Prothomalo:
2025-09-18@01:25:59 GMT

তুমি সখা বৃক্ষের

Published: 16th, September 2025 GMT

‘গহন কোন বনের ধারে’ প্রকৃতিপুত্র দ্বিজেন শর্মার প্রায় কবিতার মতো ছন্দময় গদ্যে লেখা বহুল পঠিত বইটা আমাকে সম্মোহিত করে রাখে, যখনই বইটি হাতে তুলি। চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উদ্বেগের ভেতরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত কোটি মানুষের জীবন। মধ্যশরতের তাপপ্রবাহে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ। ইদানীং প্রকৃতি তার ছন্দে নেই। মাটি ছেড়ে গাছগাছালির শুকনো ডালপালা, ঝরাপাতারা দল বেঁধে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে দিকহারা আকাশ ছুঁতে চাওয়া দালানকোঠা ঘেঁষে, দেয়াল পেরিয়ে কুমুদিনী হাসপাতালের উঁচু ছাদের হলুদ চুড়োর ওপর দিয়ে কোথা দিয়ে কোথায় কোন দিকে উড়ে যাচ্ছে, তার ঠিকঠিকানা নেই। ডাকিনীর শাঁই শাঁই ছুটে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। খানিক পরে চাতালের সবুজ টিনের চালে চড়বড় করে বৃষ্টির শব্দে ভাবনার রেশ এলোমেলো হয়ে যায়। তার পরপরই একটানা মল্লার রাগে বৃষ্টির শব্দ—জনহীন বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, দূরের গ্রাম, ধুলোময় গাছপালা, উন্নয়নের তপ্ত নিশ্বাসে শুকিয়ে যাওয়া বিপর্যস্ত একচিলতে লৌহজং নদ, নদের উত্তর পাড়ে পড়ন্ত বেলার অভিশপ্ত চিতা, নাটমন্দিরের সারা দিন রোদে পোড়া উদ্‌ভ্রান্ত উঠোন—শরতের থেকে থেকে বৃষ্টিতে সব এখন ধুয়েমুছে জুড়িয়ে নিচ্ছে নিজেদের। সময়-সন্ন্যাসীর জটাজালে পড়ে সে ঘূর্ণি বাতাস বজ্রপাতে আরও পাগল হয়ে ওঠে। এদিকে দোর আঁটা ঘরে বসে বুকের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে, এ যাত্রায় টিকবে তো সব!

সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে, কি ঘরে কি বাইরে। বাইরের সন্ত্রাস-হাওয়ার তোড়ে ছিটকে ঘরে এলে ঘর তখন হয়ে ওঠে কারাগার। সেই কারাগারে বসেই এই সব ঝড়ের শব্দ শুনতে পাই, পাই বৃষ্টির শব্দও। এইটুকুই যা স্বস্তি। পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখের দুঃসময়ে খুব মনে পড়ে প্রকৃতিপুত্র অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে।

সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে, কি ঘরে কি বাইরে। বাইরের সন্ত্রাস-হাওয়ার তোড়ে ছিটকে ঘরে এলে ঘর তখন হয়ে ওঠে কারাগার। সেই কারাগারে বসেই এই সব ঝড়ের শব্দ শুনতে পাই, পাই বৃষ্টির শব্দও। এইটুকুই যা স্বস্তি। ধুলোময়, শব্দময়, ধোঁয়াময়, দুর্গন্ধময় প্রায় দম বন্ধ হওয়া পৃথিবীর নিশ্বাস নেওয়ার এই বুঝি সময়। অথচ সূর্য উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে থাকি পৃথিবীর আঁধার খোঁড়লে। পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখের দুঃসময়ে খুব মনে পড়ে প্রকৃতিপুত্র অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে। তিনি ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একরাশ অভিমান নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

দ্বিজেন শর্মা—প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে একটি অপরিহার্য সম্পদ, বৈষয়িক সম্পদ, তা আমাদের মনে করিয়ে দিতেন সব সময়। মনে করিয়ে দিতেন, আমাদের স্বার্থক্ষুধা এতটাই প্রবল যে নদীগুলোকেও গ্রাস করছি। ভয়ংকর ভবিতব্য আঁচ করতে পেরে একটি পরিকল্পিত নগর দেখার ইচ্ছা তাঁকে তাড়িত করত। যিনি কলম হাতে যোদ্ধার মতো সাহস করেছিলেন আদিবাসী অরণ্যজীবনের দর্শন ও বিজ্ঞান থেকে শক্তি নিয়ে দেশের ক্ষতবিক্ষত বনভূমি ও ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতির পক্ষে রুখে দাঁড়াতে। তিনি মনে রেখেছিলেন এবং অন্যকেও মনে করিয়ে দিতেন, ‘রৌদ্র, ব্যাপ্তিস্থান ও শ্যামলীমার মতো আদিকালের প্রভাবগুলোই আমাদের দেহ ও মনের স্রষ্টা। আপন স্বাভাবিক পরিবেশচ্যুত সব জীবের নিয়তি একটিই—ধ্বংস; কোথাও দ্রুত, কোথাও শ্লথ আর এই সাধারণ নিয়ম থেকে মানুষের অব্যাহতি নেই। এই সব জীবনোপকরণ থেকে শহর মানুষকে ছিনিয়ে এনেছে, জবরদস্তি চালিয়েছে, তাদের অভাবি রেখেছে, হতাশ ও অসুখী রেখেছে, নিষ্পিষ্ট করেছে। এমনকি নির্বীর্যও করে ফেলেছে। জীবনের অত্যন্ত জরুরি তিনটি সুখ—রৌদ্র, ব্যাপ্তিস্থান ও শ্যামলীমা হারিয়ে অট্টালিকার গর্ভে আটক ও পেট্রলের ধোঁয়ার গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ বড় বড় শহরে বন্দী ও অসুখী জীবন কাটায়। মানুষের জীবনে এই তিনটি শর্ত পূরণ করা না হলে কখনোই তার দেহ ও মনের স্বাস্থ্যোদ্ধার ঘটবে না।’

রৌদ্র, ব্যাপ্তিস্থান ও শ্যামলীমার মতো আদিকালের প্রভাবগুলোই আমাদের দেহ ও মনের স্রষ্টা। আপন স্বাভাবিক পরিবেশচ্যুত সব জীবের নিয়তি একটিই—ধ্বংস; কোথাও দ্রুত, কোথাও শ্লথ আর এই সাধারণ নিয়ম থেকে মানুষের অব্যাহতি নেই।দ্বিজেন শর্মা

আমাদের দেশে এই সব কথা কি কেউ মনে রাখে? দ্বিজেন শর্মার দীর্ঘ নিশ্বাস ‘কুরচি তোমার লাগি’ গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে তাঁর এই সব আবেদন। মানুষ ভেবেছিল, একদিন প্রকৃতির ওপর সে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করবে। কিন্তু তার সেই উচ্চাশা এখন হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রকৃতিকে বশ মানাতে গিয়ে আজ সে নিজেই কোণঠাসা। নিরুপায় মানুষ এখন প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে চায়, কিন্তু প্রকৃতির ভাষা তো সে জানে না!

‘পৃথিবীর গভীরতর অসুখ’ শিরোনামে একটি লেখায় অসাধারণ বর্ষারণ্য মাধবকুল ভ্রমণের বেদনায় স্মৃতি গভীর দীর্ঘশ্বাসের মতো মিশে আছে।.

..‘খটখট আওয়াজে হঠাৎ আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে। পাহাড়ের অনেক ওপরে কারা গাছ কাটছে। জলমর্মর চাপা পড়ে। প্রতিধ্বনিত এই নিঝুম শব্দস্রোতে কর্ণবিদারী হয়ে ওঠে। অসহ্য! আমি ওপরের দিকে তাকাই। জমাট অন্ধকারে কিছুই দৃষ্ট হয় না। খাশিয়াপুঞ্জির আলোর ফুলকিতে পরিবেশ আরও ভৌতিক হয়ে ওঠে। প্রকৃতির ওপর বলতকাররত কারা এই লম্পট? করাতকল, ইটভাটার মালিকের লোক? না, সরাসরি তারা কেউ নয়। এ হলো ঘনীভূত লোভের লাল জিহ্বা। আমি চিকো মান্দিস নই। এই জিহ্বা টেনে ধরার সাহস আমার নেই। অসহায় আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।’ তাঁর পরম সৌভাগ্য যে আজকের দলবদ্ধভাবে সিলেটের সাদাপাথর চুরির কাণ্ডটি তাঁকে দেখতে হয়নি!

লাগাতার ভোগবাদ ও অন্যায় লুটতরাজ, যুদ্ধ, অত্যাচার নিয়ে আজ গোটা বিশ্ব দুঃসহ যন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। সে যন্ত্রণা দ্বিজেন শর্মা প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করতেন। সে যন্ত্রণারই নাম দিয়ে ছিলেন পৃথিবীর ‘গভীরতর অসুখ’। তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ। বলতেন, ‘প্রজ্ঞা মানুষকে চিরদিন সংকট উত্তরণে আনুকূল্য দিয়েছে, এ যুগেও তা ব্যর্থ হবে না।...

দ্বিজেন শর্মা আমাদের জন্য তাঁর জীবনের স্মৃতিকথা রেখে গেছেন। সে এক অমূল্য সম্পদ। এই স্মৃতিকথা, মধুময় পৃথিবীর ধূলিতে তাঁর জীবনের একটি ধারাবাহিক নিরাভরণ আখ্যান। স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে যেমন অকপটে তাঁর জীবনসাধনা জেনে নেওয়া যায়, তেমনি তাঁর সমকালের বহুকৌণিক প্রতিচ্ছবিও দেখতে পাই। শৈশবেই তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রকৃতির প্রেমে, সে মুগ্ধতা থেকেই তিনি হেঁটে গেছেন নিসর্গের পথে তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে। শিক্ষালাভ ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, একাত্তরে প্রাণ হাতে নিয়ে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার উপাখ্যান, জীবনের তাগিদেই অনুবাদকের কাজ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায়—সেখানেও ছিল তাঁর অন্য রকম স্বপ্ন। সেই স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপি, অবশেষে দেশে ফেরা প্রকৃতির মাঝে; গবেষণায় নিজেকে সমার্পণ করেছেন বৃক্ষ, গুল্ম, তৃণলতায়। সবই তিনি লিখেছেন কী অসাধারণ অনুপম ভাষায়। কোথাও না আছে আমিত্বের বড়াই, না কাউকে খাটো করার বাগাড়ম্বরতা। দ্বিধাহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক-সহজাত ভালোবাসার কথা। এরই ভেতরে দেখতে পাই সোভিয়েত রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক অন্দরমহলের ভয়াবহ দুর্নীতির কথা। তখনই তিনি অনুভব করেছিলেন, পৃথিবীর আলো ক্রমে কমে আসছে। সতর্ক করে গেছেন বারবার তাঁর লেখায়, কথায়, কাজে। যেখানেই গেছেন, আমাদের প্রত্যাশার ঘট পূর্ণ করেছেন।

লাগাতার ভোগবাদ ও অন্যায় লুটতরাজ, যুদ্ধ, অত্যাচার নিয়ে আজ গোটা বিশ্ব দুঃসহ যন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। সে যন্ত্রণা দ্বিজেন শর্মা প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করতেন। সে যন্ত্রণারই নাম দিয়ে ছিলেন পৃথিবীর ‘গভীরতর অসুখ’। তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ। বলতেন, ‘প্রজ্ঞা মানুষকে চিরদিন সংকট উত্তরণে আনুকূল্য দিয়েছে, এ যুগেও তা ব্যর্থ হবে না।...সমাজ সজীব সত্তা বিধায় তার অন্তর্নিহিত পুনর্গঠনশক্তি আছে, সে আত্মরক্ষা করতে জানে, এভাবে হয়তো নিজে বাঁচবে, আমাদেরও বাঁচাবে।’ বর্তমান যে সংকট থেকে নাভিশ্বাস উঠছে পৃথিবীর, তা থেকে নিশ্চয়ই আমরা একদিন বেরিয়ে আসব। কেবল প্রয়োজন একটি প্রকৃতিবান্ধব ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা ক্রমাগত লোভ ও দখলি মনোভাব থেকে আমাদের সরিয়ে আনবে, ঠিক এ রকমই একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন দ্বিজেন শর্মা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক ত র জ বন র আম দ র র জ বন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় গুলিতে ৩ পুলিশ নিহত

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে গুলিতে অন্তত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুজন পুলিশ সদস্য।

অঙ্গরাজ্যটির পুলিশ কমিশনার ক্রিস্টোফার প্যারিস বুধবার সংবাদমাধ্যমকে হতাহতের এ তথ্য জানান।

ক্রিস্টোফার প্যারিসের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরের এ ঘটনায় সন্দেহভাজন বন্দুকধারীও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আহত দুই পুলিশ সদস্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

পেনসিলভানিয়ার গভর্নর জশ শাপিরো ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার বা প্রায় ১১৫ মাইল পশ্চিমে নর্থ কোডোরাস টাউনশিপে ঘটনাস্থলে গেছেন।

কে বা কারা এ গুলিবর্ষণের পেছনে জড়িত, সে সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল পামেলা বন্ডি পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ‘আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ’ বলে অভিহিত করেছেন।

পামেলা বন্ডি আরও বলেন, স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তার জন্য ফেডারেল এজেন্টরা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ