দেশে ইতোমধ্যেই তৈরি হয় ফ্রিজ ও এসির এমন যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ছাড় দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে দেশে এসব যন্ত্রাংশ তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে আরোপ করা হয়েছে উচ্চ শুল্ক হার। এতে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাত পড়েছে বড় ঝুঁকিতে। অন্ধকার দেখছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা।

তারা বলছেন, এ সিদ্ধান্তে দেশে ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের চেয়ে আমদানি লাভজনক হয়ে উঠেছে। ফলে স্থানীয় শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে কর্মসংস্থান হারাচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠী। সংশ্লিষ্টদের মতে, এরূপ সিদ্ধান্তের ফলে ইলেকট্রনিক্স খাতে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি থমকে যাচ্ছে। উৎপাদন শিল্পের আড়ালে আমদানির্ভর সংযোজন শিল্প বিকাশের পথ সুগম হয়েছে।

আরো পড়ুন:

অক্টোবরে রেমিট্যান্স এল ৩১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা

উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিজিএমইএ-এনপিও সমঝোতা স্মারক

উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন (এসআরও নম্বর-২৭৪-আইন/২০২৫/৩১৭-মূসক) জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। উক্ত এসআরওতে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এয়ারকন্ডিশনার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন বেশ কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, যা বাংলাদেশেই বহু বছর আগে থেকেই উৎপাদিত হয়ে আসছে। পক্ষান্তরে এসব যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ শুল্ক দিতে হচ্ছে যা স্থানীয় বৃহৎ ইলেকট্রনিক্স শিল্প খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ।

স্থানীয় শিল্পের পরিপন্থি এমন সিদ্ধান্তে হতবাক এই শিল্পে বিনিয়োগকারী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা জানান, এই সিদ্ধান্তের ফলে স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন শিল্পে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের বিদ্যমান কয়েক হাজার কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগই শুধু নয়, লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে সম্পূর্ণ উৎপাদনমুখী দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য শিল্প খাতের টেকসই বিকাশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ফ্রিজ-এসি উৎপাদন খাতে উল্টো পথে হাঁটছে সরকার।
ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের দেড় কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ), জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

এর আগে সরকারি সংস্থা এটুআই এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণার তথ্য বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চাকরি হারাতে পারেন দেশের প্রায় ৫৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন শিল্প খাতের পরিপন্থি শুল্কনীতির ফলে এই সংকট আরো ঘণীভূত হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, এসআরও নম্বর-২৭৪-আইন/২০২৫/৩১৭-মূসক এর ৮৪.

১৮ শিরোনাম সংখ্যার অধীনে এইচএস কোড: ৮৪১৮.৯৯.০০-এর আওতায় দেশীয় রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদন শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের তালিকায় বর্তমানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এমন বেশ কয়েকটি যন্ত্রাংশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে-রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজার শেলফ, স্টপার ব্লক, ডিওডোরেন্ট ব্লক, পিপি বটম প্লেট, ক্রিস্পার কভার, ড্রেনেজ পাইপ কভার, কভার অব কম্প্রেসর হাউজ, সাপোর্ট অব ক্রিস্পার কভার, কটন প্যাড ফর শেলফ, পিপি বেল্ট এবং ডাম্পিং ব্লক। এছাড়া শিরোনাম সংখ্যা ৮৫.৩৬-এর অধীনে এইচএস কোড ৮৫৩৬.৬১.০০-এর আওতায় লাইট হোল্ডার যন্ত্রাংশ আমদানিতেও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ফ্রিজের পাশাপাশি দেশীয় এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন শিল্পের ক্ষেত্রেও শিরোনাম সংখ্যা ৮৪.১৫-এর অধীনে এইচএস কোড ৮৪১৫.৯০.৯০-এর আওতায় দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এমন বেশ কয়েকটি উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রেও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে-ফ্যান ব্লোয়ার, কানেকটিং পাইপ, এক্সিয়াল ফ্যান, ক্যাসিং ফর ইনডোর, এয়ার গাইড প্লেট, টিউব প্লেট, এয়ার ফিল্টার, আইডিইউ প্যানেল, ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ এবং ক্রস ফ্লো ফ্যান।

নতুন এসআরও অনুযায়ী ফ্রিজে ব্যবহৃত হয় এমন তৈরিকৃত (সেমি ফিনিশড) যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে বিনা শুল্কে আমদানি করা গেলেও একই যন্ত্রাংশ দেশে তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানিতে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রদান করতে হচ্ছে। আর এসির ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানিতে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রদান করতে হচ্ছে। ফলে আমদানিকারক-সংযোজনকারী এবং উৎপাদনকারীদের মধ্যে পলিসিগত সামঞ্জস্য থাকছে না। উৎপাদনকারীর বিপুল বিনিয়োগ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হারাচ্ছে।

এসআরও সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব মেশিনারিজ থাকতে হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব মেশিনারিজ দিয়ে যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়, সেগুলোর শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। এখন যেসব উৎপাদনকারী ইতোমধ্যেই বিপুল বিনিয়োগ করে উক্ত মেশিনারিজগুলো স্থাপন করেছেন, তাদের সেসব মেশিনারিজ কোনো কাজেই লাগছে না। কারণ উক্ত মেশিনারিজ ব্যবহার করে যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে, সেসব যন্ত্রাংশের মূল্য আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। ফলে আমদানিকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

এছাড়া এই শিল্প খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজন হচ্ছে না। কারণ একজন উৎপাদনকারীকে তিন ধাপে বিনিয়োগ করে (মেশিনারিজ ক্রয় ও স্থাপন, লোকবল নিয়োগ এবং উচ্চ শুল্কে কাঁচামাল আমদানি) যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হচ্ছে। পক্ষান্তরে এসআরও সুবিধায় কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই বিনা শুল্কে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করা যাচ্ছে, যা অধিক লাভজনক হওয়ায় দেশ উৎপাদনমুখী শিল্পের পরিবর্তে সংযোজনমুখী শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসআরও-২৭৪ এর ফলে সেমি ফিনিশড গুডস (এসএফজি) এবং প্লাস্টিক শিল্পে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইলেকট্রনিক্স শিল্পে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পার্টসের একটি বিশাল অংশের যোগান আসে এই দুটি খাত থেকে। বর্তমানে দেশে সেমি ফিনিশড গুডস প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৯,৫০০ কোটি টাকা। আর এ খাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। এখানে কর্মসংস্থান প্রায় ৭ হাজার মানুষের। আর প্লাস্টিক শিল্প খাতে দেশে মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রায় ৬,০০০ কারখানা রয়েছে, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ লাখের অধিক মানুষের। দেশের জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ এই শিল্পনির্ভর। এসআরও-২৭৪ এর ফলে এই খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে এই খাত বিপুল কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, দেশের শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে।

তৈরি পোশাক খাতের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হিসেবে দ্রুত উঠে আসছে ইলেকট্রনিক্স খাত। কিন্তু এসআরও-২৭৪ এর কারণে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের রপ্তানি খাত ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির নতুন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। এতে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। ফলে ইউরোপীয় ও আমেরিকান বাজারে রপ্তানি সুবিধা বজায় রাখতে হলে বর্তমানে প্রযোজ্য ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের পরিবর্তে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ পণ্যের মোট মূল্যের অন্তত ৪০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হতে হবে। কিন্তু এসআরও-২৭৪ অনুযায়ী উৎপাদনমুখীতা থেকে দেশ আমদানিমুখী হয়েছে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

এ খাতের দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রশ্ন যেসব দেশীয় ফ্রিজ ও এসি প্রতিষ্ঠান আমদানি বিকল্প উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করছে এবং উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ ও প্লান্টস রয়েছে, তবে কেন এবং কাদের স্বার্থে ওসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হলো? এই শুল্ক নীতিমালার মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্যে দেশীয় হাই-টেক শিল্প খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হলো? এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে স্থানীয় ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন শিল্পের তৈরিকৃত সমজাতীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা।

তারা বলছেন, এতদিন যেসব দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রিজ ও এসির আনুষঙ্গিক উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করে আসছিলেন, সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করায় তাদের কাছে ওসব যন্ত্রাংশ উৎপাদনের চেয়ে বরং আমদানি করাই বেশি লাভজনক হয়ে উঠেছে। ফলে তারা এখন আমদানির প্রতি ঝুঁকছেন। এতে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও এ খাতের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনেও নতুন কোনো বিনিয়োগ আসছে না। ফলে শুধু এ খাতের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগই নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও সংকুচিত হচ্ছে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন।

তাই দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ফ্রিজ ও এসির যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে, সেসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গুরুত্বসহকারে পুনর্বিবেচনা করে তা বাতিল করা উচিত বলে অভিমত জানিয়েছেন শিল্প খাতে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্টরা।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিমত, দেশীয় উৎপাদনমুখী ইলেকট্রনিক্স শিল্প খাতের টেকসই বিকাশের স্বার্থে এবং এ খাতের দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশাল বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ফ্রিজ, এসির যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে, সেসব আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে যৌক্তিক হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহ্রাস করা এখন সময়ের দাবি।

ঢাকা/সাহেল/এসবি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চ ম ল আমদ ন ত ম ল য স য জন উৎপ দনক র ফ র জ ও এস শ আমদ ন ত শ উৎপ দ আমদ ন র উৎপ দ ত ব যবহ ত র জন য এই শ ল

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।

সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।

আরো পড়ুন:

জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী

গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী

বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।

২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।

নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।

৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।

জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।

মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।

উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।

এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।

আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।

প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।

জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।

বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”

তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”

এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।

জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর