ক্রিকেট ভালোবাসলে বুঝি ফুটবলকে ভালোবাসা যায় না!
Published: 5th, June 2025 GMT
শূন্য আকাশে তারা খোঁজার ক্লান্তি ছিল বহুকাল। অদূরদর্শীতার কারণে ছিল শুধুই আত্মবিস্মৃতিও। সেখানে ফুটবলের সেই অভিমানের আকাশেই হঠাৎ হামজা, ফাহমিদুল, শমিতদের আগমন। অতীত দৃষ্টান্তে নাড়া দেওয়া মন যেমন চাইছিল শুধু মান রাখার বর্তমানে, তা পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবলের নতুন আকাশ। রাত জেগে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখা চোখ হামজাদের নতুন বাংলাদেশে দেখেছে সেই গতি, সেই ছন্দ, সেই শৈলী। যে ফুটবলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ক্রীড়াপ্রেমীরা এখনা তারাই বুদ লাল–সবুজের ফুটবল নিয়ে। কিন্তু এখানেই একটা চোরা বিভক্তি সর্বজনীন গৌরবের জায়গাটাতে ধাক্কা দিচ্ছে।
যাদের ফেসবুকের দেওয়ালে সারা বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট থাকে, তারা কেন এখন হামজাদের ফুটবল নিয়ে প্রশংসা করবেন? তাদের কি সেই অধিকার আছে? ক্রিকেট মাঠের যে সমর্থককে মুখে বাঘের রঙ মেখে মিরপুরের গ্যালারিতে দেখা যায়, সে কেন আবার জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গলা ফাটাবেন? লিটন দাস বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়ে কেন হামজাদের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ফেস বুকে স্ট্যাটাস দেবেন?
ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে ভালোবাসার এই ভাগাভাগি নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্ম দিচ্ছে। যেখানে একদল শুধুই ফুটবল হলে অন্য দল অবশ্যই ক্রিকেট! কিন্তু যেখানে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল দুই দলই যখন লাল-সবুজের হয়ে খেলতে নামে, বুকে হাত রেখে জাতীয় সঙ্গীত গায় সেখানে দুই খেলাকেই এক সঙ্গে ভালোবাসলে কী ক্ষতি কে জানে।
তবে এটা সত্য যে ফুটবলের এই মধু মৌসুমে মৌমাছির আনাগোনা বেড়েছে। যে ক্রীড়া সাংবাদিককে বছরের পর বছর ফুটবলের সঙ্গে থেকে খেলার পাতায় সিঙ্গেল কলাম পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়েছে, তাকেই এখন তিনটির বেশি রিপোর্ট পাঠাতে হয়। খোঁজ নিতে হয় হামজার হবিগঞ্জের গ্রামের। এই ব্যস্ততা তার আনন্দের। সংবাদ সম্মেলনে তাই চেয়ার না পেয়ে মাটিতে বসে থাকতেও তার আপত্তি নেই।
এটাও অস্বিকার করার উপায় নেই যে, নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট যখন খেলার পাতার বেশির ভাগ জায়গা দখল করতে থাকে তখন থেকেই একটা অবহেলাও বুঝি ছিল ফুটবলের প্রতি। তা নিয়ে নিজেদের অজান্তেই একটা আত্মম্ভরী ভাব এসে গেছে কিছু ক্রিকেট লিখিয়ের মধ্যেও। অনেকেই ধরেই নিয়েছে ক্রিকেট দলের হার জিতের মধ্যেই তারও সাফল্য-ব্যার্থতা জড়িয়ে!
ওই সময়টাতে ক্রিকেটের জেট গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কারণ যেমন ছিল তেমনি ক্লাব ফুটবলে ভাটার টানও ছিল। অঢেল অর্থে তখন অনেক প্রভাবশালী ক্লাবের সভাপতি পদ কিনে নিয়েছেন। আবাহনী-মোহামেডানের মতো সমর্থক গোষ্ঠিদের ক্লাব সেই সব হঠাৎ ‘বড় লোক’ হয়ে ওঠা ক্লাবের কাছে হেরে গেছে। সেই তারাই ক্রিকেটে এসেছিল জোয়ারের টানে। ক্রিকেটে এখন জাতীয় দল খারাপ সময় পার করছে, সমর্থকরাও ব্যথিত তা নিয়ে। ‘ক্রিকেটের দিন শেষ’- বলছেন তারা অভিমানে। তবে এটাও মানতে হবে যে ফুটবলে এখন যে জোয়ার এসেছে তা কেবলই জাতীয় দল কেন্দ্রীক। এর স্থায়িত্ব নির্ভর করছে ক্লাব ফুটবলের জনপ্রিয়তার ওপরই।
এক সময়ের রক্সি, সাব্বির, মুন্না, রুমি, আসলামরা জনপ্রিয় হয়েছিলেন ক্লাব ফুটবল খেলেই। হামজার আজ যে বৈশ্বিক পরিচিত তাও কিন্তু তার ক্লাব লেস্টার সিটি দিয়েই। বছরে জাতীয় দলের হয়ে পাঁচ-ছয়টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তারকারা। সেখানে ক্রিকেটে জাতীয় দলের খেলা থাকে অন্তত পনেরো থেকে কুড়িটা। এদিক থেকে ফুটবলের চেয়ে নিশ্চিত অ্যাডভান্টেজ ক্রিকেটের। তাহলে কী জাতীয় দলের ক’টি ম্যাচ ঘিরেই শুধু জোয়ার চলবে দেশীয় ফুটবলে?
এভাবে ভাবলে আবার রাগ, দুঃখ, অভিমান শেষে হতাশা বাসা বাধতে পারে। ফুটবলের প্রতি টান কখনোই কমেনি বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের। যদি তাই হতো তাহলে মেসি-রোনালদোকে নিয়ে তর্ক করে একটি প্রজন্ম বুড়ো হয়ে যেতো না, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সঙ্গে নিজেদের আবেগে জড়িয়ে পরতো না। আসলে ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে, যে কোন ধরনের খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসার টান থেকেই তৈরি হয় কৃষ্টি। তাই ভালোবাসায় দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি না ঢেলে তা চাপা দিয়ে রাখায় শ্রেয়।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ল দ শ ফ টবল জ ত য় দল ফ টবল র
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’