ক্লাস করতে হয় না, পাসের ব্যবস্থা আছে
Published: 31st, July 2025 GMT
একটি ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে আছি। এক প্রার্থী এলেন, ফরিদপুরের একটি ডিগ্রি কলেজে অনার্স করছেন। জানালেন, তিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানে কম বেতনে বিপজ্জনক কাজ করছেন এবং ভালো সুযোগের আশায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—পড়াশোনা? ক্লাসে যাওয়া? তার উত্তর ছিল—না, ক্লাস করতে হয় না। ব্যবস্থা আছে। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিলেই হয়।
ধাতস্থ হওয়ার আগেই আরেকজন প্রার্থী এলেন, যিনি ঢাকার একটি কলেজে বিবিএ করছেন। জানালেন, তিনিও একটি কাজ করেন, যেখানে নিরাপত্তার সমস্যা আছে এবং তাঁর ক্ষেত্রেও ক্লাস করার দরকার পড়ে না। একই কথা—‘ব্যবস্থা আছে।’ তখন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল—আচ্ছা, পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলেও না যাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে?
এ অভিজ্ঞতা এক বড়সড় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করার পর এক সদস্য জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এক কর্মী রসায়নে অনার্স পাস করেছেন কোনো ক্লাস না করেই! শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে উপস্থিত হলেই চলে যেত! আমরা কোন দেশে বাস করছি! রসায়নের মতো ব্যবহারিক-নির্ভর আর বিবিএর মতো কেসস্টাডি ও অ্যাসাইনমেন্ট-নির্ভর স্নাতক ডিগ্রি যদি ছেলেমেয়েরা অর্জন করে শুধুই পরীক্ষায় বসে, তাহলে কীভাবে সেই ডিগ্রিকে মূল্যবান ধরা যায়?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু নেতিবাচক ধারণা ছিল, কিন্তু ওই দিন যা ঘটেছে, তা যেন তার চেয়েও গভীরতর সংকেত দিচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গাজীপুরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ, যেখানে প্রায় ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থী অনার্স প্রোগ্রামে নাম লিখিয়েছে।
এ বিশাল শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষের উপস্থিতি, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক যোগাযোগ—সবই ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীরা অনায়াসেই বলে দিচ্ছে, ‘ক্লাস করতে হয় না, ব্যবস্থা আছে। শুধু পরীক্ষার সময় যেতে হয়।’ প্রশ্ন উঠছে, এই শিক্ষায় আদৌ কি কোনো মান আছে? যদি কোনো শিক্ষার্থী ব্যবহারিক ছাড়াই রসায়নে পাস করতে পারেন, যদি বিবিএর ছাত্রছাত্রী কোনো ক্লাস না করেও ডিগ্রি পেয়ে যান, তাহলে সে শিক্ষায় অর্জন কী?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে, যেখানে পরীক্ষায় পাস করলেই সাফল্য ধরা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই সাফল্যের আর কোনো প্রতিফলন নেই। তরুণেরা সনদ হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে নামছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁরা হেরে যাচ্ছেন।সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাস করে ব্যবসায় শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে। বিজ্ঞানে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম—স্নাতকে মাত্র ৩.
এই চিত্র উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীরা পাস করছেন; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। ফলে চাকরির বাজারে তাঁরা প্রতিযোগিতা করতে পারছেন না। ডিগ্রি থাকলেও অভিজ্ঞতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা কিংবা যোগাযোগ-ক্ষমতার ঘাটতি তাঁদের পিছিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় সিস্টেমে প্রশাসনিক নজরদারি কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না, ব্যবহারিক কার্যক্রম অনেক জায়গায় একেবারেই অনুপস্থিত।
অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন অনেক সময়েই কাগজে-কলমে রয়ে যাচ্ছে। অথচ পরীক্ষায় পাস করা যাচ্ছে ‘ব্যবস্থা’র মাধ্যমে। এ বাস্তবতা জাতির জন্য বড় ধরনের বিপৎসংকেত। শিক্ষার এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে প্রতিটি কলেজে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ও ব্যবহারিক ক্লাস বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি স্বাধীন অডিট বোর্ড গঠন করে কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, ক্লাস কার্যক্রমের মান নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, ক্যারিয়ার মেলা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করা জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা কেবল সার্টিফিকেটধারী না হয়ে দক্ষ কর্মী হয়ে উঠতে পারেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে, যেখানে পরীক্ষায় পাস করলেই সাফল্য ধরা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই সাফল্যের আর কোনো প্রতিফলন নেই। তরুণেরা সনদ হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে নামছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁরা হেরে যাচ্ছেন।
শিক্ষা মানে শুধু পাস করা নয়। শিক্ষা মানে জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, সমস্যা সমাধান করতে শেখা, নিজের জায়গা নিজেই তৈরি করতে পারা। তাই এখনই সময়—শুধু সনদ নয়, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। না হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশাল শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
মুনির হাসান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ র সময় ব যবহ র ক ই স ফল য পর ক ষ য় ক ল স কর ব যবস থ র জন য প স কর করছ ন স করত
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় গুলিতে ৩ পুলিশ নিহত
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে গুলিতে অন্তত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুজন পুলিশ সদস্য।
অঙ্গরাজ্যটির পুলিশ কমিশনার ক্রিস্টোফার প্যারিস বুধবার সংবাদমাধ্যমকে হতাহতের এ তথ্য জানান।
ক্রিস্টোফার প্যারিসের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরের এ ঘটনায় সন্দেহভাজন বন্দুকধারীও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আহত দুই পুলিশ সদস্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পেনসিলভানিয়ার গভর্নর জশ শাপিরো ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার বা প্রায় ১১৫ মাইল পশ্চিমে নর্থ কোডোরাস টাউনশিপে ঘটনাস্থলে গেছেন।
কে বা কারা এ গুলিবর্ষণের পেছনে জড়িত, সে সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল পামেলা বন্ডি পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ‘আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
পামেলা বন্ডি আরও বলেন, স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তার জন্য ফেডারেল এজেন্টরা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।