বাংলা সাহিত্যে নির্মলেন্দু গুণ এক প্রথিতযশা নাম—একজন কবি, যিনি তাঁর দ্রোহ, প্রেম ও নিসর্গ—মানবতাবাদী চেতনার জন্য আদৃত ও আলোচিত। তাঁর কবিতায় যেমন থাকে তীব্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, তেমনি এক কোমল, কামনাময় প্রেমের সুর। এই দুই ধারা মিলে তাঁর রচনায় যে আবেগময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূগোল নির্মিত হয়, তার সবচেয়ে নিরাভরণ ও আত্মবিকীর্ণ প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর কাব্যোপন্যাস আই লাভ ইউতে।
বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কৌশিকী রায়। তিনি কি বাস্তব জীবনের কেউ, নাকি কেবল কবির কল্পনায় নির্মিত প্রেমমূর্তি—এ প্রশ্ন পাঠকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন বোঝা যায়, কৌশিকী আসলে এক চিরপ্রার্থিত, অধরা প্রেমের প্রতীক।
বইটি গদ্য ও কবিতার সংমিশ্রণে রচিত অন্তর্জাগতিক স্বীকারোক্তি। প্রেমিক সত্তার গভীর আত্মপ্রকাশ এই রচনায় পাঠককে শুরু থেকেই এক অন্তর্লোক ভ্রমণের আহ্বান জানায়। এর ভাষা গভীরভাবে ব্যক্তিক, প্রাঞ্জল ও হৃদয়সন্ধানী। গদ্যরীতিকে কবিতার ছন্দে রূপান্তর করে গুণ পাঠকের মনে সৃষ্টি করেছেন এক অলঙ্ঘ্য কাব্যিক আবহ, যা প্রায় প্রতিটি অনুচ্ছেদে কাব্যের স্বাদ এনে দেয়।
বইয়ের কোনো কোনো অধ্যায়ে কবি যখন নিজের প্রেম ও হাহাকারের ব্যাখ্যা দেন, তখন ভাষা নয়, যেন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে। এই কাব্যগদ্য তাই কেবল পাঠ নয়, বরং অনুভবের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
এখানে প্রেম নিছক রোমান্টিক নয়, এতে রয়েছে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক স্তরের সমান উপস্থিতি। শরীরের স্বীকারোক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে আত্মার নিরাভরণ সমর্পণ। কৌশিকীর প্রতি ভালোবাসা কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব হয়েও তাই পাঠকের কাছে সর্বজনীন আবেগে রূপান্তরিত হয়।
নির্মলেন্দু গুণের প্রেম এখানে কেবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং তা এক গূঢ়, আত্মমগ্ন যাত্রা। কাব্যোপন্যাসটি হয়ে উঠেছে এমন এক কাব্যগদ্য যেখানে হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ, প্রত্যাশা, বেদনা ও অপূর্ণতা অখণ্ড প্রেমস্বরে উচ্চারিত হয়েছে। কৌশিকী কখনো দূরের তারার মতো অধরা, কখনোবা আত্মার অন্তর্গত অবিচ্ছেদ্য সত্তা।
এ গ্রন্থের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক এর ভাষা। এটি যেন কবিতা ও গদ্যের মাঝামাঝি ধূসর অঞ্চল থেকে জন্ম নেওয়া স্বর। ইংরেজি শব্দের আধিক্য বইটিকে কিছুটা কণ্টকিত করলেও সেই কাঁটা অতিক্রম করে যে ফুল পাওয়া যায় তার সুবাস সুদূরপ্রসারী।
পাঠক অনুভব করেন, এই রচনা নিছক কল্পনার সৃষ্টি নয়। বরং এতে মিশে আছে কবির ব্যক্তিগত অভিমান, হাহাকার, আকাঙ্ক্ষা ও একাকিত্ব। এটি যেন নির্মলেন্দু গুণের এক সাহিত্যিক আত্মজীবনী, যেখানে প্রেম নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।
এমন প্রেম সাহিত্যে বিরল নয়, তবে নির্মলেন্দু গুণের গদ্য-ছন্দে তা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। কারণ, এই প্রেমের মধ্যে নিহিত রয়েছে কবির কবি হয়ে ওঠার গল্প, তাঁর ভাষা ও যন্ত্রণার শরিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
বিষয়বস্তু ও কৃৎকৌশল, টুইস্ট ও কন্ট্রাস্ট, বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণ ও পরিমিতি বোধ, চমৎকারিত্ব ও রহস্যময়তা—নানা দিক বিবেচনায় এ উপন্যাস গুণের রচনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
বইটির শেষাংশে যখন কৌশিকী বিদেশ চলে যায়, তখন প্রেমিক কবির হৃদয়ে যে হাহাকার জন্ম নেয়, তা কেবল বিচ্ছেদজনিত বেদনা নয়, বরং এক অস্তিত্বজনিত নিঃসঙ্গতা। কৌশিকীর চলে যাওয়া কবির কাছে এক অপূর্ণতার পরিণতি—একটি এমন আকাঙ্ক্ষার বিসর্জন, যার ধ্বনি দীর্ঘদিন তাঁর কবিতার তন্ত্রীতে ধ্বনিত হবে। এই হাহাকার নিঃশব্দ, অথচ তীব্র; ব্যক্তিক অথচ সর্বজনীন। পাঠক তখন উপলব্ধি করেন—এই প্রস্থান আসলে কবির হৃদয়ে এক নতুন ‘অনুপস্থিত উপস্থিতি’র জন্ম দিয়েছে।
শেষ পৃষ্ঠাগুলো তাই পাঠকের ভেতর রেখে যায় এক দীর্ঘশ্বাস, এক অপরিণত অথচ অনিবার্য বিদায়ের সুর। যে সুরে নির্মলেন্দু গুণের প্রেমিক সত্তা বলে ওঠে, ‘কেন এসেছিলে, কেন চলে গেলে, মায়াপাশে বেঁধে প্রাণ.
আই লাভ ইউ একজন প্রেমিক কবির গভীরতম নিশ্বাস, যা পাঠকের হৃদয়ে দীর্ঘ সময়জুড়ে অনুরণন তুলতে থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আই লাভ ইউ
নির্মলেন্দু গুণ
প্রকাশক: শাপলা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ৩৫০ টাকা; পৃষ্ঠা: ১৭৬
প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৫
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ঘাড়ে, বুকে, হাতে গরম কিছু এসে লাগল, লুটিয়ে পড়েছিলাম মাটিতে’
চারদিকে গুলির শব্দ। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছুটছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আচমকাই শরীরে তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করেন খালেদ মাহমুদ। বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। জামাও ভিজে যায় রক্তে। সেই চিত্র আজও চোখে ভাসে তাঁর।
গত বছরের ৪ আগস্টের ঘটনা এটি। সেদিনের ঘটনার পর এক বছর কেটে গেছে। তবে সেদিনের যন্ত্রণা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন খালেদ। এখনো তাঁর শরীরে রয়েছে সাতটি গুলি। বাঁ হাত ও ডান পা অচল। হুইলচেয়ারে বসেই করেন চলাফেরা।
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচিতে লক্ষ্মীপুর শহরে অবস্থান নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ করে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা–কর্মীরা বাড়ির ছাদ থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। টানা ছয় ঘণ্টা ধরে চলা এ হামলায় নিহত হন চার শিক্ষার্থী। গুলিবদ্ধ হন শতাধিক। ২০ বছর বয়সী খালেদ তাঁদের একজন।
খালেদ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রুহিতা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সেদিনের ঘটনার কথা মনে করলে কেঁপে ওঠেন তিনি। প্রথম আলোকে খালেদ বলেন,‘সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ আমার বুক, ঘাড়, হাত—সব জায়গায় একসঙ্গে গরম কিছু এসে লাগল। তীব্র ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। হাত-পা বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। পাশে অনেকে চিৎকার করছিল। কেউ চ্যাংদোলা করে, কেউ রিকশায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিল আহতদের।’
খালেদ জানান, তাঁর শরীরে ১০টি গুলি লাগে। এর মধ্যে একটি গুলি শরীর ভেদ হয়ে বের হয়ে যায়। পরে অস্ত্রোপচার করে একটি গুলি লিভার থেকে বের করা হয়। আরেকটি বের করা হয় পেট থেকে। বাকি সাতটি শরীরে রয়ে গেছে।
সেদিনের ঘটনার পর দীর্ঘ দেড় মাস তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেননি। বাড়িতেই এখন তাঁর চিকিৎসার কার্যক্রম চলছে। প্রতিদিন তাঁর চলাফেরার জন্য পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা লাগে। নিজের দুর্ভোগের কথা জানিয়ে খালেদ বলেন, ‘সেদিন শুধু আমার শরীরে নয়, আমাদের ভবিষ্যতেও গুলি লেগেছিল। আমি দেশের তরুণদের জন্য আওয়াজ তুলেছিলাম, কোনো অপরাধ করিনি। এখন সাতটা গুলি শরীরে নিয়ে বেঁচে আছি, কিন্তু জীবন আর আগের মতো নেই।’
খালেদের চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তাঁর পরিবার। জানতে চাইলে বাবা শাহীন কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল। পড়াশোনায় ভালো ছিল। গুলি খেয়ে এখন পঙ্গু হয়ে গেছে। চিকিৎসা চালাতে ধারদেনায় ডুবে গেছি। সরকার যদি না দেখে ছেলেোকে কীভাবে বাঁচাব? সে তো কোনো সন্ত্রাসী নয়। দেশকে ভালোবাসত।’
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, খালেদের বিষয়টি তিনি জেনেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। একজন তরুণ ছাত্রকে এভাবে কষ্ট করতে দেখা মর্মান্তিক। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে সহায়তা দেওয়া হবে।