ঈদ মানে আনন্দ, পারিবারিক বন্ধনের এক উৎসব। উৎসবে তাই শুধু নতুন জামা-কাপড় নয়, ঘরের সাজসজ্জাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরভাবে সাজানো একটা ঘর পরিবারের সবার এবং আগত অতিথিদের ঈদ আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ঈদের উৎসবকে আরও রঙিন করতে কিছু টিপস মাথায় রাখতে পারেন। যেমন–
ঘর সাজানোর শুরুটা হোক বাইরে থেকে। আপনার ঘরের মূল দরজায় ঝুলিয়ে দিন ‘ঈদ মোবারক’ লেখা একটি ব্যানার। তার সঙ্গে রঙিন ফিতা, কাগজের লণ্ঠন বা আরবি ক্যালিগ্রাফির কিছু টুকরো যোগ করলে সৌন্দর্য বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। দরজার পাশে একটি ফুলের মালা বা পাটের বানানো শিকে ঝুলিয়ে দিলে দেখতে সুন্দর লাগবে। বারান্দা অথবা ব্যালকনিতে দিতে পারেন ছোট ঝিকিমিকি লাইট বা রঙিন পেপার লাইট। পাশাপাশি কিছু ইনডোর প্লান্ট সেট করতে পারেন অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।
বসার ঘর বা লিভিং রুমে এলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হয়। নতুন পর্দা, কুশন কভার এবং সোফা কভার দিয়ে সাজান। রুমের কর্নারে সেট করুন ইনডোর প্লান্টের বড় টব। টেবিলের ওপর রাখুন একটি ফুলদানি, তাজা ফুল, সুগন্ধি মোমবাতি অথবা টি-লাইট। দেয়ালে ‘ঈদ মোবারক’ ফেস্টুন, চাঁদ-তারকা থিমের পেপার ফ্যান কিংবা ক্রিসেন্ট মুন ও স্টার দিয়ে সাজান। পাশাপাশি স্মার্ট লাইট ব্যবহার করতে পারেন। কিছুক্ষণ পরপর আলো চেঞ্জ হলে ঈদের সন্ধ্যায় অন্যরকম একটা পার্টি ইমেজ পাবেন।
এ ছাড়া ঘরের ফ্লোরে উৎসবের আমেজ থাকাও জরুরি। বসার ঘরে বিছিয়ে দিন নতুন রঙিন কার্পেট, দরজার পাশে একটি নতুন, আনকমন পাপোশ রাখতে পারেন। ছোট শোপিস, অ্যারোমা ক্যান্ডল বা বুকশেলফে রাখুন কিছু ডেকোরেটিভ আইটেম। জানালার পাশে ইন্ডোর প্লান্ট যেমন মানি প্লান্ট বা স্নেক প্লান্ট রাখা হলে দেখতে নানন্দিক হবে।
ডাইনিং এরিয়ায় ফোকাস করুন ডাইনিং টেবিলে। সেখানে একটি টেবিল রানার, পরিষ্কার প্লেট-গ্লাস এবং মাঝে একটি ফুলদানি বা ফলের বাটি রাখুন। গোলাপজল ছিটিয়ে টেবিলে সতেজ ভাব দিন। ছোট শিশুদের তৈরি অরিগামি বা কারুশিল্প দিয়ে দেয়াল সাজান– তাদের অংশগ্রহণে বাড়বে উৎসবের আনন্দ।
শোবার ঘরে ঈদের শান্ত পরিবেশ আনতে নতুন চাদর, বালিশ কভার এবং হালকা রঙের পর্দা দিন। বেডসাইডে একটি ছোট ল্যাম্প বা সুগন্ধি ডিফিউজার রাখুন। একটি টেরাকোটা পট বা বাঁশের সাজসজ্জা ঈদ উপলক্ষে মিনিমালিস্ট পরিবেশ তৈরি করবে।
এ ছাড়া বাড়ির ছাদও একেবারে ফেলনা নয়। ছাদে ওঠার সিঁড়ির লাগোয়া দেয়ালে কিছু বড় বড় পেইন্টিং ঝুলাতে পারেন। ছাদে ছোট একটি টেবিল বা চেয়ারের ব্যবস্থা করে সেখানে তাজা ফুলের একটা বড় ফুলদানি রাখা যেতে পারে। ছাদের গাছগুলোয় পানি দিন এবং ছাদের সব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার রাখুন। ছাদবাগানের দু’একটা গাছে ঝিকমিক লাইট ঝুলিয়ে দিন। ঈদের রাতের পার্টিতে এই লাইট আপনার পুরো বাড়ির লুক বদলিয়ে দেবে।
ঈদের দিন রান্নাঘরেও কিছুটা সাজসজ্জা করুন। রান্নাঘরের এক কোণে ছোট একটি টেবিল টপার রাখুন। এর ওপর দু’তিনটি ইনডোর প্লান্ট রাখতে পারেন। যেমন মানিপ্ল্যান্ট বা স্যাকুলেন্ট। রান্নাঘরের পুরোনো পাপোশ বদলে নতুন একটি পাপোশ দিয়ে দিন। দরজায় ছোট টুনটুনি বা শখের কিছু আইটেম যোগ করলে রান্নাঘরের পরিবেশ হবে আরও আকর্ষণীয়।
ঈদে কেবল নিজের সাজসজ্জা আর খাওয়দাওয়া নয়, আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা দিয়ে সাজিয়ে তুলুন আপনার ঘরটিকেও। একটা সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো ঘরে স্বাভাবিকভাবেই ঈদের যে আনন্দ পাবেন, অন্য কোথাও তা পাবেন না! কাজেই লেগে যান ঈদ উপলক্ষে আপনার ঘরকে ডিফারেন্ট এক লুক দিতে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ন ন ঘর স জসজ জ আনন দ আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
গাজাবাসীর ঈদ: ‘কোরবানি দেওয়ার মতো কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া’
গত ঈদের আগে আল-জাজিরা একটি ভিডিও প্রচার করে। সেখানে দেখা যায়, গাজার এক মা তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়ের কবরের পাশে বসে আছেন। মেয়েটি মারা গেছে ঈদের তিন দিন আগে এক বিমান হামলায়। মা তার জন্য যে লাল জামাটি কিনেছিলেন, সেটিই কবরের মাটির ওপর রেখে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঈদে ওকে এটা পরিয়ে দিতাম। এখন ওর কবরের ওপর রেখে গেলাম। জামাটা ওর সঙ্গে যেন থাকে।’
লাখো মুসলমান যখন ঈদুল আজহার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের গাজা এক মরুভূমির নিস্তব্ধতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে ঈদ নেই। আছে কেবল খালিপেটে দীর্ঘশ্বাস, ধ্বংসস্তূপে শিশুদের কান্না আর আশাহীন এক অপেক্ষা। একটু যদি কেউ রাজি হন নিজের আনন্দের মধে৵ ভাবতে, তাহলে মনে আসবেই—এই ঈদের উৎসব কি কেবল তাঁদের জন্য, যাঁদের ঘরবাড়ি আছে, রান্নাঘরে খাবার আছে; আর আছে নতুন জামার আনন্দে হাসতে জানা শিশু?
রাফা, খান ইউনিস ও গাজার শহর—সবখানেই মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। ঈদের নামাজ পড়া হয় খোলা মাঠে, কখনো কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পাশে। বহু জায়গায় কোনো জামাতই হয় না। কারণ, নেই নিরাপদ জায়গা, নেই ইমাম, নেই মাইক্রোফোন।
নামাজের পরপরই কেউ কেউ কবর জিয়ারত করেন। কেউ আবার চোখের জলে হারানো স্বজনকে স্মরণ করেন। ২০২৪ সালের ঈদের দিনেও থামেনি বোমা হামলা। গাজার আল-মাঘাজি ক্যাম্পে চালানো হয় বিমান হামলা। এতে অন্তত ১১ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে সাতজনই শিশু। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন যাঁরা, তাঁরা নতুন করে কবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
‘কোরবানি দেওয়ার মতো আর কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া।’ কথাটি বলছিলেন নুহা আল নাজ্জার, গাজার এক মা। তাঁর পরিবারের ঈদ মানে প্রতিদিনের ক্ষুধা, বোমাবর্ষণের আওয়াজ আর শিশুদের কান্না। দুই বছরের আলমা দিনভর কাঁদছে শুধু এক বোতল দুধের জন্য। মাসের পর মাস একফোঁটা দুধ মেলেনি। একসময়ের ঈদ এখানে ছিল কাবাব, কিশোর-কিশোরীদের হাসি আর আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। এখন সেখানে কেবল ধ্বংসস্তূপ, ক্ষুধার্ত শরীর আর আতঙ্কে ভয়ে কাঁপতে থাকা মুখ।
রাফা সীমান্ত দিয়ে কিছু সাহায্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করছিল গত ঈদের সময়। খাবারের জন্য হাহাকার এত তীব্র ছিল যে মানুষ একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ে খাদ্যের গাড়িতে। চ্যানেল ফোর নিউজ জানায়, গমবাহী একটি ট্রাকে ধাক্কাধাক্কির ফলে ১২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজন ছিল শিশু।
গাজার ঈদ আর আমাদের ঈদ এক নয়। আমাদের জন্য এই পার্থক্য শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়, নৈতিকতারও। আমাদের ঈদের আনন্দের সামনে গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখগুলো যেন অদৃশ্য আয়না হয়ে ওঠে। যারা বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে, তাদের গল্পে ঈদ মানে এক নামহীন প্রার্থনা। এই প্রার্থনা শুধু গাজার নয়, আমাদের সবার হোক।নুহা বলেন, ‘আমি এক দিনে একটি শসা আর দুটি টমেটো কিনে তা ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করি। সেটিই আমাদের দিনের একমাত্র খাবার।’ তাঁর এ কথায় কেউ ঈদের কোনো আমেজ পাবেন? না, এখানে আছে শুধু টিকে থাকার যুদ্ধ। ‘আমার একমাত্র ছোট ছেলেকে মিসরে পাঠানো হয়েছে চিকিৎসার জন্য। সে আমাকে ফোনে বলে, ‘মা, আমি সেই পুরোনো ঈদগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চাই।’ আমি ওর কথা শুনে কাঁদি না। নিজের মুখ চাপা দিয়ে রাখি। যাতে ও না বুঝতে পারে আমি কতটা ভেঙে পড়েছি।’
নুহার ছোট মেয়ে মায়ার বয়স ১২। একসময় ঈদে তার আনন্দ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন সে চুপচাপ থাকে। ‘আমি জিজ্ঞাসা করি—কী রে, খিদে পেয়েছে? ও বলে, না। কিন্তু আমি জানি, ওর পেট খালি। ও জানে, ঘরে কিছু নেই। তাই অভিযোগ করে না।’
ঈদ মানেই শুধু এই দোয়া—আজ যেন কেউ ইসরায়েলিদের গুলি বা বোমায় মারা না যায়। ঘরবাড়ি নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। ঈদের নতুন জামার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু আছে এক বেলা কোনোভাবে বাঁচার খাবার খুঁজে পাওয়া; আর পরের বোমা কখন কোথায় পড়বে, সেই অপেক্ষা।
গাজার বাইরে থাকা মানুষেরাও সুখে নেই। নুহার বোন সামার এলউফ। ওরা এখন দোহায় আশ্রয়ে আছেন। তিনি একজন খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিক। একসময় গাজার ঈদ উদ্যাপনের ছবি তুলতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওর ডাক পড়ত। আজ তাঁর ক্যামেরা কেবল শিশুদের মৃতদেহের ছবি তুলে রাখে। ‘প্রতিটা ছবি যেন আমার বুকে ছুরি চালায়’ বলেন সামার।
সামার বলেন, ‘আমি কিছুই করতে পারি না। কেবল চোখের পানি ফেলি আর বারবার খোঁজ নিই—আমার বোন, ওর সন্তানেরা এখনো বেঁচে আছে তো?’
তার পরও এই পরিবারের সদস্যরা ভালোবাসা আর স্মৃতিতে টিকে আছেন। ‘ঈদ এখন আমাদের হৃদয়ে একটি ক্ষত। সুখের স্মৃতি দুঃখের চেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। তবু আমরা বিশ্বাস হারাই না। কারণ, ঘরে ফেরার স্বপ্ন আমরা এখনো দেখি’ বলেন নুহা।
অন্যদিকে পরিবার ছাড়া তৃতীয় ঈদ কাটাচ্ছেন লেখক শাদি সালেম। তিনি লিখেছেন, ‘গাজার ঈদ এখন আর উৎসব নয়, এটি প্রতিরোধের প্রতীক। ঈদ মানে শুধু একাকিত্ব নয়, এটি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার আর্তি।’
শাদি সালেমের মা ফোনে বলেন, ‘আমরা যতটা পারি, ততটাই করি। আমি আজ যাব আমার ভাইদের শহীদ পরিবারের কাছে, ঈদের শুভেচ্ছা দিতে।’ এই একটি বাক্য যেন গাজার হাজারো মায়ের মনের দৃঢ়তার কথা বলে।
‘আমরা চাই না কেউ আমাদের মতো কষ্টে থাকুক। সবাই যেন সুখে থাকে, শান্তিতে থাকে। শুধু দোয়া করি, সারা পৃথিবীর আর কেউ যেন এই বেদনার ভাগীদার না হয়।’ শেষে এই কথাটা বলছিলেন নুহা। কথাটায় কি অভিমান মিশে ছিল?
গাজার ঈদ আর আমাদের ঈদ এক নয়। আমাদের জন্য এই পার্থক্য শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়, নৈতিকতারও। আমাদের ঈদের আনন্দের সামনে গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখগুলো যেন অদৃশ্য আয়না হয়ে ওঠে। যারা বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে, তাদের গল্পে ঈদ মানে এক নামহীন প্রার্থনা। এই প্রার্থনা শুধু গাজার নয়, আমাদের সবার হোক।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
(আলজাজিরা, আরব নিউজ, ডন, হিন্দুস্তান টাইমসের বিভিন্ন লেখা অবলম্বনে)