অসহায় মায়েদের স্বস্তির আশ্রয়স্থল
Published: 1st, August 2025 GMT
স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। ট্রেন দুর্ঘটনায় বড় ছেলের মৃত্যুর পর রাবেয়া বেগমের (৮০) মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন অন্য ছেলেরা। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছিল তাঁর। এমন সময় তিনি নিজের গ্রামেই এমন একটি জায়গার খোঁজ পান, যেখানে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যায়।
এর পর থেকে ১২ বছর ধরে ‘ওল্ড কেয়ার হোম’ নামের সেই জায়গাতেই থাকছেন রাবেয়া। সেখানে আরও অনেক অসহায় মায়ের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে দিন কাটছে তাঁর।
যশোর সদর উপজেলার সমসপুর গ্রামে ওল্ড কেয়ার হোমটি গড়ে তুলেছেন জ্যোৎস্না মুখার্জি নামের এক নারী। ভৈরব নদের পাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ওপর ছায়া-সুনিবিড় বৃদ্ধাশ্রমটি হয়ে উঠেছে অসহায় মায়েদের শেষ জীবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
এক যুগের বেশি সময় আগে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমটি একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আশিকুজ্জামান তুহিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একেবারেই প্রকৃতির মধ্যে একটি বৃদ্ধানিবাস। বৃদ্ধ মায়েরা শেষ বয়সে প্রকৃতির মধ্যে থাকলে তাঁদের মনেও প্রশান্তি থাকে। এই বৃদ্ধানিবাস ঠিক তেমনই। এমন উদ্যোগ খুব ভালো লেগেছে।’
‘ওল্ড কেয়ার হোমে’ একদিন
যশোর শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার গেলে মান্দারতলা বাজার। সেখান থেকে পাকা সড়ক দিয়ে এক কিলোমিটার পশ্চিমে ভৈরব নদ। নদের পশ্চিম পাশে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ঝনঝনিয়া গ্রাম। আর পূর্ব পাশে যশোরের সমসপুর, একেবারেই অজপাড়াগাঁ।
গ্রামের নদের পাড়েই ওল্ড কেয়ার হোমের অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, এল-প্যাটার্নের একতলা ভবনটিতে ছয়টি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। ভবনের পাশে রয়েছে তিনটি কক্ষ। কক্ষগুলো পাকা গাঁথুনি, টিনের ছাউনি। হিন্দু ও মুসলমান নারীদের জন্য রয়েছে পৃথক প্রার্থনা স্থান। বিনোদনের জন্য রয়েছে দুটি টেলিভিশন। বিদ্যুৎ–সংযোগের পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমান এখানে ২০ জন বৃদ্ধা আছেন। তাঁরা জ্যোৎস্না মুখার্জিকে ‘আম্মু’ বলে ডাকেন। কেউ কেউ ‘খালা’ বলে সম্বোধন করেন। তাঁরা আরও জানান, তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি পরনের কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, তেল, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, কম্বল, স্যুয়েটার দেওয়া হয়। এমনকি ওষুধও দেওয়া হয়। চারজন চিকিৎসক নিয়মিত মুঠোফোনে চিকিৎসাসেবা দেন। মাঝেমধ্যে চিকিৎসাশিবির করা হয়।
টিনের ছাউনি থেকে ভবন
বিয়ের পর ১৯৯৮ সালে স্বামী অমরনাথ মুখার্জির সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান গৃহিণী জ্যোৎস্না মুখার্জি। সেই সময় উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে তিনটি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখেন। সেখান থেকে স্বপ্ন দেখেন সুযোগ পেলে নিজের গ্রামে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবেন। ২০০১ সালে হৃদ্রোগে স্বামী মারা গেলে অধরা থেকে যায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু তিনি দমে যাননি।
২০০৮ সালে সমসপুর গ্রামে একটি মাটির ঘরে এলাকার দুস্থ ও অসহায় বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া শুরু করলেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি তাঁদের কিছু টাকা, শাড়ি, কম্বল দিতে শুরু করলেন। একদিন বাবাকে জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। শুনে বাবা বিশ্বনাথ গাঙ্গুলী বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য ২০১০ সালে মেয়েকে পাঁচ বিঘা জমি লিখে দিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা মারা যান ২০১৬ সালে।
সেই জমিতে ২০১২ সালে শুরু হয় ওল্ড কেয়ার হোমের পথচলা। প্রথমে প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ছাউনি টিনের। প্রথম বছরেই ঠাঁই হয় ৪০ জন মায়ের। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০১৪ সালে এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে জেলা পরিষদ সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করে দেয়। কক্ষটি মায়েরা হলরুম হিসেবে ব্যবহার করেন। ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদ ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে টিনের ছাউনির জায়গায় ছয়টি কক্ষে ছাদ দেয়।
আনন্দ–বিনোদনে কাটে সময়
বৃদ্ধাশ্রমে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকায় আনন্দেই দিন কাটে বাসিন্দাদের। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আম্বিয়া বেগম (৬৮) প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে আছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা আমাকে অবহেলা করত। তখন আমি আশ্রমে চলে আসি। সেই থেকে এখানে আছি। এখানে থাকতে ভালো লাগে। কোনো কিছুর অভাব নেই। এখন ছেলেরা বাড়ি যেতে বলে। মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’
বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সবাই মিলে গল্পের আসর বসে বৃদ্ধাশ্রমে। মাঝেমধ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে নাচ, গান এবং বিভিন্ন খেলার ব্যবস্থা থাকে। নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন তাঁরা। বছরে দুইবার বাইরে ঘুরতেও যান। নদের পাড়ে প্রায় ১০ ফুট ওপরে গাছের সঙ্গে একটি কাঠের ঘর করা হয়েছে। নাম টি হাউস। মাসে এক থেকে দুইবার সেখানে সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেন ‘আম্মু’। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে লুচি, সুজি, ডাল বা মুড়ি-চানাচুর মাখা খাওয়া। বাসিন্দাদের কারও মৃত্যুর পর মৃতদেহ গ্রহণের মতো আত্মীয়স্বজন না থাকলে তাঁদের দাফনের জন্য আট শতক জমি কেনা হয়েছে।
মুরাদগড় গ্রামের রোকেয়া বেগম (৭৫) বলেন, ‘আমার স্বামী বেঁচে নেই। ছেলেরা অবহেলা করত। এরপর আশ্রমে চলে আসি। ১৩ বছর ধরে এখানে আছি। ভালো আছি। আম্মু আমাদের খুব ভালো রেখেছেন।’
বৃদ্ধাশ্রমেরও নিজস্ব আয় আছে
একসময় ঢাকায় মোবাইল ফোনের ব্যবসা ছিল জ্যোৎস্না মুখার্জিদের। এই ব্যবসার আয়ে চলত বৃদ্ধাশ্রমটি। এখন মোবাইল ফোনের ব্যবসা নেই। স্থানীয় বাজারে তাঁর ভুসিমালের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া বাজারের বাড়ির তিনটি কক্ষ ভাড়া দেওয়া আছে। ব্যবসা ও বাড়িভাড়ার টাকা দিয়ে বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমের কিছু ব্যয় বহন করা হয়। তবে খরচের বড় অংশই আসে বৃদ্ধাশ্রমের নিজস্ব আয় থেকে।
এক ছেলেকে নিয়ে এখন জ্যোৎস্না মুখার্জির বেশির ভাগ সময় কাটে বৃদ্ধাশ্রমের দেখভাল করে। তিনি জানান, বৃদ্ধাশ্রমের জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়। বিভিন্ন ফলদ গাছ এবং বাঁশ রয়েছে। ৩টি গরু, ২টি ছাগল, ৩০ জোড়া কবুতর, ২৫টি মুরগি এবং ৪টি হাঁসও আছে। কৃষি এবং গবাদি পশুপাখি থেকে আয় দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম চলে। মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিবছর কিছু চালও পাওয়া যায়।
স্থানীয় তিনজন নারী নামমাত্র সম্মানীতে বৃদ্ধাশ্রমটি দেখাশোনা করেন উল্লেখ করে জ্যোৎস্না মুখার্জি বলেন, এখানে সব সময় ২০ থেকে ২৫ জন মা থাকেন। এখন সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। মায়েরা একসঙ্গে খেত থেকে শাক তোলেন, কাটেন, পরিষ্কার করেন এবং রান্নায় সহায়তা করেন। দেখে খুব ভালো লাগে।
ওল্ড কেয়ার হোমের পরিধি বাড়ানো নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। তিনি বলেন, ‘ওল্ড কেয়ার হোমে এখনো সীমানাপ্রাচীর দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছা নদের পাড়ে দুই কক্ষের একটি ভবন তুলব। সেখানে অন্তত পাঁচজন বৃদ্ধ বাবা থাকবেন।’
জ্যোৎস্না মুখার্জির কার্যক্রমে গর্বিত এলাকার বাসিন্দারা। সমসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাশেম আলী বলেন, ‘অজপাড়াগাঁয়ে এমন ভালো বৃদ্ধাশ্রম বাংলাদেশে আছে কি না, আমার জানা নেই। এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে থাকার পাশাপাশি পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সবকিছু বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ওষুধও দেওয়া হয়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নদ র প ড় র ব যবস র জন য অসহ য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
অসহায় মায়েদের স্বস্তির আশ্রয়স্থল
স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। ট্রেন দুর্ঘটনায় বড় ছেলের মৃত্যুর পর রাবেয়া বেগমের (৮০) মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন অন্য ছেলেরা। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছিল তাঁর। এমন সময় তিনি নিজের গ্রামেই এমন একটি জায়গার খোঁজ পান, যেখানে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যায়।
এর পর থেকে ১২ বছর ধরে ‘ওল্ড কেয়ার হোম’ নামের সেই জায়গাতেই থাকছেন রাবেয়া। সেখানে আরও অনেক অসহায় মায়ের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে দিন কাটছে তাঁর।
যশোর সদর উপজেলার সমসপুর গ্রামে ওল্ড কেয়ার হোমটি গড়ে তুলেছেন জ্যোৎস্না মুখার্জি নামের এক নারী। ভৈরব নদের পাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ওপর ছায়া-সুনিবিড় বৃদ্ধাশ্রমটি হয়ে উঠেছে অসহায় মায়েদের শেষ জীবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
এক যুগের বেশি সময় আগে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমটি একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আশিকুজ্জামান তুহিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একেবারেই প্রকৃতির মধ্যে একটি বৃদ্ধানিবাস। বৃদ্ধ মায়েরা শেষ বয়সে প্রকৃতির মধ্যে থাকলে তাঁদের মনেও প্রশান্তি থাকে। এই বৃদ্ধানিবাস ঠিক তেমনই। এমন উদ্যোগ খুব ভালো লেগেছে।’
‘ওল্ড কেয়ার হোমে’ একদিন
যশোর শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার গেলে মান্দারতলা বাজার। সেখান থেকে পাকা সড়ক দিয়ে এক কিলোমিটার পশ্চিমে ভৈরব নদ। নদের পশ্চিম পাশে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ঝনঝনিয়া গ্রাম। আর পূর্ব পাশে যশোরের সমসপুর, একেবারেই অজপাড়াগাঁ।
গ্রামের নদের পাড়েই ওল্ড কেয়ার হোমের অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, এল-প্যাটার্নের একতলা ভবনটিতে ছয়টি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। ভবনের পাশে রয়েছে তিনটি কক্ষ। কক্ষগুলো পাকা গাঁথুনি, টিনের ছাউনি। হিন্দু ও মুসলমান নারীদের জন্য রয়েছে পৃথক প্রার্থনা স্থান। বিনোদনের জন্য রয়েছে দুটি টেলিভিশন। বিদ্যুৎ–সংযোগের পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমান এখানে ২০ জন বৃদ্ধা আছেন। তাঁরা জ্যোৎস্না মুখার্জিকে ‘আম্মু’ বলে ডাকেন। কেউ কেউ ‘খালা’ বলে সম্বোধন করেন। তাঁরা আরও জানান, তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি পরনের কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, তেল, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, কম্বল, স্যুয়েটার দেওয়া হয়। এমনকি ওষুধও দেওয়া হয়। চারজন চিকিৎসক নিয়মিত মুঠোফোনে চিকিৎসাসেবা দেন। মাঝেমধ্যে চিকিৎসাশিবির করা হয়।
টিনের ছাউনি থেকে ভবন
বিয়ের পর ১৯৯৮ সালে স্বামী অমরনাথ মুখার্জির সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান গৃহিণী জ্যোৎস্না মুখার্জি। সেই সময় উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে তিনটি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখেন। সেখান থেকে স্বপ্ন দেখেন সুযোগ পেলে নিজের গ্রামে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবেন। ২০০১ সালে হৃদ্রোগে স্বামী মারা গেলে অধরা থেকে যায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু তিনি দমে যাননি।
২০০৮ সালে সমসপুর গ্রামে একটি মাটির ঘরে এলাকার দুস্থ ও অসহায় বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া শুরু করলেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি তাঁদের কিছু টাকা, শাড়ি, কম্বল দিতে শুরু করলেন। একদিন বাবাকে জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। শুনে বাবা বিশ্বনাথ গাঙ্গুলী বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য ২০১০ সালে মেয়েকে পাঁচ বিঘা জমি লিখে দিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা মারা যান ২০১৬ সালে।
সেই জমিতে ২০১২ সালে শুরু হয় ওল্ড কেয়ার হোমের পথচলা। প্রথমে প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ছাউনি টিনের। প্রথম বছরেই ঠাঁই হয় ৪০ জন মায়ের। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০১৪ সালে এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে জেলা পরিষদ সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করে দেয়। কক্ষটি মায়েরা হলরুম হিসেবে ব্যবহার করেন। ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদ ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে টিনের ছাউনির জায়গায় ছয়টি কক্ষে ছাদ দেয়।
আনন্দ–বিনোদনে কাটে সময়
বৃদ্ধাশ্রমে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা থাকায় আনন্দেই দিন কাটে বাসিন্দাদের। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আম্বিয়া বেগম (৬৮) প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে আছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা আমাকে অবহেলা করত। তখন আমি আশ্রমে চলে আসি। সেই থেকে এখানে আছি। এখানে থাকতে ভালো লাগে। কোনো কিছুর অভাব নেই। এখন ছেলেরা বাড়ি যেতে বলে। মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’
বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সবাই মিলে গল্পের আসর বসে বৃদ্ধাশ্রমে। মাঝেমধ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে নাচ, গান এবং বিভিন্ন খেলার ব্যবস্থা থাকে। নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন তাঁরা। বছরে দুইবার বাইরে ঘুরতেও যান। নদের পাড়ে প্রায় ১০ ফুট ওপরে গাছের সঙ্গে একটি কাঠের ঘর করা হয়েছে। নাম টি হাউস। মাসে এক থেকে দুইবার সেখানে সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেন ‘আম্মু’। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে লুচি, সুজি, ডাল বা মুড়ি-চানাচুর মাখা খাওয়া। বাসিন্দাদের কারও মৃত্যুর পর মৃতদেহ গ্রহণের মতো আত্মীয়স্বজন না থাকলে তাঁদের দাফনের জন্য আট শতক জমি কেনা হয়েছে।
মুরাদগড় গ্রামের রোকেয়া বেগম (৭৫) বলেন, ‘আমার স্বামী বেঁচে নেই। ছেলেরা অবহেলা করত। এরপর আশ্রমে চলে আসি। ১৩ বছর ধরে এখানে আছি। ভালো আছি। আম্মু আমাদের খুব ভালো রেখেছেন।’
বৃদ্ধাশ্রমেরও নিজস্ব আয় আছে
একসময় ঢাকায় মোবাইল ফোনের ব্যবসা ছিল জ্যোৎস্না মুখার্জিদের। এই ব্যবসার আয়ে চলত বৃদ্ধাশ্রমটি। এখন মোবাইল ফোনের ব্যবসা নেই। স্থানীয় বাজারে তাঁর ভুসিমালের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া বাজারের বাড়ির তিনটি কক্ষ ভাড়া দেওয়া আছে। ব্যবসা ও বাড়িভাড়ার টাকা দিয়ে বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমের কিছু ব্যয় বহন করা হয়। তবে খরচের বড় অংশই আসে বৃদ্ধাশ্রমের নিজস্ব আয় থেকে।
এক ছেলেকে নিয়ে এখন জ্যোৎস্না মুখার্জির বেশির ভাগ সময় কাটে বৃদ্ধাশ্রমের দেখভাল করে। তিনি জানান, বৃদ্ধাশ্রমের জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়। বিভিন্ন ফলদ গাছ এবং বাঁশ রয়েছে। ৩টি গরু, ২টি ছাগল, ৩০ জোড়া কবুতর, ২৫টি মুরগি এবং ৪টি হাঁসও আছে। কৃষি এবং গবাদি পশুপাখি থেকে আয় দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম চলে। মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিবছর কিছু চালও পাওয়া যায়।
স্থানীয় তিনজন নারী নামমাত্র সম্মানীতে বৃদ্ধাশ্রমটি দেখাশোনা করেন উল্লেখ করে জ্যোৎস্না মুখার্জি বলেন, এখানে সব সময় ২০ থেকে ২৫ জন মা থাকেন। এখন সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। মায়েরা একসঙ্গে খেত থেকে শাক তোলেন, কাটেন, পরিষ্কার করেন এবং রান্নায় সহায়তা করেন। দেখে খুব ভালো লাগে।
ওল্ড কেয়ার হোমের পরিধি বাড়ানো নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখেন জ্যোৎস্না মুখার্জি। তিনি বলেন, ‘ওল্ড কেয়ার হোমে এখনো সীমানাপ্রাচীর দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছা নদের পাড়ে দুই কক্ষের একটি ভবন তুলব। সেখানে অন্তত পাঁচজন বৃদ্ধ বাবা থাকবেন।’
জ্যোৎস্না মুখার্জির কার্যক্রমে গর্বিত এলাকার বাসিন্দারা। সমসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাশেম আলী বলেন, ‘অজপাড়াগাঁয়ে এমন ভালো বৃদ্ধাশ্রম বাংলাদেশে আছে কি না, আমার জানা নেই। এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে থাকার পাশাপাশি পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সবকিছু বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ওষুধও দেওয়া হয়।’