অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতি সারা বিশ্বেই ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু এ মডেল এখনো বাংলাদেশের বেসরকারি খাতকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারছে না। হাতে গোনা যে কয়েকটি প্রকল্প আলোর মুখ দেখেছে, সেগুলো হচ্ছে মূলত সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) পর্যায়ের সিদ্ধান্তে। ফলে প্রকৃত পিপিপির স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত রয়েছে বাংলাদেশ। চার-পাঁচটি প্রকল্প হতে চললেও এগুলোর বেসরকারি অংশীদারদের প্রায় সবাই বিদেশি।

পিপিপি মানেই হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের বিষয়। সরকারি ভাষ্য হচ্ছে, দেশের বড় পুঁজির মালিক বা বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ব্যাপারে ধৈর্য কম। এদিকে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ হচ্ছে, সরকার নিজেই একটা সমস্যা। কারণ, সরকার এমন কোনো নীতি পদক্ষেপ নিয়ে রাখেনি, যাতে বিনিয়োগকারীরা পিপিপি প্রকল্পে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন।

এমন টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পিপিপির জন্য ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। ২ জুন তিনি এই বাজেট ঘোষণা করেন। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

অর্থ উপদেষ্টা এবারের বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। বিনিয়োগকারীদের দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে ওয়ান–স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টাল চালু করেছে। এই পোর্টালে ৪৩টি সংস্থার ১৩৪টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় চালু করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ (বিএসডব্লিউ)’। এর মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফর্মে আবেদন গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবা প্রদান করা যাচ্ছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন’ তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রতিশ্রুত বিনিয়োগগুলোকে কার্যকর বিনিয়োগে পরিণত করার প্রক্রিয়া সহজ হবে।

পিপিপির সার্বিক বিষয় দেখভালের জন্য ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পিপিপি কর্তৃপক্ষ গঠন করে। পিপিপি কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম বছর ৩৪টি ও পরেরবার ৪০টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হলেও বর্তমানে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য বর্তমানে ৮১টি প্রকল্পের একটি তালিকা তৈরি রয়েছে পিপিপি কর্তৃপক্ষের হাতে।

মুনাফার সুযোগ না থাকলে তো বেসরকারি খাত আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর দেশে তো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগই নেই। গ্রিন ফিল্ড কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণ দেয় পাঁচ বছরের জন্য। পিপিপির পর্ষদে নেই বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব। বললেই তো পিপিপিতে বিনিয়োগ আসবে নাআবুল কাসেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার।

এর মধ্যে ২০টি আছে শনাক্তকরণ পর্যায়ে, যেগুলো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। আর উন্নয়ন পর্যায়ে আছে ২৯টি। এ পর্যায়ে থাকার অর্থই হচ্ছে এদের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে মাত্র। ১৪টি প্রকল্প আছে দরপত্র ডাকার পর্যায়ে অর্থাৎ চুক্তির কাগজপত্র তৈরি হয়ে আছে। আর ১৮টি রয়েছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে।

পিপিপি হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারি ব্যবস্থা, যেখানে জনগণকে সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করে থাকে। এতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের চুক্তি হয় বা সেবা তৈরির জন্য বেসরকারি খাতকে সরকার নিবন্ধন দিয়ে থাকে। নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওওটি); নির্মাণ, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওটি) এবং নির্মাণ, মালিকানা ও পরিচালনা (বিওও)—পিপিপির এই তিন পদ্ধতিই প্রচলিত।

জানতে চাইলে পিপিপি কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মো.

আলী আজম আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিপিপির মাধ্যমে চিকিৎসাসহ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া পড়ার বাস্তবতা আছে দেশে। কিন্তু বিষয়টি নতুন হওয়ায় একটু গতি কম। নীতিনির্ধারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এ কারণে গতি বাড়ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হওয়ায় দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পিপিপির ব্যাপারে আগ্রহের ঘাটতি আছে।’ আলী আজম আল আজাদ অবশ্য বিশ্বাস করেন, এ খাতে বিনিয়োগ ভবিষ্যতে বাড়বেই।

এ এম এ মুহিতের যে উদ্যোগ

তুরস্ক, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশে সাফল্যের উদাহরণ সামনে রেখে ২০০৯ সালে অবকাঠামো উন্নয়নে পিপিপির দিকে নজর দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

পিপিপির মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো খাতের ব্যাপক উন্নয়ন হবে, এমন আশাই করেছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার ৬ মাসের মাথায় যখন ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হলো, তখন ‘নব উদ্যোগ বিনিয়োগ প্রয়াস’ নাম দিয়ে আবদুল মুহিত পিপিপির জন্য বরাদ্দ রাখেন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

বিপুল জনগোষ্ঠীর এ দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; নদী, সমুদ্র ও বিমানবন্দর; সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল; সড়ক ও রেলপথ এবং বড় বড় সেতু নির্মাণ দরকার। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে এগুলো করা কঠিন। তখন এসব কথাই বলেছিলেন আবদুল মুহিত।

শুধু কথা বলেই অবশ্য দায়িত্ব সারেননি মুহিত। ১০ বছর ধরে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিনিয়োগ আকর্ষণে পিপিপি আইন, নীতিমালা, বিধিমালা সবই করেছেন। প্রতি অর্থবছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও করতেন। কিন্তু বেসরকারি খাতের অনাগ্রহের কারণে এ খাতের জন্য বরাদ্দ করা পুরো টাকাই পড়ে থাকত। তবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) জন্য প্রতিবারই অবশ্য সামান্য অর্থ খরচ হতো, এই যা।

পিপিপির মাধ্যমে চিকিৎসাসহ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া পড়ার বাস্তবতা আছে দেশে। কিন্তু বিষয়টি নতুন হওয়ায় একটু গতি কম। নীতিনির্ধারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এ কারণে গতি বাড়ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হওয়ায় দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পিপিপির ব্যাপারে আগ্রহের ঘাটতি আছেমো. আলী আজম আল আজাদ, মুখপাত্র, পিপিপি কর্তৃপক্ষ।

যেসব প্রকল্প হচ্ছে

বর্তমানে বাস্তবায়ন পর্যায়ে থাকা পিপিপি প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর। প্রকল্পটির আংশিক উদ্বোধন হলেও এখনো কাজ বাকি আছে। ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড হচ্ছে এ প্রকল্পের বেসরকারি বিনিয়োগকারী।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। জিটুজি পর্যায়ে এটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ২১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ দেবে ঋণদাতা সংস্থা জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। কাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা করপোরেশন এবং কোরিয়ার স্যামসাংয়ের জয়েন্ট ভেঞ্চার ‘অ্যাভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম’।

হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য চীনের নির্মাণপ্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিসিএল) সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে।

ঢাকা বাইপাস প্রকল্পের কাজও হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরকে বাইপাস করে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে সরাসরি যুক্ত করার জন্য নির্মিত হচ্ছে এটি। প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। চীনের সিচুয়েন রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ করপোরেশন লিমিটেড, বাংলাদেশের শামীম এন্টারপ্রাইজ এবং ইউডিই কনস্ট্রাকশন লিমিটেড হচ্ছে এটির যৌথ অংশীদার। কিছু অংশ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ এম এ মুহিত যখন ২০০৯ সালে বিষয়টি নিয়ে এলেন, আমি তখন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। তাঁকে খুবই সমর্থন করেছিলাম। সৈয়দ আফসর এইচ উদ্দিন ছিলেন পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রথম প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি আমাকে একপর্যায়ে বললেন, ভালো প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি), অগুরুত্বপূর্ণগুলো পাঠিয়ে দেয় পিপিপিতে। এভাবে তো পিপিপি হবে না।’

আবুল কাসেম খান আরও বলেন, মুনাফার সুযোগ না থাকলে তো বেসরকারি খাত আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর দেশে তো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগই নেই। গ্রিন ফিল্ড কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণ দেয় পাঁচ বছরের জন্য। এদিকে পিপিপির পর্ষদে নেই বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব। বললেই তো পিপিপিতে বিনিয়োগ আসবে না, আগে নীতি সমস্যা দূর করতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র র জন য ব র র জন য ব সরক র অবক ঠ ম পর য য় বর দ দ বছর র হওয় য়

এছাড়াও পড়ুন:

৫ বছরে ঋণের স্থিতি বাড়বে ৫৩.৭৭ শতাংশ: অর্থবিভাগ

পাঁচ বছরে দেশের ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়াবে ৫৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বেড়ে হবে ৫৬ দশমিক ৬ ০ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পাবে ৫০ শতাংশ। অর্থ বিভাগের করা সাম্প্রতিক এক প্রক্ষেপণে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। 

প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ঋণের স্থিতি ছিল আঠারো লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সেখানে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ঋণের এই স্থিতি বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই হিসেবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ঋণের স্থিতি টাকার অঙ্কে বৃদ্ধি পাবে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

গত ২ জুন অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি ২০২৫-২০২৬ হতে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ২০১৪-২০১৫ হতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ জিডিপি’র অনুপাত ধারবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসময় ঋণ জিডিপি’র অনুপাত ১৫.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১.৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

অন্যদিকে, বৈদেশিক ঋণ জিডিপি’র অনুপাত ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের ১১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। 

পূর্বাভাষ অনুযায়ী, ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এটি জিডিপি’র ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ হবে। যদিও বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি’র অনুপাত বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত নিরাপদ সীমার মধ্যে রয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক শৃঙ্খলা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এক্ষেত্রে নিবিড় মনিটরিং ও সময়োপযোগী সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। 

একটি স্থিতিশীল এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি নিশ্চিত করার পথে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম রাজস্ব সংগ্রহ এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধ ব্যয়-বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থ বিভাগ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি সহায়ক খাতে ঋণ গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিলেও এটি মুদ্রার বিনিময় হার ঝুঁকি, ব্যয়বহুল অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট রাজস্ব আহরণ আশানুরূপ না হওয়ায় সরকারের ওপর অর্থায়নের চাপ থাকছে। অন্যদিকে, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন। 

এ প্রেক্ষাপটে, সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে একটি মধ্যমেয়াদি ঘাটতি অর্থায়ন কৌশল অনুসরণ করছে। ঘাটতি অর্থায়নের অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ট্রেজারি বন্ড ও বিল এবং জাতীয় সঞ্চয় স্কিম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বৈদেশিক উৎসসমূহের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উৎস থেকে নমনীয় ও অ-নমনীয় ঋণ উল্লেখযোগ্য।

ঋণ প্রোফাইলের এক চিত্র উপস্থাপন করে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের শেষে মোট সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপি’র ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, যার মধ্যে ২১.৫২ শতাংশ এসেছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ১৬ .১০ শতাংশ বৈদেশিক উৎস থেকে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের সিংহভাগ (৫৮%) এসেছে ব্যাংকিং খাত থেকে, এরপর রয়েছে জাতীয় সঞ্চয় স্কিম যার অবদান ৩৪ শতাংশ। 

অন্যদিকে, বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ পাওয়া গেছে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাজেন্সি (আইডিএ) থেকে, এরপর আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান।

ঋণ স্থিতির মধ্যমেয়াদি প্রক্ষেপণ বিষয়ে বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপি’র অনুপাতে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরের শেষে মোট ঋণ জিডিপি’র ৩৭ দশমিক ৭২ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ হতে পারে জিডিপি’র ২১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ হতে পারে ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। 

বিগত বছরগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বন্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ফলে বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে অনুদান এবং নমনীয় ঋণ (কম সুদের হার, দীর্ঘ পরিশোধকাল) পাওয়ার সুবিধাদি ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে। 

সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে তুলনামূলক উচ্চ সুদের হার ও স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হতে পারে। যার ফলে ঋণ পরিশোধ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এসময় বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতির মধ্যমেয়াদী চিত্র অনেকটাই নির্ভর করবে সরকারের গৃহীত কার্যকর কৌশলগুলোর বাস্তবায়নের ওপর। 

যদি রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং ঋণ ব্যবস্থপনায় কার্যকর সংস্কার না আনা যায়, তাহলে ঋণের স্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। তবে, মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ এই উত্তরণের পথ দক্ষতার সাথে অতিক্রম করতে পারবে এবং উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থানের সুফল গ্রহণের পাশাপাশি একটি টেকসই ঋণ পরিস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কমপ্লায়েন্সের অভাবে ধুঁকছে চামড়া খাতের রপ্তানি
  • ৫ বছরে ঋণের স্থিতি বাড়বে ৫৩.৭৭ শতাংশ: অর্থবিভাগ