জিংক এমন এক পুষ্টি উপাদান, যা রোজ অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেই আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন। এ ধরনের পুষ্টি উপাদানকে বলা হয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে সাধারণত আলাদাভাবে জিংকসমৃদ্ধ নির্দিষ্ট কোনো খাবার গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কেউ কেউ এই পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিতেও ভুগতে পারেন। জিংকের অভাবে সাধারণ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়, অনেক সময় যেসবকে কোনো পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
জিংক আমাদের দেহের নানা ক্রিয়াবিক্রিয়ায় অংশ নেয়। জিংকের অভাব হলে এসব ক্রিয়াবিক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তারই কিছু উপসর্গ দেখা দেয় আমাদের দেহে। স্নায়ুর কার্যক্ষমতা ঠিক রাখতেও পর্যাপ্ত জিংক প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন টাঙ্গাইলের সরকারি কুমুদিনী কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের প্রধান শম্পা শারমিন খান।
আরও পড়ুনহিসাবের চেয়েও কম বা বেশি হতে পারে আপনার দেহের বয়স, কীভাবে২২ জুলাই ২০২৫যেসব সমস্যা দেখা দেয়জিংকের ঘাটতি হলে কিছু উপসর্গ প্রায় সবারই হতে পারে, তবে কিছু সমস্যা আবার নির্দিষ্ট বয়স বা পরিস্থিতিতেই দেখা যায়। এ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
জিংকের অভাবে প্রায়ই ডায়রিয়া হতে পারে। এই পুষ্টি উপাদানের অভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই বারবার নানা ধরনের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ত্বকে বারবার ব্রণ বা পিম্পলের মতো ক্ষত সৃষ্টি হওয়া কিংবা যেকোনো ক্ষত সহজে না শুকানোর মতো সমস্যাও দেখা যেতে পারে।
কম বয়সেই ত্বকে পড়তে পারে বয়সের ছাপ।
চুলের গড়ন বেশ পাতলা হয়ে যেতে পারে জিংকের অভাবে।
ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিতে পারে। ওজন কমে যেতে পারে।
স্বাদ ও ঘ্রাণের অনুভূতিতে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে।
কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও বিঘ্নিত হতে পারে। ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে জিংকের ঘাটতি খুব বেশি হলে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সন্তান নিতে ইচ্ছুক দম্পতির যে কারও জিংকের ঘাটতি থাকলে সন্তানধারণের চেষ্টা বিফল হতে পারে।
আরও পড়ুনকেন মিলেনিয়াল ও জেন-জিদের মধ্যে বাড়ছে কলোরেক্টাল ক্যানসার২২ জুলাই ২০২৫কারা আছেন ঝুঁকিতেঅন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির ক্ষেত্রে জিংকের ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে যেকোনো বয়সী মানুষই জিংকের ঘাটতিতে ভুগতে পারেন। যদি কারও খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক না হয় কিংবা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ সত্ত্বেও কোনো রোগের কারণে অন্ত্র থেকে পর্যাপ্ত জিংক দেহে শোষিত না হয়, তাহলে জিংকের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে এ ধরনের কোনো রোগ না থাকলে কেবল বয়স অনুযায়ী সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখলেই আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
উপসর্গ দেখা দিলেউপসর্গ দেখে যদি মনে হয়, আপনি জিংকের ঘাটতিতে ভুগছেন, তাহলে নিজের খাদ্যাভ্যাসের দিকে মনোযোগ দিন। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, যেকোনো ধরনের বাদাম, গোটা শস্য, চানাবুট, রাজমা, শিম, মটরশুঁটি, কুমড়ার বীজ, বিভিন্ন ধরনের ডাল, মাশরুম প্রভৃতিতে আপনি জিংক পাবেন।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা শুরু করার কিছুদিন পরও সমস্যাগুলো থেকে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এসব উপসর্গের পেছনে অন্য কোনো সমস্যাও দায়ী থাকতে পারে, যা চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করবেন। তবে নিজে থেকে জিংকের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিংক গ্রহণ করলে দেহে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের শোষণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে অন্য কোনো পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা যেতে পারে।
বাড়ন্ত শিশুর শরীরে জিংকের ঘাটতি দেখা দিলে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা ভাবার আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, এ ক্ষেত্রে দেরি করলে শিশুর বৃদ্ধির সুবর্ণ সময়টা হারিয়ে যেতে পারে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপসর গ দ খ ব ধ গ রস ত উপ দ ন র ধরন র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।
অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
আরো পড়ুন:
১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের
দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।
গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা।
তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”
অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।
ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।
সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।
অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”
রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।
তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
ঢাকা/মেহেদী