৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউর ৪৪ তলা একটি আকাশচুম্বী ভবনে কর্মরত শত শত কর্মচারীর জন্য গত সোমবার সন্ধ্যাটা হঠাৎ করেই বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। মিডটাউন ম্যানহাটানের প্রাণকেন্দ্রে বড় বড় করপোরেট দপ্তরে ঠাসা এই আকাশচুম্বী ভবনে এমন সন্ধ্যা আগে কখনো আসেনি।

জুলাইয়ের গরমে সেদিন সন্ধ্যায় যখন অন্যরা বাড়ির পথ ধরেছেন, তখন পার্ক অ্যাভিনিউ টাওয়ারের কর্মীরা জীবন বাঁচাতে দৌড়াচ্ছেন, কেউ কেউ সম্মেলনকক্ষের দরজা টেবিল দিয়ে আটকে দিয়েছেন, আর প্রিয়জনদের কাছে আগাম বিদায়ের বার্তা পাঠাচ্ছেন।

ভবনের দ্বিতীয় তলায় কর্মরত জেসিকা চেন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আমার মা–বাবাকে লিখেছিলাম, আমি তাঁদের ভালোবাসি, এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’

সেই সন্ধ্যায় সুউচ্চ ওই ভবনের ভেতরে থাকা জেসিকা চেন ও অন্যরা হঠাৎ করে লবির দিক থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন।

ওই গোলাগুলিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নিউইয়র্কের এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন নিহত হন, গুরুতর আহত একজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এলোপাতাড়ি গুলি

তাণ্ডব শুরুর ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের দিকে ২৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি গাড়ি চালিয়ে ম্যানহাটানের অন্যতম ব্যস্ত এলাকায় ঢোকেন। তার আগে তিনি গাড়িতে করে কলোরাডো, নেব্রাস্কা ও আইওয়া হয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, লাস ভেগাসের বাসিন্দা শেন টামুরা তাঁর কালো রঙের বিএমডব্লিউ গাড়িটি পার্ক অ্যাভিনিউতে আগে থেকে পার্ক করে রাখা অন্য একটি গাড়ির পাশে পার্ক করেন। তিনি গাড়িটি যেখানে পার্ক করেন, সেটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা রকফেলার সেন্টার ও সেন্ট প্যাট্রিকস ক্যাথেড্রাল থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে।

জুলাইয়ের গরমে সেদিন সন্ধ্যায় যখন অন্যরা বাড়ির পথ ধরেছেন, তখন পার্ক অ্যাভিনিউ টাওয়ারের কর্মীরা জীবন বাঁচাতে দৌড়াচ্ছেন, কেউ কেউ কনফারেন্স কক্ষের দরজা টেবিল দিয়ে আটকে দিয়েছেন, আর প্রিয়জনদের কাছে আগাম বিদায়ের বার্তা পাঠাচ্ছেন।

জ্যাকেট, বোতামওয়ালা শার্ট ও সানগ্লাস পরা ওই ব্যক্তি ডান হাতে একটি অ্যাসল্ট-ধাঁচের রাইফেল ধরে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকেন সুউচ্চ ওই ভবনের দিকে। তিনি জানতেন, ওই ভবনেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল লিগের (এনএফএল) প্রধান কার্যালয়।

কিন্তু ওই ব্যক্তি এনএফএল কার্যালয় পর্যন্ত যেতে পারেননি। বরং তিনি পৌঁছে যান ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউর দরজায়, যেটি নিউইয়র্ক নগরের একটি ব্লকজুড়ে বিস্তৃত।

নিউইয়র্ক নগর পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ বলেন, তিনি ভবনের লবি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এ যেন কোনো শুটিং গেম।

প্রথমে টামুরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তার ঠিক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পরে তিনি ডান দিকে ঘুরে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখেন এবং গুলি চালান। তাঁর গুলিতে নিউইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তা ৩৬ বছর বয়সী দিদারুল ইসলাম নিহত হন।

নিউইয়র্ক নগরের মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেছেন, নিহত দিদারুলের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।

কেউ কেউ পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল, একেবারে রাস্তায়। আর আমিসহ বাকিরা দৌড়ে কনফারেন্স কক্ষে ঢুকেছিলাম।জেসিকা চেন, আক্রান্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার কর্মী

মেয়র অ্যাডামস বলেন, ‘তিনি (টামুরা) ভবনের ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ডান পাশের প্রবেশপথের দিকে গুলি ছোড়া শুরু করেন।’

কর্তৃপক্ষ বলছে, টামুরা সময় নষ্ট না করে এরপর লবিতে থাকা একজন নারীকে গুলি করেন। ওই নারী একটি স্তম্ভের পেছনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরপর তিনি গুলি করতে করতে লবি ধরে এগোতে থাকেন।

ওপরের তলায় ব্ল্যাকস্টোন নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী ওয়েসলি লেপাটনার গুলিতে প্রাণ হারান। এ ছাড়া এনএফএলের একজন কর্মী হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন।

আরও পড়ুনম্যানহাটানে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত২৯ জুলাই ২০২৫

ভুল লিফটে চড়া

গুলির শব্দ যখন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তখন একজন নিরাপত্তাকর্মী সম্ভাব্য আরও রক্তপাত ঠেকাতে লিফট চলাচলব্যবস্থা অচল করে দিতে অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

মেয়র অ্যাডামস বলেন, কিন্তু ওই নিরাপত্তারক্ষী কাউন্টারের পেছনে আশ্রয় নেওয়ার সময় তাঁকে হত্যা করা হয়। নিহত নিরাপত্তারক্ষীর নাম আল্যান্ড এটিয়েন।

এরপর বন্দুকধারী ভবনের একটি লিফটের দিকে এগিয়ে যান। পুলিশ বলেছে, তিনি যখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন এক নারী তাঁর সামনে পড়ে যান। তবে ওই নারী কোনোভাবে অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে সরে যেতে পেরেছিলেন।

গুলির শব্দ যখন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তখন একজন নিরাপত্তাকর্মী সম্ভাব্য আরও রক্তপাত ঠেকাতে লিফট চলাচল ব্যবস্থা অচল করে দেওয়ার জন্য অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

লিফট আসার পর ওই ব্যক্তি সেটিতে ওঠেন। কিন্তু লিফটি তাঁকে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, তিনি ভুল লিফটে উঠেছিলেন। ফলে তিনি এনএফএলের কার্যালয়ে নয় বরং ৩৩তম তলায় অবস্থিত আবাসন কোম্পানি রুডিন ম্যানেজমেন্টের কার্যালয়ে পৌঁছে যান। ওই ভবনটি এই কোম্পানির মালিকানাধীন।

আতঙ্ক ধরানো ই–মেইল এবং সাহায্যের জন্য দৌড়াদৌড়ি

লবিতে যখন বিশৃঙ্খলা চলছিল, তখন ওই ভবনের কর্মীরা দ্রুত ই–মেইল এবং মাইক্রোসফট টিমসের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে থাকেন, নিচতলায় একজন বন্দুকধারী আছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে এমনটাই বলেছেন ব্ল্যাকস্টোনের একজন কর্মী।

জেসিকা চেন এবিসি নিউজকে বলেন, তিনি আকাশচুম্বী ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রায় ১৫০ জনের সঙ্গে একটি প্রেজেন্টেশন দেখছিলেন, ঠিক তখনই তাঁরা প্রথমবার গুলির শব্দ শুনতে পান।

জেসিকা বলেন, ‘কেউ কেউ পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিলেন, একেবারে রাস্তায়। আর আমিসহ বাকিরা দৌড়ে কনফারেন্স কক্ষে ঢুকেছিলাম।’

আমার মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করুন। আমি দুঃখিত।শেন টামুরা, হামলাকারী

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, ব্ল্যাকস্টোনের আতঙ্কিত কর্মীরা সোফা, টেবিল এবং অন্যান্য আসবাবপত্র দিয়ে একটি দরজার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন।

ইএসপিএনের খবরে বলা হয়, এনএফএল অফিসে থাকা কর্মীরা লিগের পক্ষ থেকে গুলি–সংক্রান্ত সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। ওই বার্তায় তাঁদের ফোন ‘সাইলেন্স মোডে’ রাখার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না আসা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে বলা হয়।

আরও পড়ুননিউইয়র্কের ম্যানহাটানে বন্দুকধারীর গুলিতে পুলিশসহ নিহত ৫২৯ জুলাই ২০২৫দিদারুল ইসলাম.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ল শ কর মকর ত ন উইয়র ক ভবন র দ র জন য ত কর ম কর ম র র কর ম র দরজ

এছাড়াও পড়ুন:

দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের সবচেয়ে চাকচিক্যপূর্ণ এলাকায় একটি যৌন ব্যবসা এবং অসহায় নারীদের শোষণ–নির্যাতনের মূল হোতাকে চিহ্নিত করেছে বিবিসির অনুসন্ধানী দল।

চার্লস মোসিগা নামের ওই ব্যক্তি পরিচয়-গোপনকারী বিবিসি প্রতিবেদককে বলেন, এক সেক্স পার্টির জন্য তিনি ন্যূনতম এক হাজার ডলার দরে নারী সরবরাহ করতে পারবেন। তাঁরা অনেকেই গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ‘প্রায় সবকিছুই’ করতে পারবে। মোসিগা লন্ডন শহরের সবেক একজন বাসচালক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে বহু বছর ধরেই নানা কথা চালু আছে। টিকটকে এ-সংক্রান্ত একটি হ্যাশট্যাগ ৪৫ কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে। এটা ধরে অনেক ব্যঙ্গাত্মক ও জল্পনামূলক তথাকথিত অনুসন্ধানী কনটেন্ট ছড়িয়েছে। সেগুলোতে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে অর্থলোভী কিছু নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা নেন এবং তাঁরা গোপনে মানুষের যথেচ্ছ যৌন চাহিদা মিটিয়ে বিলাসী জীবনযাপনের খরচ জোগান।

বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে বলা হয়েছে, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।

উগান্ডার কয়েকজন তরুণী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা কখনো ভাবেননি, মোসিগার অধীনে তাঁদের যৌনকর্ম করতে হবে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তাঁরা সুপার মার্কেট বা হোটেলের মতো কোনো জায়গায় কাজ করার জন্য আরব আমিরাতে যাচ্ছেন।

‘মিয়া’ (ছদ্মনাম) বলেন, মোসিগার আনা গ্রাহকদের অন্তত একজন নিয়মিত মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করতে চান। তিনি বলেন, মোসিগার চক্র তাঁকে ফাঁদে ফেলে এ কাজে জড়িয়েছে।

মোসিগা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি শুধু বাড়িওয়ালাদের মাধ্যমে নারীদের বাসা পেতে সহায়তা করেন। আর তাঁরা মোসিগার সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যান, কারণ তাঁর সঙ্গে দুবাইয়ের অনেক ধনাঢ্য মানুষের যোগাযোগ আছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। অভিযোগ আছে, অনেক অর্থলিপ্সু নারী ইনফ্লুয়েন্সার তাঁদের বিলাসী জীবনযাপনের জন্য গোপনে অর্থের জোগান মেটাতে অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর কাজও করছেন।

অনুসন্ধানে বিবিসি আরও জানতে পেরেছে, মোসিগার সঙ্গে যোগসূত্র থাকা দুই নারী দুবাইয়ের সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে মারা গেছেন। যদিও তাঁদের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের স্বজন ও বন্ধুরা মনে করেন, পুলিশের আরও তদন্ত করা উচিত ছিল।

মোসিগা বলেন, ঘটনা দুটি দুবাই পুলিশ তদন্ত করেছে। এ–সংক্রান্ত তথ্যের জন্য তিনি বিবিসিকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু পুলিশ বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

মারা যাওয়া দুই নারীর একজন মোনিক কারুঙ্গি। তিনি পশ্চিম উগান্ডা থেকে দুবাইয়ে আসেন। মোসিগার জন্য কাজ করা আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে একটি ফ্ল্যাটে মোনিকের ঠাঁই হয়।

একজন নারী বলেন, তিনি ২০২২ সালে মোনিকের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থেকেছেন। বিবিসি এই নারীর নাম দিয়েছে কেইরা।

কেইরা বলেন, ‘(মোসিগার) ওই ফ্ল্যাটটি ছিল বাজারের মতো। সেখানে প্রায় ৫০টি মেয়ে একসঙ্গে থাকত। সে (মোনিক) খুশি ছিল না। কারণ, সে যা চেয়েছিল, তা পায়নি।’

মোনিকের বোন রিতা বলেন, একটি সুপার মার্কেটে কাজ করবেন ভেবে তাঁর বোন দুবাই গিয়েছিলেন।

মোনিকের সঙ্গে মিয়ারও পরিচয় ছিল। বিবিসিকে মিয়া বলেন, ‘আমি বাড়ি ফিরেতে চাইলে তিনি (মোসিগা) সহিংস হয়ে ওঠেন। তিনি জানান, দুবাই আসার পর মোসিগা তাঁকে বলেছিলেন—তিনি ইতিমধ্যে মিয়ার কাছে ২ হাজার ৭১১ ডলার পান। ঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে দুই সপ্তাহের মধ্যে এটা দ্বিগুণ হবে।

মিয়া বলেন, ‘বিমান টিকিট, ভিসা খরচ, বাসা ভাড়া, খাবার খরচ মেটাতে তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পুরুষদের কাছে অনুনয় করতে হবে, যাতে তারা কাছে আসে ও শয্যাসঙ্গী হয়।’

ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।

মাইকেল (ছদ্মনাম) নামে মোনিকের এক আত্মীয় বিবিসিকে বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মোসিগার কাছে মোনিকের প্রায় ২৭ হাজার ডলার ঋণ জমে গিয়েছিল। মোনিকে প্রায়ই মাইকেলকে কাঁদতে কাঁদতে ভয়েস নোট পাঠিয়ে এ কথাগুলো বলত।

মিয়া বলেন, তাঁদের গ্রাহকদের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ মানুষ। এদের অনেকের চরম বিকৃত যৌন চাহিদা ছিল। নিচু গলায় তিনি বলেন, একজন গ্রাহক মেয়েদের ওপর মলত্যাগ করে সেটা খেতে বলতেন।

লেক্সি নামের (ছদ্মনাম) আরেক নারী বলেন, অন্য একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে তিনি এই কাজে জড়িয়েছেন। তিনিও বলেন, গ্রাহকেরা প্রায়ই এমনটা করতে চাইতেন। একজন গ্রাহকের অমানুষিক ঘৃণাপূর্ণ বিকৃত চাহিদা বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, এমন অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছে যে, এসব চরম বিকৃত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা বর্ণবিদ্বেষের ব্যাপার থাকতে পারে।

লেক্সি বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি বলতাম, এগুলো করতে চাই না, তাঁরা আরও মজা পেত। তাঁরা এমন কাউকে চাইত, যে কিনা কাঁদবে, চিৎকার করবে ও পালাতে চাইবে। এমন কেউ, যে হবে কৃষ্ণাঙ্গ।’

লেক্সি বলেন, তিনি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে বলেছিল, ‘তোমরা আফ্রিকানরা একে অপরের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছ। আমরা এতে জড়াতে চাই না। তারপর তাঁরা ফোন কেটে দেয়।

মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।

দুবাই পুলিশের কাছে বিবিসি এই অভিযোগ তুলে ধরলেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য লেক্সি উগান্ডায় ফিরতে সক্ষম হন। বর্তমানে তিনি এ ধরনের চক্রের ফাঁদে পড়া নারীদের উদ্ধার ও সহায়তায় কাজ করছেন।

চার্লস মোসিগাকে খুঁজে পাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বিবিসির অনুসন্ধানকারী দলটি শুধু অনলাইনে তাঁর একটি ছবি পেয়েছিল। সেটিও ছিল পেছন থেকে তোলা, তা ছাড়া, নানা নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন মোসিগা।

উন্মুক্ত উৎস থেকে নেওয়া তথ্য, ছদ্মবেশে অনুসন্ধান এবং মোসিগা চক্রের এক সাবেক সদস্যের দেওয়া তথ্য—সব মিলিয়ে অনুসন্ধানকারী দল তাঁকে দুবাইয়ের মধ্যবিত্ত এলাকা জুমেইরাহতে খুঁজে পায়।

আরও পড়ুনদুবাইয়ের যৌনপল্লি থেকে তরুণী উদ্ধার, আসামিদের অব্যাহতি চায় পুলিশ২৭ মার্চ ২০২২

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল, মোসিগার ব্যবসা মূলত অবমাননাকর যৌনকর্মের জন্য নারীদের সরবরাহ করা। বিষয়টি যাচাই করতে অনুসন্ধানী দল একজন ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে পাঠায়। তিনি নিজেকে একজন অনুষ্ঠান আয়োজক হিসেবে পরিচয় দেন, যিনি বিলাসবহুল পার্টিগুলোর জন্য নারী খুঁজছেন।

অনুসন্ধানকারী দল যখন মোসিগার সঙ্গে তাঁর ব্যবসার বিষয়ে কথা বলছিল, তখন তাঁকে শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছিল।

মোসিগা বলেন, ‘আমাদের কাছে ২৫ জনের মতো মেয়ে আছে। এদের অনেকেই মুক্তমনা…তারা প্রায় সবকিছুই করতে পারে।’

খরচের ব্যাপারে মোসিগা বলেন, রাতপ্রতি একেকজনের জন্য এক হাজার ডলার থেকে শুরু। তবে অস্বাভাবিক কাজের জন্য বেশি অর্থ দিতে হবে। তিনি বিবিসির রিপোর্টারকে একটা নমুনা রাতের দাওয়াত দেন।

মোসিগা বলেন, এই ব্যবসা তাঁর অতি প্রিয়। লটারিতে ১০ লাখ পাউন্ড জিতলেও তিনি এ ব্যবসা চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমারই একটি অংশ হয়ে গেছে।’

ট্রয় নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি মোসিগার চক্রের অপারেশনস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। চক্রটি কীভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে তিনি বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে তথ্য দেন।

ট্রয় বলেন, মোসিগা বিভিন্ন নৈশক্লাবের নিরাপত্তাকর্মীদের টাকা দেন, যাতে তাঁর পাঠানো নারীরা ভেতরে ঢুকে গ্রাহক খুঁজতে পারে।

আরও পড়ুনদুবাইয়ে ধর্ষণের শিকার নরওয়েজীয় নারীর কারাদণ্ড২১ জুলাই ২০১৩

ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।

২০২২ সালের ২৭ এপ্রিলে দুবাইয়ে প্রবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় আবাসিক এলাকা আল বারশায় একটি সেলফি তুলে পোস্ট করেছিলেন মোনিক। এর চারদিন পরই তিনি মারা যান। দুবাইয়ে আসার চার মাসের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়।

মিয়ার বলছেন, মোনিক যত দিন ছিলেন, মোসিগার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত ঝগড়া হতে দেখেছেন। মোনিক মোসিগার চাহিদা পূরণ করতে অস্বীকার করছিলেন এবং চক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পেয়েছিল।

মিয়া বলেন, মোনিক একটি চাকরি পেয়েছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ভেবেছিলেন, অবশেষে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পাবেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।

মোসিগার ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছেড়ে প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা দূরত্বে অন্য একটি ফ্ল্যাটে চলে যান মোনিক। ২০২২ সালের ১ মে ওই বাসার বারান্দা থেকে তিনি নিচে পড়ে যান।

মোনিকের আত্মীয় মাইকেল তখন দুবাইতে ছিলেন। তিনি বলেন, মোনিকের মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ তাঁকে বলেছিল, তারা তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ, মোনিকের বাসা থেকে মাদক ও অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। বারান্দায় শুধু মোনিকের আঙুলের ছাপ ছিল।

আরও পড়ুনদুবাইয়ের ড্যান্স বারে বাংলাদেশ থেকে তরুণী পাচার, বাধ্য করা হচ্ছে যৌন পেশায়২২ নভেম্বর ২০১৯

মাইকেল হাসপাতাল থেকে মোনিকের মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এতে উল্লেখ ছিল না, তিনি কীভাবে মারা গেছেন।

মোনিকের পরিবারের জন্য এখন শোকের সঙ্গে ভয় মিলেমিশে গেছে। ভয় অন্য পরিবারগুলোর জন্য, যারা একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

বিবিসি চার্লস অ্যাবি মোসিগার কাছে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চায়। তিনি অবৈধ যৌন ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যা।’

এদিকে মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সফর ২২ সেপ্টেম্বর, সঙ্গী মির্জা ফখরুলসহ চার রাজনীতিক
  • প্রধান উপদেষ্টার নিউইয়র্ক সফরে সঙ্গী হচ্ছেন ফখরুল, তাহেরসহ চার রাজনীতিবিদ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মামলা করবেন ট্রাম্প
  • ইসরায়েলি বন্ডে আর বিনিয়োগ নয়—ঘোষণা দিলেন জোহরান মামদানি