ইসলাম শুধু প্রার্থনার ধর্ম নয়, উৎসবেরও ধর্ম। ইসলাম ধর্মানুসারীরা বছরে দুটি ঈদ পালন করেন। এই দুটি ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। উৎসব হলেও দুই ঈদের সঙ্গে প্রার্থনার অনুষঙ্গও থাকে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা– দুটি ঈদেই নামাজ হয়। এ নামাজ আদায় করতে হয় জামাতে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে। ঈদের জামাত এমন একটি অনুষ্ঠান, যেটি গরিব-ধনী সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।
ঈদের জামাতে নতুন কাপড়, পারতপক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে অংশগ্রহণ করতে হয়। আতর-সুগন্ধি মাখাও কাম্য। এক কথায় বলা যায়, পূত-পবিত্র হয়ে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে হয়। জামাত শেষে মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটায়। মসজিদ হোক অথবা ঈদগাহ, সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র পরিবেশে নামাজ আদায় করা হয়। এভাবে ঈদ হয়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত আনন্দ উৎসব, যা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মধ্য দিয়ে ঐহিক ও পারলৌকিক পরিত্রাণ অর্জনে সমুজ্জ্বল।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে হৃদয়কে স্পর্শ করে। ঈদুল ফিতর পালিত হয় রমজানের শেষে। এই ঈদ আসে আত্মসংযমের পর আনন্দের উৎসব হিসেবে। ঈদুল আজহা ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের উৎসব। ঈদুল আজহার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এর সূচনা হয়েছিল হজরত ইব্রাহিমের (আ.
ঈদুল আজহার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ব মুসলমানের আরেকটি বড় উৎসব জড়িয়ে আছে। উৎসবটি হলো বার্ষিক হজ পালন। হজ একাধারে বিশ্ব মুসলিমের মিলন উৎসব, অন্যদিকে এটি আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ারও উৎসব। হজ পালনকারীরা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি উচ্চারণ করে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হন। হজরত ইব্রাহিমের স্বহস্তে নির্মিত কাবাঘর হজ উৎসবের মূল কেন্দ্র। হজের সময় প্রত্যেক হাজিকে কোরবানি করতে হয়। হজের সময় সেলাইবিহীন বিশেষ কাপড় পরিধানের বিধান রয়েছে। সবাই এক ধরনের কাপড় পরে। যার ফলে ধনদৌলতের পার্থক্য ঘুচে যায়।
আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রতিবছর ঈদুল আজহার উৎসবে শামিল হয়েছি পরম আনন্দের সঙ্গে। শৈশব ও কৈশোরে যখন পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম তখন কোরবানির দায়িত্ব পালন করতেন পিতা। আমরা ভাইবোন কোরবানি করা পশুর গোশত তৃপ্তিভরে খেয়েছি। কোরবানির সময়ে একটি পরম উৎসাহের কাজ হলো, কোরবানির পশু ক্রয় করা। আমার পিতা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ভাগে কোরবানি দিতেন। বেশির ভাগ সময় গরু কোরবানি করা হতো। এই কোরবানির অংশীদাররা একত্র হয়ে পশুর হাটে যেতেন কোরবানির গরু কেনার জন্য। আমার বয়স যখন ১০ বা তার কাছাকাছি, সেই সময় থেকে আব্বার সঙ্গে হাটে গিয়েছি গরু কেনার জন্য।
আমার শৈশবে পিতা ছিলেন থানা পর্যায়ে শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তখন পশুর হাট বসত ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে। এখনকার মতো তখন প্রশাসনিক থানাগুলো পৌরসভায় পরিণত হয়নি। পশুর হাট বসানোকে কেন্দ্র করে টেন্ডারবাজিও হতো না। তখনও রুগ্ণ ও সুস্থ পশু আলাদা করে দেখার বাস্তব ব্যবস্থা ছিল না। অবশ্য থানা পর্যায়ে ভেটেরিনারি অফিসার ছিলেন। এই অফিসারকে সক্রিয় হতে দেখিনি। লোকজন বাহ্যিকভাবে পশুর দেহ পরীক্ষা করে কোরবানির পশু কিনত। কোনো কোনো বছরে আব্বা খাসি কোরবানি দিতেন। সেই সময় কোরবানির পশু জবাই করতেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তিনি এ জন্য কোনো হাদিয়া নিতেন কিনা, মনে করতে পারি না।
কোরবানির আগে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছি মসজিদে। আমার আব্বার চাকরিজীবনের প্রথমদিককার সাত বছর কেটেছিল চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানায়। হাজীগঞ্জের বড় মসজিদটি খুবই বিখ্যাত। আজও সেই মসজিদ সগৌরবে বিদ্যমান। আব্বার হাত ধরে মসজিদে যেতাম এবং বেশির ভাগ সময় প্রথম কাতারেই বসতাম। জামাতে যোগ দেওয়ার জন্য আব্বা নতুন কাপড় কিনে দিতেন।
কোরবানি হয়ে গেলে গোশত ভাগাভাগি করা হতো। এ সময়ে কৌতূহলবশত কোরবানির পশু প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে দেখার জন্য উপস্থিত থাকতাম। গোশত বাসায় নিয়ে আসার পর তা থেকে আলাদা করা হতো গরিব মানুষের অংশ। সেই সময় দেশের অধিকাংশ মানুষ খুবই গরিব ছিল। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর জীবন নির্বাহ করত। কোরবানির দিন তারা গোশতের জন্য বাসার সামনে ভিড় করত। এদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, প্রত্যেককে এক-দুই টুকরোর বেশি গোশত দেওয়া যেত না। পারিবারিক জীবনে এসে নিজেই কোরবানি দিতে শুরু করেছি। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। যতদিন শারীরিকভাবে পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম ততদিন নিজেই কোরবানির হাটে গিয়েছি গরু কেনার জন্য। আমার সঙ্গে প্রায় প্রতিবছরের অংশীদার ছিল আমার ছোট ভাই মাহফুজ উল্লাহ। আজ সে বেঁচে নেই। তাই আর একসঙ্গে কোরবানি করা হয় না। মনে বড় কষ্ট পাই।
দেশের জনসংখ্যা আমার ছোটবেলার তুলনায় অন্তত চার গুণ হয়েছে। সেই তুলনায় দারিদ্র্যের হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। গরিবের হক কোরবানির গোশত বিতরণ করার জন্য আগের মতো ভিক্ষুকরা ভিড় করে না। অবশ্য কিছু ভিক্ষুক এখনও বিদ্যমান, তবে ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষা করার রেওয়াজ প্রায় উঠে গেছে। গরিবদের নামে কোরবানির গোশত বিতরণ করতে হলে কে হকদার, তা খুঁজতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিন্তু ভিক্ষুক নয়, এমন লোকদের মধ্যেই কোরবানির গোশত বিতরণ করি। এদের মধ্যে অধস্তন কর্মচারীরাও রয়েছে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে থাকার সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে কোরবানি করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিবারের বাকি সদস্যরা দেশে কোরবানি করেছে। বিদেশে কোরবানি করতে না পারলেও দেশি বন্ধুদের নিয়ে ঈদুল আজহার নামাজ ইসলামিক সেন্টারে আদায় করেছি। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। বন্ধুবান্ধব দ্বারা নানা রকম মিষ্টান্নে আপ্যায়িত হয়েছি।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা– ঈদ দুটি বহু বছর ধরে ঢাকায় পালন করছি। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় সেখানে ঈদ করেছি। ঈদের সময় ঢাকা থেকে নাড়ির টানে লাখ লাখ মানুষ গ্রামমুখী হয়। ঈদযাত্রায় প্রচণ্ড বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। যাত্রীদের দ্বিগুণ-তিন গুণ বাস ভাড়া গুনতে হয়। রেলে টিকিট কিনতে হয় কালোবাজারে। নানা চেষ্টা করেও এই অনিয়ম রোধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই হয়ে লঞ্চগুলো যাত্রা করে বিপজ্জনকভাবে। তবে গত ঈদুল ফিতরের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় ঈদযাত্রীরা পরিকল্পনা করে যাতায়াত করেছেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড় ও হয়রানি হয়নি বললেই চলে। এবারের ঈদুল আজহার ছুটিও বেশ দীর্ঘ। আশা করি, সবাই সহি-সালামতে এই ঈদের সময় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারবেন। আল্লাহর কাছে সবার শান্তি ও আনন্দ কামনা করছি। আশা
করি, আমরা সবাই ঈদুল আজহার ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবো।
মাহবুব উল্লাহ্: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঈদ ল আজহ র ক রব ন র গ ই ক রব ন গ শত ব র গ শত আল ল হ র জন য মসজ দ আনন দ র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
ভালো ফলনের আশায় গাছকে খাওয়ান তাঁরা
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি প্রদেশ গুইঝৌতে প্রাচীনকাল থেকে ‘গেলাও’ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ভিয়েতনামেও এই জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। চীনে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৭৭ হাজার।
কৃষিনির্ভর গেলাও জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আজও প্রাচীনকালের পুরোনো এক ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন। বছরের নির্দিষ্ট দিনে তাঁরা গাছকে খাওয়ান, যা চীনা ভাষায় ‘ওয়েই শু’ রীতি নামে পরিচিত।
এই প্রাচীন রীতি মূলত একধরনের প্রার্থনা। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, এতে প্রকৃতি তুষ্ট হয়, ফসল ভালো হয়, পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে। প্রতিবছর দুটি উৎসবের সময় এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়—চীনা নববর্ষে, যা বসন্ত উৎসব নামে পরিচিত। আর গেলাও নববর্ষে, যা চান্দ্র পঞ্জিকার তৃতীয় মাসের তৃতীয় দিনে পালিত হয়।
অনুষ্ঠানের দিন সকালে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী পাহাড়ের ঢালে জড়ো হন। তাঁরা সঙ্গে করে চাল থেকে তৈরি মদ, শূকরের মাংস, মাছ ও লাল আঠালো চাল নিয়ে আসেন। পাহাড়ে পৌঁছে প্রথমে আতশবাজি পোড়ানো হয়। এতে করে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এর মধ্যেই একটি পুরোনো ও শক্তিশালী গাছ বাছাই করা হয়। এরপর সবাই ধূপ জ্বালিয়ে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন। সবশেষে মূল পর্ব ‘গাছকে খাওয়ানো’ শুরু হয়।
একজন কুঠার বা ছুরি দিয়ে গাছে তিনটি জায়গায় ছোট করে কেটে দেন। সেই ক্ষতস্থানে চাল, মাংস ও মদ ঢেলে দেওয়া হয়, যাতে গাছ তাঁদের দেওয়া ভোগ গ্রহণ করতে পারে। পরে ওই জায়গা লাল কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া গাছের গোড়া ঘিরে আগাছা পরিষ্কার করা হয়, মাটি আলগা করে দেওয়া হয়। এতে নতুন জীবনের বার্তা মেলে বলে মনে করেন গেলাও জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।
যে গাছকে খাওয়ানো হয়, সেটি যদি ফলদ হয়, তাহলে ভোগ দানকারীরা একটি আশাব্যঞ্জক শ্লোক উচ্চারণ করেন। বলেন, ‘তোমায় চাল খাওয়াই, ফল দিয়ো গুচ্ছ গুচ্ছ; তোমায় মাংস খাওয়াই, ফল দিয়ো দলা দলা।’