকদের জন্য উচ্চমূল্যের সাইকেল তৈরি করছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্টস অ্যাসেমব্লিং অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিএমএআইএ) তথ্য মতে, শুধু ঢাকার বংশালেই দুই শতাধিক সাইকেলের দোকান রয়েছে। আর সারাদেশে এ রকম খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে চার হাজার। কারখানার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মী থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী পর্যায়ে এ খাতে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
শীর্ষ তিন দেশি ব্র্যান্ড
স্থানীয় গ্রাহকের চাহিদা 
মেটাতে দেশে বাইসাইকেল তৈরি করছে মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ১৯৯৬ সালে সরকারি সাইকেল তৈরির কারখানা কেনার মাধ্যমে প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে সাইকেল তৈরির বাজারে নাম লেখায় মেঘনা গ্রুপ। ১৯৯৯ সাল থেকে রপ্তানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল স্থানীয়ভাবে বাজারজাত শুরু করে। 
গাজীপুরে স্থাপিত বাইসাইকেল কারখানাটির বিভিন্ন বিভাগে ১০ হাজারের মতো কর্মী কাজ করছেন। কোম্পানিটি রেড, ফেরাল ও ইনিগো ব্র্যান্ড নামে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কঙ্গো, গ্যাবন ও আইভরি কোস্টে সাইকেল রপ্তানি করছে।
আকিজ ভেঞ্চার লিমিটেডের অধীনে ২০২৩ সালে চালু হয় আকিজ বাইসাইকেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড (এবিইএল)। আকিজ বাইসাইকেলের উৎপাদন কেন্দ্রটি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে। এখানে তৈরি বাইসাইকেল ১২ থেকে ২৭.

৫ ইঞ্চি উচ্চতার। রয়েছে ২৬টির বেশি মডেল ও ডিজাইন। যেমন– চ্যাম্পিয়ন, সার্ক, আলফা, ইগ্নিটোর, বন সিরিজ, হাই স্পিড এবং ট্র্যাডিশনাল বাইসাইকেল বিজয়। 
কোম্পানিটি বিভিন্ন ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশও তৈরি করছে। সাইকেলের গুণগত মান নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানটি শিমানো, নিকো, সুন্টোর, সিএসটি, প্রো হুইল, কোয়ানডো, গুলি, সুনরুন ও কেএমসির মতো বিখ্যাত অংশীদারের সঙ্গে কাজ করছে। 
আকিজ স্টিল ও অ্যালয় উভয় উপকরণেই সাইকেল তৈরি করে থাকে। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছাড়াও বিশেষায়িত মাউন্টেন বাইক (এমটিবি), সিটি বাইক ও ক্ল্যাসিক বাইকও তৈরি করছে তারা। 
কোম্পানিটির জনপ্রিয় সাইকেল মডেলের মধ্যে রয়েছে চ্যাম্পিয়ন, জেড ফুয়েল, আলফা, রকস্টার, বাটারফ্লাই, হাইস্পিড প্রভৃতি। নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষভাবে তৈরি বাইসাইকেল বাটারফ্লাই মডেল। 
২০১৪ সালে উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে বাইসাইকেলের বাজারে প্রতিযোগিতায় নামে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে স্থাপিত কারখানাটিতে ২০১৫ সালে উৎপাদন শুরু করে। ‘দুরন্ত’ ব্র্যান্ড দিয়ে তাদের এ যাত্রা শুরু। কোম্পানিটি রংপুরেও কারখানা স্থাপন করেছে। 
বছরে ১০ লাখ ইউনিট সাইকেল তৈরি করতে সক্ষম কোম্পানিটি বর্তমানে প্রতি মাসে ৮০ হাজার বাইসাইকেল তৈরি করছে। রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত সাইকেলের ৬০ ভাগই বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। কোম্পানিটি নারী-শিশুসহ সব শ্রেণির গ্রাহকের জন্যই বাইসাইকেল তৈরি করছে।
দূষণ রোধে বাইসাইকেল
শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধে বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব যান হিসেবে বাইসাইকেল জনপ্রিয় হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যগত কারণেও বাড়ছে বাইসাইকেলের ব্যবহার। যে কারণে করোনার পর বিশ্বজুড়ে বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। তবে দেশে বাইসাইকেলের ব্যবহার বাড়লেও তা প্রত্যাশানুযায়ী নয়। বিশেষ করে শহরে বাস-ট্রাকের মতো ভারী যানবাহনের পাশাপাশি মোটরসাইকেল, লেগুনা, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের বাহনের সঙ্গে একই পরিসরে সাইকেল চালানোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন চালকরা। 
শহরে সাইকেল চালানোর মতো পরিকল্পিত কোনো লেন নেই। রাজধানীর এবং রাজধানীর বাইরের জেলা শহরগুলোতে দূষণ রোধে সাইকেলের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বাইসাইকেল নির্মাতা ও পরিবেশবিদরা। নগর পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব সমকালকে বলেন, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশদূষণ রোধে সাইকেল নিয়ে পরিকল্পনা ভীষণ জরুরি। কোনো একটা লেন সাইকেলের জন্য দিলে হবে না, পূর্ণাঙ্গ ‘রুট প্ল্যান’ করতে হবে। মানুষ যেন বাসা থেকে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে সাইকেলে চলাচল করতে পারে, এটি বাস্তবায়ন করা দরকার। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইন ড স ট র জনপ র য় র জন য পর ব শ উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

দূতাবাসের কমার্শিয়াল উইংগুলো নিয়ে আলাদা সংস্থা প্রয়োজন: ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান

বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশি দূতাবাসে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমার্শিয়াল উইংগুলোকে একীভূত করে একটি স্বতন্ত্র ট্রেড প্রমোশন এজেন্সি বা বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ।

হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসে কমার্শিয়াল উইং আছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই কমার্শিয়াল উইংগুলো কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, তা নিয়ে একজন সাবেক কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে। এ কারণে অন্যান্য দেশের মতো করে এসব কমার্শিয়াল উইংসহ ইপিবিকে একটি আলাদা ট্রেড প্রমোশন এজেন্সি করা সময়ের দাবি হয়ে গেছে।’

আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন মোহাম্মদ হাসান আরিফ। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহায়তা করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য নাহিয়ান রহমান, বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালি চৌধুরী, রেনাটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ এস কায়সার কবির, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী, দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি) বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব উর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়েমা হক বিদিশা, চামড়া পণ্য, জুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি মো. নাসির খান, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহজাহান চৌধুরী ও বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সামিম আহমেদ।

ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, একজন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর চার বছর (দূতাবাসে) কাজ করে কাজ শেখেন। এরপর দেশে ফিরে উপসচিব হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ আমাদের কমার্শিয়াল উইংগুলোতে কোনো রকম কার্যকর উন্নয়ন হচ্ছে না। ফলাফলও তাই খুবই দুর্বল।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো), কোরিয়া ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি (কোট্রা) বা মালয়েশিয়া এক্সটার্নাল ট্রেড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ম্যাট্রেড) মতো বাংলাদেশেও একটি স্বতন্ত্র ট্রেড প্রমোশন এজেন্সি করার সময় হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদ হাসান আরিফ। তিনি বলেন, এই সংস্থা ইপিবি ও কমার্শিয়াল উইংগুলোকে সমন্বয় করে এবং বিদেশে অবস্থান করে শুধু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রমোশনের কাজ করবে। বেসরকারি খাতকে কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায়, সেটিও গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।

রপ্তানিবিরোধী মনোভাব দূর করতে হবে

নতুন বাজার খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ। তিনি বলেন, পণ্য বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি নতুন বাজার শনাক্ত করা এবং পণ্যের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে রপ্তানি বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার অনুসন্ধানে সরকার, ইপিবি এবং উদ্যোক্তাদের যৌথভাবে এগোতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সফর করতে হবে। যে অঞ্চলগুলোতে এখনো আমরা খুব বেশি প্রবেশ করতে পারিনি, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আসিয়ান বা দক্ষিণ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

তৈরি পোশাক পণ্য নিয়েও নতুন করে ভাবার পরামর্শ দেন ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানি কি শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউর ওপর নির্ভর থাকবে, নাকি নতুন বাজার খুঁজবে, সেটি ভাবতে হবে। হাই ভ্যালু প্রোডাক্ট ও ম্যানমেড ফাইবারের দিকে রূপান্তরের মাধ্যমেও তৈরি পোশাক খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

হাসান আরিফ বলেন, একজন ভোক্তা হিসেবে আমি চাইব দেশে ভালো মানের পণ্য কম দামে পাওয়া যাক। এর জন্য অর্থনীতিতে বিদ্যমান অ্যান্টি-এক্সপোর্ট বায়াস (রপ্তানিবিরোধী মনোভাব) দূর করা জরুরি। উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পণ্য তৈরি করতে হবে। তাতে একদিকে রপ্তানি বাড়বে, অন্যদিকে দেশীয় ভোক্তাও উপকার পাবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩০৫ কোটি টাকার জার্মান বিনিয়োগ পেল প্রাণ–আরএফএল
  • যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাগ রপ্তানি শুরু করল আরএফএল
  • দূতাবাসের কমার্শিয়াল উইংগুলো নিয়ে আলাদা সংস্থা প্রয়োজন: ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান