সামাজিক মালিকানা ছাড়া পৃথিবীর বাঁচার উপায় নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Published: 23rd, June 2025 GMT
ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, ইরানে যে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে তার মূলে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার দায় দেখছেন ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার ভাষ্য, ইসরায়েল 'জায়নবাদী' তৎপরতা অব্যাহত রেখে এখন জাতীয়তাবাদের ‘সবচেয়ে আগ্রাসী রূপ দেখাচ্ছে’। বিশ্বযুদ্ধের যে দামামা বাজছে বিশ্বজুড়ে তা থামাতে তিনি পৃথিবীজুড়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন।
সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে নিজের ৯০তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে তিনি এসব কথা বলেন। ‘নতুন দিগন্ত পরিবার’ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা’ শিরোনামে একক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
অধ্যাপক পারভীন হাসানের সভাপতিত্বে আলোচনা পর্বে অংশ নেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও প্রবীণ বাম নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান ও সাজ্জাদ শরীফ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আজফার হোসেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা গণসংগীত পরিবেশন করেন। পরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১ ঘণ্টা ১৪ মিনিটব্যাপী একক বক্তৃতায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুরুতেই বলেন, ‘জাতীয়তাবাদের হেরফের আছে। জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী হতে পারে। জাতীয়তাবাদ আত্মরক্ষামূলক হতে পারে। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের যে ছবি, যে অভিজ্ঞতা সেটা আমরা একাত্তর সালে দেখেছি। আজকেও পৃথিবীতে ওই আগ্রাসী যে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা দেখছি। ইসরায়েলে যে জায়নবাদী যে তৎপরতা চালাচ্ছে, যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছ তার সবই বিশ্বযুদ্ধ লাগাবার তৎপরতা। এগুলো সবই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি।’
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে; মাদক এবং মারণাস্ত্রের ব্যবসা বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে পৃথিবীজুড়ে নানাভাবে গণহত্যা চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এই ‘জাতীয়তাবাদী ও পুঁজিবাদী’ তৎপরতা ঠেকাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন তিনি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সেই প্রতিরোধটা গড়তে হবে ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যক্তি মালিকানার যুগ শেষ হয়ে গেছে। তারা সামাজিক মালিকানা ছাড়া এই পৃথিবীর বাঁচার কোনো উপায় নাই। এখন একটা সামাজিক বিপ্লবের দরকার হবে; যে বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবে। সেখানে মানুষের মুক্তি আসবে, প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্লেষণ করার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য। কারণ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ভয় ছিল, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ধীরে ধীরে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে। তাজউদ্দীন আহমদের অজান্তেই মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছে। তাদের ওপর নির্দেশনা ছিল কমিউনিস্ট দেখলে যেন হত্যা করা হয়।’
একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের ভূমিকার প্রবল সমালোচনা করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। পঁচিশে মার্চে দেশজুড়ে অপারেশন সার্চলাইটের নামে যে গণহত্যা পরিচালনা করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, সেখানেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দায় দেখছেন তিনি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে যেমন করে তাদের দেখা যাচ্ছে না; তারা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সেইরকমভাবে আওয়ামী লীগের নেতারা তখন অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন। তারপরে নিজেদের মধ্যে কত কোন্দল, কত বিরোধ, সেখানে ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধীরা ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল। সেইখানে এই যে নেতৃত্ব তারা দিতে পারল না, সেটা বড় দুর্বলতা। যেজন্য আমাদের এত ক্ষতি হল, এত মানুষ মরল। এর আগে পাকিস্তানিরা অস্ত্র আনছে, সেনা আনছে- এটা তো বারবার জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। কিন্তু সেসময়ে যুদ্ধের প্রকাশ্যে ঘোষণা নাই। রেসকোর্সের মাঠে যৌথ ঘোষণার তোয়াক্কা করছিল না মানুষ। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। বাঙালি সেনারা অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সময় ক্ষেপণ করা হল। সেই সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা সুসংগঠিত হয়ে গেল। অথচ এর আগে যুদ্ধ হলে সেই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা আতঙ্কেই মারা যেত।’
রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণে তিনি সাতচল্লিশের দেশভাগ প্রসঙ্গ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন আর চুয়ান্নের পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনের নানা প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এ সময় তিনি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মতবাদ নিয়েও আলোচনা করেন।
তার ভাষ্য, বঙ্গবন্ধু মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তিনি পুঁজিবাদী ধারণাই পোষণ করতেন। তিনি বলেন, পিতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শেখ মুজিবকে সামরিক বাহিনীর একাংশ হত্যা করল। সেটা তার প্রথম মৃত্যু, দৈহিক মৃত্যু। তার দ্বিতীয় মৃত্যু সেটি তার ভাবমূর্তির মৃত্যু। সেটি ঘটল তার কন্যার হাতে, যে কন্যা তাকে অতি উচ্চতায় তুলেছিলেন।’
একক বক্তব্যে বাংলাদেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠনের প্রসঙ্গও টেনে আনেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনও দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে পারলাম না। তার কারণ হচ্ছে আমাদের সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই সম্পদ পাকিস্তানিরা পাচার করেছে; এখন বাংলাদেশি যারা শাসক তারা পাচার করছে এবং উলঙ্গভাবে পাচার করছে। সেটা তো আমরা দেখেছি। সম্পদ পাচারের জন্য এই দারিদ্র্য।’
একক বক্তব্যে বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রসঙ্গেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আসল নায়ক দেশের জনগণ। জনগণ প্রকৃত বিকল্প, প্রকৃত পরিবর্তনের আশায় গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়। দেশ থেকে ২৮ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ছাত্রদের অভ্যুত্থান দেখেছেন আপনারা, শ্রমিকদের অভ্যুত্থান দেখেননি। এটিও অবশ্যম্ভাবী।
শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, বর্তমান জাতীয়তাবাদ বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ। বামদের শক্তি এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার সামাজিক মালিকানা অর্জনের লড়াইয়ে বামশক্তি মাঠে নামবে।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, আন্দোলন লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বাম দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কিন্তু তারা নেতৃত্বে আসতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতি বদলাতে হলে এই দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতেই তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সাংবাদিক সাজ্জাদ শরীফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বার বার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে। এর দরকার আছে। তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে একটা ঐক্য তৈরি করে। তবে তা নানাভাবে বিভেদও সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার তা ক্ষুণ্ন করে।
বাম নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বাস্তবায়ন করেছিল। তারা চলে যাবার পর তাদের রুল চলে গেছে ঠিকই, তবে বিভক্তিটা ঠিকই আছে।
সভাপতির ব্ক্তব্যে অধ্যাপক পারভীন হাসান বলেন, জন্মের সময়ই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চলতে পারে না। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ কখনো টিকে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স র জ ল ইসল ম চ ধ র গণহত য প রক ত আগ র স আওয় ম ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
পাঁচ দফা দাবিতে বরিশালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলন
দ্রুত জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ ও আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসার দাবিসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন বরিশাল জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
আজ রোববার দুপুরে বরিশাল প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এই দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পাঁচ দফা দাবি হলো আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জুলাই আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, গণহত্যায় জড়িতদের দৃশ্যমান বিচার, আওয়ামী লীগের দোসরদের আইনের আওতায় আনা এবং সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার। তাঁদের অভিযোগ জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেনি। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল জেলা শাখার আহ্বায়ক সাব্বির হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে আমরা আর কোনো টালবাহানা সহ্য করব না। অবশ্যই আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে। গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃশ্যমান কোনো বিচার ও আওয়ামী লীগের দোসরদের এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি। এটা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী।’
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের অন্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী হাসিবুর রহমান ও মুখপাত্র সুমী হক। এ সময় তাঁরা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা না হলে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান।