একজন সুস্থ ব্যক্তির পায়ের শিরার কাজ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নেওয়া যাক প্রথমে। এসব শিরার মাধ্যমে পায়ের দিক থেকে রক্তের ধারা বয়ে যায় হৃৎপিণ্ডের দিকে। শিরাগুলোতে থাকে ভালভ। রক্ত যাতে ঠিকঠাক গতিতে হৃৎপিণ্ডের দিকে প্রবাহিত হয়, সে কাজটা নিশ্চিত করে এসব ভালভ।

তবে কোনো কারণে যদি ভালভের কার্যক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলেই মুশকিল। রক্ত আর স্বাভাবিক গতিতে হৃৎপিণ্ডের দিকে ফিরতে পারে না। দীর্ঘদিন এই অবস্থা রয়ে গেলে তাকেই বলা হয় ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিশিয়েন্সি।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা.

শাহনূর শারমিন

কেন হয় এমন সমস্যা

অতিরিক্ত ওজনের প্রভাবে ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিশিয়েন্সি হতে পারে। যাঁদের লম্বা সময় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয়, তাঁদের এ রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। পর্যাপ্ত শরীরচর্চা না করলেও ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপায়ীরাও আছেন উচ্চ ঝুঁকির তালিকায়।

যাঁদের পরিবারে এ রোগের ইতিহাস আছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একটু বেশি ঝুঁকি থাকে। তবে সাধারণত কম বয়সে এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয় না। কোনো কোনো নারীর গর্ভাবস্থায় এমন সমস্যা হতে পারে।

উপসর্গ

রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মূল সমস্যা দেখা দেয় হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালির মাঝের অংশে। পায়ের এই অংশ বেশ ভারী মনে হয় তখন। ব্যথাও হয় খুব। বিশ্রাম না নিলে এই ব্যথার উপশম হয় না। পায়ের এই অংশটা ফুলেও যেতে পারে। এখানকার শিরাগুলো প্রকটভাবে ফুটে উঠতে পারে। কখনো কখনো এই অংশের ত্বকে আরও কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়।

পায়ের এই অংশটা বেশ অমসৃণ হয়ে পড়তে পারে, ফাটা ভাব দেখা দিতে পারে। বাদামি বা লালচে-বাদামি রং দেখা দিতে পারে ত্বকে, অস্বস্তিকর চুলকানিও হতে পারে। গোড়ালি ফুলে যেতে পারে। জটিল পরিস্থিতিতে ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা সহজে সারে না।

আরও পড়ুনকাঁচকলার যত উপকারিতা ২৬ জুলাই ২০২৫প্রতিকার

এটি কোনো জটিল রোগ নয়। তবে রোগটি বেশ কষ্টদায়ক। প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে দিনকে দিন পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। পায়ের আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে এ রোগ নিশ্চিত করা যায়। মূলত জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমেই এ রোগের উপসর্গগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।

২৪ ঘণ্টায় তিনবার মিনিট দশেকের জন্য পা উঁচু করে রাখার চর্চা বেশ কাজে দেয়। এই চর্চার জন্য হৃৎপিণ্ডের অবস্থানের চেয়ে উঁচুতে রাখতে হয় পা। শোয়া অবস্থায় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে রাখাটাই এর সবচেয়ে সহজ উপায়।

আরও পড়ুনহার্ট অ্যাটাকের ৬টি লক্ষণ এবং হার্ট অ‍্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে যা করবেন২৪ মার্চ ২০২৫

শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা জরুরি। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেওয়া আবশ্যক। দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে না থেকে মাঝেমধ্যে দেহের ভঙ্গি, বিশেষ করে পায়ের ভঙ্গি পরিবর্তন করাটাও জরুরি।

বসার সময় এক পায়ের ওপর অন্য পা তোলা উচিত নয়। পায়ের ত্বকে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। আরামদায়ক পোশাক এবং জুতা ব্যবহার করা প্রয়োজন।

চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক আঁটসাঁট মোজা (কমপ্রেশন স্টকিংস) ব্যবহার করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সার্জারি বা শল্যচিকিৎসারও প্রয়োজন হয়। রক্তনালির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।

আরও পড়ুনহাত-পা জ্বালাপোড়া, ঝিঁঝিঁ করা ও অনুভূতিহীনতার কারণ কী২৪ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই অ শ

এছাড়াও পড়ুন:

গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন

অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।

অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।

আরো পড়ুন:

১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের

দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের

সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।

গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। 

অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা। 

তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”

অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।

ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।

সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।

অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”

রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।

তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”

ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিসিওএস এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা
  • গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
  • প্রোস্টেট ক্যানসারের উপসর্গগুলো আপনার জানা আছে কি