গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
Published: 28th, July 2025 GMT
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র জ এইচএফ ইসর য় ল ব তরণ ক র জন য দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েল বলছে তারা গাজায় ত্রাণ দিচ্ছে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা না খেয়ে মরছে কেন
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে এখন পর্যন্ত ১২৭ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে ৮৫ জনই শিশু। ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে এসব মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
গত মার্চে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, এতে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য হামাসের ওপর চাপ বাড়বে। কিন্তু সে মাসের শেষদিকে ইসরায়েল নিজেরাই একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়।
চলতি সপ্তাহে ইসরায়েল সরকার গাজার পরিস্থিতির জন্য জাতিসংঘকে দায়ী করেছে। এমনকি তারা অভিযোগ করেছে, হামাসের সঙ্গে মিলে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের সামরিক রেডিও কান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নষ্ট হওয়ায় কিংবা মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায় এক হাজার ট্রাক ত্রাণসামগ্রী জ্বালিয়ে দিয়েছে বা মাটিচাপা দিয়েছে।তবে এবারই প্রথম নয়, ইসরায়েল আগেও গাজায় ত্রাণ ঢুকতে বাধা দিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে ইসরায়েল জাতিসংঘের ত্রাণবাহী গাড়িবহর গাজায় ঢুকতে দেয়নি। তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল, মানুষকে অনাহারে রেখে এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা জানায়, ইসরায়েল গাজার ৮৩ শতাংশ ত্রাণ আটকে দিচ্ছে।
দুবারই ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ত্রাণ আটকে দেয়নি। গাজায় ত্রাণ না পৌঁছানোর কারণ হিসেবে তারা জাতিসংঘের অদক্ষতা ও হামাসকে দায়ী করেছে। অথচ যেসব স্থানে ত্রাণ যাচ্ছে না, সেগুলো অনেক দিন ধরেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা বলে দাবি করে আসছে ইসরায়েল।
তাহলে ইসরায়েল কী বলেছে? তারা কি স্বীকার করছে যে গাজায় একটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছে?—প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
এখন কি গাজায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না
গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর ইসরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সমালোচনার মুখে পড়ে। এরপর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় তারা জিএইচএফ নামে একটি নতুন ত্রাণ ব্যবস্থা চালু করে। জাতিসংঘ ও অন্য ত্রাণ সংস্থাগুলোর জায়গা নেওয়াই এই জিএইচএফ চালু করার মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জোট সরকার এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিরোধিতা বা দেশের ভেতরের ক্ষোভ—কোনোটিই গুরুত্ব দিচ্ছে না। গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তারা সরাসরি উড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এসব অভিযোগকে ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ ও ‘মিথ্যা অপবাদ’ বলে উল্লেখ করেছে।আগে গাজায় প্রায় ৪০০টি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ছিল। এখন জিএইচএফ চালায় মাত্র চারটি কেন্দ্র। শুধু গাজার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে এগুলোর অবস্থান। তা-ও সেগুলো নিয়মিত পরিচালিত হয় না।
মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত, এ কেন্দ্রগুলোর কাছে খাবার নিতে আসা সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলি সেনা ও কিছু বিদেশি ঠিকাদার হামলা চালিয়ে হাজারের বেশি মানুষকে মেরে ফেলেছে।
জাতিসংঘ এখনো সীমিত পরিসরে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে এত বেশি বিধিনিষেধের মধ্যে কাজ চালাতে হয় যে এর কার্যকারিতা টের পাওয়া যায় না।
ইসরায়েল কি স্বীকার করছে যে গাজায় মানুষ অনাহারে মরছে
না, ইসরায়েল সেটা স্বীকার করছে না।
গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েল সরকারের কার্যক্রম সমন্বয়কারী সংস্থা সিওজিএটি বলেছে, ‘গাজা উপত্যকায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই।’ তবে তারা এও বলেছে, গাজার কিছু কিছু জায়গায় খাবার পাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা গেছে।
ইসরায়েল কি বলছে যে গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে
তা নয়। ইসরায়েলের দাবি, জাতিসংঘ ঠিকমতো বিতরণ না করায় অনেক ত্রাণ রোদে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের সামরিক রেডিও কান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নষ্ট হওয়ায় কিংবা মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায় এক হাজার ট্রাক ত্রাণসামগ্রী জ্বালিয়ে দিয়েছে বা মাটিচাপা দিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দপ্তরের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার গত শুক্রবার বিবিসিকে বলেন, ‘গাজায় জাতিসংঘ শত কোটি ডলারের ঠকবাজি করছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, জাতিসংঘ হামাসের সঙ্গে মিলে ইচ্ছা করে গাজার মানুষকে ত্রাণ পেতে বাধা দিচ্ছে।
তবে মেনসার এ অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। আর জাতিসংঘ কেন এমনটা করবে, সে ব্যাখ্যাও তিনি দেননি।
আরও পড়ুনক্ষুধা গাজায় বোমার মতো মানুষ মারছে, ২৪ ঘণ্টায় ১০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা২৪ জুলাই ২০২৫তাহলে কি জাতিসংঘ হামাসের সঙ্গে কাজ করছে
জাতিসংঘ বলছে, তারা এমন কিছু করছে না।
গত বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন অভিযোগ করেন, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার ও মানবিক সহায়তা সমন্বয়কারী দপ্তর (ওসিএইচএ) কোনো না কোনোভাবে হামাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ড্যানন তাঁর অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি।
পরদিন লিখিত জবাবে টম ফ্লেচার বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার যদি এমন কোনো প্রমাণ পেয়ে থাকে, তাহলে তারা যেন তা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।’
এর আগেও, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল জাতিসংঘ ত্রাণবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) বিরুদ্ধে হামাসের সঙ্গে কাজ করার অভিযোগ তুলেছিল।
ইসরায়েলের ওই অভিযোগের বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন তদন্ত হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে সে স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল ওই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।
জিএইচএফ পরিচালিত একটি ত্রাণ সংস্থার কাছে মানুষের ভিড়