একটি ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে আছি। এক প্রার্থী এলেন, ফরিদপুরের একটি ডিগ্রি কলেজে অনার্স করছেন। জানালেন, তিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানে কম বেতনে বিপজ্জনক কাজ করছেন এবং ভালো সুযোগের আশায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—পড়াশোনা? ক্লাসে যাওয়া? তার উত্তর ছিল—না, ক্লাস করতে হয় না। ব্যবস্থা আছে। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিলেই হয়।

ধাতস্থ হওয়ার আগেই আরেকজন প্রার্থী এলেন, যিনি ঢাকার একটি কলেজে বিবিএ করছেন। জানালেন, তিনিও একটি কাজ করেন, যেখানে নিরাপত্তার সমস্যা আছে এবং তাঁর ক্ষেত্রেও ক্লাস করার দরকার পড়ে না। একই কথা—‘ব্যবস্থা আছে।’ তখন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল—আচ্ছা, পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলেও না যাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে?

এ অভিজ্ঞতা এক বড়সড় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করার পর এক সদস্য জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এক কর্মী রসায়নে অনার্স পাস করেছেন কোনো ক্লাস না করেই! শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে উপস্থিত হলেই চলে যেত! আমরা কোন দেশে বাস করছি! রসায়নের মতো ব্যবহারিক-নির্ভর আর বিবিএর মতো কেসস্টাডি ও অ্যাসাইনমেন্ট-নির্ভর স্নাতক ডিগ্রি যদি ছেলেমেয়েরা অর্জন করে শুধুই পরীক্ষায় বসে, তাহলে কীভাবে সেই ডিগ্রিকে মূল্যবান ধরা যায়?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু নেতিবাচক ধারণা ছিল, কিন্তু ওই দিন যা ঘটেছে, তা যেন তার চেয়েও গভীরতর সংকেত দিচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গাজীপুরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ, যেখানে প্রায় ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থী অনার্স প্রোগ্রামে নাম লিখিয়েছে।

এ বিশাল শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষের উপস্থিতি, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক যোগাযোগ—সবই ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীরা অনায়াসেই বলে দিচ্ছে, ‘ক্লাস করতে হয় না, ব্যবস্থা আছে। শুধু পরীক্ষার সময় যেতে হয়।’ প্রশ্ন উঠছে, এই শিক্ষায় আদৌ কি কোনো মান আছে? যদি কোনো শিক্ষার্থী ব্যবহারিক ছাড়াই রসায়নে পাস করতে পারেন, যদি বিবিএর ছাত্রছাত্রী কোনো ক্লাস না করেও ডিগ্রি পেয়ে যান, তাহলে সে শিক্ষায় অর্জন কী?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে, যেখানে পরীক্ষায় পাস করলেই সাফল্য ধরা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই সাফল্যের আর কোনো প্রতিফলন নেই। তরুণেরা সনদ হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে নামছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁরা হেরে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাস করে ব্যবসায় শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে। বিজ্ঞানে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম—স্নাতকে মাত্র ৩.

৮২ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তরে মাত্র ৩.১০ শতাংশ। এ ছাড়া পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২.২৯ শতাংশ বেতনভুক চাকরিতে নিযুক্ত, ১৬.২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন; কিন্তু তিন বছর পরও ২৮.২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পুরোপুরি বেকার থাকেন। নারীদের বেকারত্বের হার তুলনামূলক বেশি এবং গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক।

এই চিত্র উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীরা পাস করছেন; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। ফলে চাকরির বাজারে তাঁরা প্রতিযোগিতা করতে পারছেন না। ডিগ্রি থাকলেও অভিজ্ঞতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা কিংবা যোগাযোগ-ক্ষমতার ঘাটতি তাঁদের পিছিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় সিস্টেমে প্রশাসনিক নজরদারি কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না, ব্যবহারিক কার্যক্রম অনেক জায়গায় একেবারেই অনুপস্থিত।

অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন অনেক সময়েই কাগজে-কলমে রয়ে যাচ্ছে। অথচ পরীক্ষায় পাস করা যাচ্ছে ‘ব্যবস্থা’র মাধ্যমে। এ বাস্তবতা জাতির জন্য বড় ধরনের বিপৎসংকেত। শিক্ষার এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে প্রতিটি কলেজে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ও ব্যবহারিক ক্লাস বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি স্বাধীন অডিট বোর্ড গঠন করে কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, ক্লাস কার্যক্রমের মান নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, ক্যারিয়ার মেলা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করা জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা কেবল সার্টিফিকেটধারী না হয়ে দক্ষ কর্মী হয়ে উঠতে পারেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে, যেখানে পরীক্ষায় পাস করলেই সাফল্য ধরা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই সাফল্যের আর কোনো প্রতিফলন নেই। তরুণেরা সনদ হাতে নিয়ে চাকরির বাজারে নামছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁরা হেরে যাচ্ছেন।

শিক্ষা মানে শুধু পাস করা নয়। শিক্ষা মানে জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, সমস্যা সমাধান করতে শেখা, নিজের জায়গা নিজেই তৈরি করতে পারা। তাই এখনই সময়—শুধু সনদ নয়, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। না হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশাল শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

মুনির হাসান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ক ষ র সময় ব যবহ র ক ই স ফল য পর ক ষ য় ক ল স কর ব যবস থ র জন য প স কর করছ ন স করত

এছাড়াও পড়ুন:

চব্বিশ নিয়ে যেন একাত্তরের মতো ‘চেতনা ব্যবসা’ না হয়: ফুয়াদ

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার  আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, ‘‘জুলাই, ২৪ নিয়ে যেন একাত্তরের মতো ‘চেতনা ব্যবসা’ না হয়। জুলাই থেকে শিখে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়বো। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না তাদের বাস্তবতা অওয়ামী লীগের মতো হবে। 

শুক্রবার (১ আগস্ট) দুপুরে পটুয়াখালী প্রেসক্লাবের ড. আতহার উদ্দীন মিলনায়তনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে তিনি চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। 

আমার বাংলাদেশ পার্টির পটুয়াখালী জেলা শাখার আহ্বায়ক  প্রফেসর ড. এএসএম ইকবাল হোসাইনের সভাপতিত্বে চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মেজর আব্দুল ওহাব মিনার ও সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী নাসীর। আলোচনা শেষে উপস্থিত সবাই জুলাই আন্দোলনের প্রদর্শিত চিত্র ঘুরে দেখেন।

ইমরান//

সম্পর্কিত নিবন্ধ