নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে
Published: 26th, June 2025 GMT
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস আজ বৃহস্পতিবার। বিশ্বব্যাপী নানাভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিনটি পালন করে। দিবসটি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সব নির্যাতনের শিকার মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে। বিচার, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্যাতন প্রতিরোধে রাষ্ট্র যেন কার্যকর উদ্যোগ নেয়– এই আহ্বান জানায় আসক।
সংস্থাটি বলছে, বিগত বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বেআইনি আটক ও হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনকহারে ঘটেছে। এমনকি, আটক বা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে গেছে। আবার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলোর অধিকাংশের কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
আসক আরও বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী কমপক্ষে ১৫টি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে, যার বেশির ভাগ স্বাধীন তদন্তের আলো দেখেনি। বিগত সময়ে হেফাজতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতাসহ যেসব অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে দ্রুত নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। দায়ীদের আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনা ও ভুক্তভোগী পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণে আইনি সহায়তা দিতে হবে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে জবাবদিহি বাড়াতে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা জানিয়েছে আসক।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে দুই হাজার ৮৭টি, এপ্রিলে দুই হাজার ৮৯, মার্চে দুই হাজার ৫৪, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৪৩০ ও জানুয়ারিতে এক হাজার ৪৪০টি। এ ছাড়া ২০২৪ সালে গড়ে প্রতি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা এক হাজার ৪৬৪ ও ২০২৩ সালে এক হাজার ৫৭৮টি।
১৯৯৭ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতিসংঘ প্রতিবছরের ২৬ জুন নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এর প্রেক্ষাপট রচনা হয় আরও আগে, ১৯৮৭ সালে। সে বছরের ২৬ জুন বিশ্বের ১৩৭টি দেশ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কনভেনশনে সই করে। অন্যান্য দেশের মতো এতে সই করে বাংলাদেশও।
গুম হওয়ার পর সাড়ে চার মাস পর ফেরত আসা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ সমকালকে বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের আমলে তাঁর মতো করে অনেককেই গুমের শিকার হতে হয়েছে। যাদের ভাগ্য ভালো তারাই হয়তো ফিরে আসতে পেরেছে। সেখানকার সেই ভয়ংকর দিনগুলো যেন আর কারও জীবনে না আসে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে
গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হত্যার ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। দুর্বৃত্তরা যখন এক ভদ্রলোককে নিশানা করে ‘এই পাইছি, তোরা আয়’ বলে সহযোগীদের ডাকছিল, তখন আসাদুজ্জামান পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে ঘটনার ছবি তুলছিলেন। এরপর পাঁচ–ছয়জন দুর্বৃত্ত তাঁকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে। তিনি দৌড়ে ঈদগাহ মার্কেটের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পাননি। তারা দোকানে ঢুকে তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
এটা গাজীপুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আগের দিন বুধবার নগরীর সাহাপাড়া এলাকায় দুর্বৃত্তদের আক্রমণে আনোয়ার হোসেন নামের আরেক সাংবাদিক আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত সাত মাসে গাজীপুরে শতাধিক হত্যা ও অসংখ্য ছিনতাই–ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও জননিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর ভূমিকা নিতে না পারা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে দেশের আরও অনেক স্থানের মতো গাজীপুরেও মব সন্ত্রাস বেড়ে যায়। এসব সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য যারা দায়ী, সরকার তাদের না ধরে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। আসাদুজ্জামান হত্যার ঘটনায় পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে একজন নারীও আছেন। এই অপরাধী চক্র দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে এলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যে ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান নিহত হন, তা–ও ছিল অপরাধীদের অপকৌশলের অংশ।
আসাদুজ্জামান দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ–এর গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। পাশাপাশি একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি, যিনি দুটি কাজ করে সংসার নির্বাহ করতেন। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো গাজীপুরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনার পেছনে পেছনে হাঁটে। তারা যদি জানেই যে সেখানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী চক্র আছে, তাদের ধরতে আগে থেকে অভিযান চালাল না কেন?
পুলিশের লোকবলের অভাব আছে, মানুষ এই অজুহাত শুনতে চায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি ও সেনাসদস্যরাও নিয়োজিত আছেন। এতগুলো বাহিনী দায়িত্বে থাকার পরও অবাধে ছিনতাই–ডাকাতি ও খুনের ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ কীভাবে ভরসা পাবে? গাজীপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে একজন সাংবাদিক খুন হওয়ার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁরা বরাবরের মতো সাংবাদিকদের ওপর সরকার কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না বলে সাফাই গাইছেন। সাংবাদিকসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
কেবল গাজীপুর নয়, সারা দেশেই জননিরাপত্তা হুমকির মুখে। সন্ত্রাসীরা যদি একজন কর্তব্যরত সাংবাদিককে খুন করে পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গত বছর গণ–অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পর বিশৃঙ্খল অবস্থাকে সরকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বলে চালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এক বছর পরও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। থানা–পুলিশের পক্ষ থেকে অপরাধের কমবেশি পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করা যাবে না। তারা তখনই আশ্বস্ত হবে, যখন দেখবে সরকার সত্যি সত্যি অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সন্ত্রাসীদের হাতে যে সাংবাদিক নৃশংসভাবে খুন হলেন, কোনোভাবেই তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু জননিরাপত্তার স্বার্থে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আগেই সরকারকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাই।