Prothomalo:
2025-08-05@02:45:16 GMT

আসল সংস্কার জনগণই করেছে

Published: 5th, August 2025 GMT

গণ-অভ্যুত্থানের আগের বছরটিতে বাংলা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটা বিদ্বেষের মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে সবাই সবাইকে ‘বাঙ্গু’ হিসেবে উপহাস করছেন। বাঙ্গু বাম, বাঙ্গু ডান, বাঙ্গু বুদ্ধিজীবী, বাঙ্গু বিপ্লবী, বাঙ্গু কী না!

জাতির অন্তরের গভীরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ছিল ওই প্রবল আত্মমর্যাদার, সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করার, হেয় করার ছোঁয়াচে উপসর্গ। সম্ভবত এর মধ্যেই ছিল সমকালীন রাষ্ট্রীয় অচলায়তনকেই যে নড়ানো যাচ্ছে না, তার কোনো সংস্কারই আর সম্ভব না; সেই রাজনৈতিক হতাশার একটা যৌথ মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি। হাসিনার অপরাজেয়তার অসচেতন এক স্বীকৃতিও, হাসিনার সরকারকে কেউ নাড়াতে পারবে না—কাজেই সব তত্ত্ব, মতাদর্শ, রাজনীতিই বৃথা। সবাই হাস্যকরভাবে পর্যুদস্ত। অতএব, সবাই বাঙ্গু।

অদ্ভুত একটা বিষয়, গণ-অভ্যুত্থানের পুরো সময়টায় কাউকে বাঙ্গু বলতে দেখিনি। গত বছরের ১৬ জুলাই আমার এই বিস্ময়ের প্রকাশটা ছিল এমন: ‘জাতি শ্রদ্ধা অর্জন করে। দেখো, গত এক সপ্তাহে কেউ কাউকে বাঙ্গু বলেনি। কারণ, ওইটা ছিল আমাদের নিজেদের ভেতর নিজেদের অসম্মান। আমরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম, তাই আমরা নিজেদের কাছে বাঙ্গু হয়েছিলাম। একজন আরেকজনের দিকে আঙুল তুলে নিজের প্রতি ওই তিক্ততাকেই ঘৃণা আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কিছুটা বিশ্বাস জন্মাচ্ছে, অনেকটা ভালোবাসতে পারছি একজন আরেকজনকে।’

একটা গণ-অভ্যুত্থান যে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে নিজেদের প্রতি, বিপ্লবে পরিণত হতে পারলে তা বহু ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় দেশকে। একেকটা সংস্কার ক্লেদের, অমর্যাদার একেকটা নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলে, একেকটা সংস্কার আশাবাদ আর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে।

ঠিক এক বছরের মাথায় সংস্কার নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম, চব্বিশ বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান—সেই বিতর্ক চলেছে বহুদিন। আর এখন আলাপ দাঁড়িয়েছে ন্যূনতম কতটা সংস্কার হলে আমরা খুশি!

জাতি কি আবার আত্মগ্লানির বিষাক্ত বাঙ্গুযুগে প্রবেশ করবে?

২.

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের বিবেচনায় সংস্কার দুই ধরনের হতে পারত—

ক. যেসব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই সম্পন্ন করতে সক্ষম।

খ. সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয়গুলো, যা নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়।

দুই ধরনের সংস্কারের গুরুত্বের তুলনা চলে না। উভয়ই অপরিহার্য।

গণ-অভ্যুত্থানের যদি একটি নির্ধারক শক্তি থাকত, তাহলে অন্তর্নিহিত শক্তির গুণেই নিজস্ব রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী দুই ধরনের সংস্কারই শুরু হতে পারত। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান যতটা ছিল বিগত সরকারের প্রতি জনতার ক্রোধের প্রকাশ, এর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ততটা ছিল না। সে কারণেই সংস্কারের ভাগ্য ঝুলেছে দোদুল্যমান ও আত্মবিশ্বাসহীন এবং ভাগ্যক্রমে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের ওপর।

নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারও প্রথম ক্রমিকে উল্লেখ করা সেসব সংস্কার অনায়াসেই করে ফেলতে পারত, যার চাপে ভবিষ্যতে জনরায়ের বৈধতা নিয়ে নির্বাচিত সরকার এলেও সংবিধান সংস্কারের মতো মৌলিক প্রশ্নগুলো অনিবার্য হয়ে উঠত।

অচিরেই আমরা একটি বিপুল অক্ষম বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে পাব, ‘জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড’ ব্যবহার করতে না পেরে কোনো সঞ্চয় ছাড়াই যারা বুড়ো হবে। কয়েক বছর ধরে ট্রাফিক সিগন্যালে হাত পাততে থাকা বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমানতা তারই ইঙ্গিতবহ।

যেমন বেশ কটি গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও অপচয়ের মহামারির একটা বড় কারণ আমলাতান্ত্রিকতা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেরই একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক। বিশ্বব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্পের খরচ কীভাবে করা হবে, তার উদ্বেগজনক চিত্র মিলবে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বিশ্বব্যাংকের সিটা প্রকল্পের ব্যর্থতা ও অপচয়ের আশঙ্কা কেন’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে। এই প্রকল্পের ১০ শতাংশের সামান্য বেশি ব্যবহার করা হবে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য, ১৩ শতাংশের কাছাকাছি ব্যয় করা হবে পরামর্শকের জন্য! অথচ নিবন্ধটির বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তা লেখকেরা দেখিয়েছেন, যা কেনা হবে, সেই সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কম ব্যয়ে কাজটা করতে সক্ষম। এতে রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও বিপুল ব্যয় থেকে দেশ বেঁচে যাবে! অথচ আড়াই শ মিলিয়ন ডলার পূর্বপরিকল্পনামতো ব্যবহৃত হলে সফটওয়্যার নির্মাণ খাতে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ডেটা সিকিউরিটি হারাবে বাংলাদেশ।

উন্নয়নের নামে এ ধরনের অপচয়ই ছিল হাসিনা সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তি। অর্থনীতির সংস্কার যদি করতেই হয়, তাহলে এ ধরনের প্রকল্পগুলো আরও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে করা উচিত। প্রকল্পের খুঁটিনাটি তথ্য যদি না–ও দেওয়া যায়, তার মূল অংশগুলোকে বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও অংশীজনদের জন্য উন্মুক্ত রাখা সারা দুনিয়ার রীতি। অথচ এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই পর্যালোচনার সুবিধার্থে সিটা প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশখ্যাত ব্যক্তিরাও ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণ করছেন যথারীতি গোপনে, পুরোনো রীতিই অনুসরণ করে। অথচ আমলাতন্ত্রের বাইরে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি তৈরির মাধ্যমে এসব প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের বন্দোবস্ত করে তারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। এতে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে সেই রীতি ভাঙা কঠিন হতো।

বাংলাদেশে দুর্নীতি আর অপচয়ের লাগামছাড়া পরিস্থিতির মস্ত কারণ মন্ত্রণালয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে বিশেষজ্ঞদের কার্যকর ভূমিকা না থাকা। পৃথিবীর যে অল্প কিছু রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়গুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনপ্রশাসনের আমলারা প্রায় একচ্ছত্র ভূমিকা রাখেন, তার একটি বাংলাদেশ। পেশাদার কেউ তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্বে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না।

ফিরোজ আহমেদ: রাজনীতিবিদ; সদস্য, সংবিধান সংস্কার কমিশন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র সরক র র প রক শ র প রক ধরন র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ঠেকাতে অবশ্য সচেতন থাকতে হবে

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “এই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসন ঠেকাতে শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্য সচেতন থাকতে হবে এবং সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।”

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রবিবার (৩ আগস্ট) বিকালে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে ছাত্রদল আয়োজিত এক সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।

তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, “মনে রাখবে, যদি তোমরা আগামী দিন সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে যাও, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে, ইনশাল্লাহ তোমাদের সঙ্গে ভবিষ্যতেও তারা থাকবে। মনে রাখবে, বাংলাদেশের জনগণই বিএনপি, তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তির সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।”

আরো পড়ুন:

বাংলাদেশে বিভক্তি সৃষ্টি করার অনেক চেষ্টা হচ্ছে: ফখরুল

কোনোদিনই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেব না: ফখরুল

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “এই মুহূর্তে আমার সামনে উপস্থিত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় লাখো লাখো মুখ, তোমরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ।ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে তোমরাই প্রতিষ্ঠিত করবে নিজেদের অধিকার। আজকে প্রবীণ যারা, তাদের অভিজ্ঞতা, পরামর্শ আর তোমাদের বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকায় নির্মিত হবে ইনশাল্লাহ আগামী দিনের বাংলাদেশ, লাখো শহীদের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ।”

তারেক রহমান বলেন, “দেড় দশকের ফ্যাসবাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী হতাহত হয়েছে।মামলা, হামলা, জেল-জুলুম, নির্যাতন, খুন, গুম, অপহরণের শিকার হয়েছে ছাত্রদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। শুধু এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানেই চট্টগ্রামের ছাত্রদলনেতা ওয়াসিমসহ শতাধিক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছে আমাদের, আহত হয়েছে হাজার হাজার। গণঅভ্যুত্থানের সময় শুধু ছাত্রদলেরই দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।”

তারেক রহমান আরো বলেন, “পলাতক পরাজিত স্বৈরাচার নিষ্ঠুর নির্মমতা চালিয়েও ছাত্রদলের অগ্রযাত্রা দমিয়ে রাখতে পারে নাই। আজকের এই লাখো ছাত্র-ছাত্রী, জনতার সমাবেশ আজকে আবারও সেটি প্রমাণ করে দিয়েছে। একটি কথা তোমরা সবাই মনে রাখবে, যদি তোমরা আগামী দিন সয়াহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে যাও, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে, ইনশাল্লাহ তোমাদের সঙ্গে ভবিষ্যতেও তারা থাকবে। মনে রাখবে, বাংলাদেশের জনগণই বিএনপির তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তির সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।”

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সঞ্চালনা করছেন সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাসির।

ঢাকা/রায়হান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ঠেকাতে অবশ্য সচেতন থাকতে হবে