অবৈধভাবে পণ্য খালাসে বাধা দেওয়ার কারণেই চট্টগ্রামে কাস্টমস হাউসের দুই কর্মকর্তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি প্রায় ৪০ কোটি টাকা মূল্যের দুটি চালান জব্দ করা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমসে। এ কারণে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষুব্ধ একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে বলে ধারণা করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। সম্ভাব্য এসব কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের ডবলমুরিং থানার সিডিএ আবাসিক এলাকায় কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার ওপর হামলা হয়। তাঁরা হলেন রাজস্ব কর্মকর্তা মো.

আসাদুজ্জামান খান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বদরুল আরেফিন ভূঁইয়া।

ওই দুই কাস্টমস কর্মকর্তা একটি ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কারে ছিলেন। তিন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে এসে প্রাইভেট কারটি থামান। এরপর চাপাতি দিয়ে গাড়ির কাচে কোপ দেন। গাড়ির কাচ ভাঙার পাশাপাশি হামলাকারীরা একজন আরেকজনকে বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর’। তবে দুই কর্মকর্তা দ্রুত গাড়ি সরিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসেন।

ঘটনার বিষয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও রাজস্ব জালিয়াতি শনাক্ত করায় এ হামলা হতে পারে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে বড় অঙ্কের রাজস্ব জালিয়াতির একাধিক চেষ্টা এবং নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি আটকে দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এসব অভিযানে যুক্ত ছিলেন ওই দুই কর্মকর্তা। এত ক্ষুব্ধ হয়ে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রের কেউ তাঁদের ওপর হামলা করতে পারে।

৫ অক্টোবর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে এক ব্যক্তি ফোন করে ভয় দেখান, মেরে ফেলার হুমকি দেন। কসমেটিকসের দুটি চালান ছেড়ে দিতে বলেন। এ ঘটনায় পরদিন বন্দর থানায় একটি জিডি করেছিলাম। এ রকম নানা সময়ে হুমকি পেয়েছি।আসাদুজ্জমান খান, রাজস্ব কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম কাস্টমস

হামলার ঘটনার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ ও ঘনচিনি জব্দ করা হয়। এর আগে গত মে মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের নিষিদ্ধ সিগারেটের একটি চালান আটক করা হয়েছিল। আবার মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা বিপুল পরিমাণ প্রসাধনীও জব্দ করা হয়েছে। প্রসাধনী জব্দের পর মো. আসাদুজ্জামান খানকে মুঠোফোনে কল দিয়ে হুমকিও দেওয়া হয়। রাজস্ব বোর্ড বলছে, নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান, শুল্ক–কর ফাঁকি ও মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা প্রসাধনীর চালান জব্দ করার কারণে কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হয়ে থাকতে পারে।
সম্প্রতি পপি বীজ, ঘনচিনি, প্রসাধনী ও সিগারেটের চালান জব্দের ঘটনায় ক্ষুব্ধ চক্র এই হামলার পেছনে থাকতে পারে—এমন ধারণা করছে পুলিশও। হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজ, জব্দ করা চালানের নথি ও ফোনে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আলোচনায় পপি বীজ, ঘনচিনি, প্রসাধনীর চালান  

পাকিস্তান থেকে দুই কনটেইনারে আসার কথা ছিল পাখির খাদ্য। তবে কনটেইনার দুটি খুলে সম্প্রতি আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের কোরবানিগঞ্জের মেসার্স আদিব ট্রেডিং এই চালান আমদানি করে। আমদানি নথিতে ৩২ টন পাখির খাদ্য আমদানির তথ্য ছিল। গত ৯ অক্টোবর দুই কনটেইনারের চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে নামানো হয়। এরপর খালাসের জন্য বেসরকারি ডিপো ছাবের আহম্মেদ টিম্বার কোম্পানি লিমিটেডে নেওয়া হয়।

তবে এরই মধ্যে গোপন সংবাদে খবর পেয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা চালানটির খালাস স্থগিত করে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেন। সে অনুযায়ী ২২ অক্টোবর কনটেইনার দুটি খোলা হয়। উদ্ধার পণ্যের নমুনা তিনটি পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা পপি বীজ সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এতে সাত টন পাখির খাবার ও ২৫ টন পপি বীজ পাওয়া যায়। বিষয়টি গোপন রাখতে পাকিস্তানে পণ্য বোঝাই করার সময় কনটেইনারের দরজার মুখে পাখির খাদ্যের বস্তা রাখা হয়। ভেতরের দিকে রাখা হয় পপি বীজ।

অন্যদিকে ৩৯ টন ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেটের চালান আটক হয় গত অক্টোবরে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল এসপি ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হলো—২১৮ মিটফোর্ড রোড, বংশাল, ঢাকা। গত ৪ অক্টোবর পলিঅ্যালুনিমিয়াম ক্লোরাইড ঘোষণায় চীন থেকে তিনটি কনটেইনারে ৬৩ মেট্রিক টন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করে। চালানটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের পক্ষে সি বার্ড করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত ৭ অক্টোবর বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে।

পণ্যের চালানটি খালাসের জন্য ট্রাকে ওঠানোর পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা পণ্যের খালাস স্থগিত করেন। এরপর গত ২৮ অক্টোবর সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কায়িক পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষাকালে দুই ধরনের পণ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যার নমুনা চট্টগ্রামের কাস্টমস হাউস পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে ওই দুই শ্রেণির পণ্যের মধ্যে একটিতে ২৪ টন পলিঅ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গেলেও বাকি ৩৯ টন পণ্যকে ঘনচিনি হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ঘনচিনি একটি কৃত্রিম মিষ্টিকারক, যা সাধারণ চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, বেকারি আইটেম, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকলেট, কনডেন্সড মিল্ক ও শিশুখাদ্য তৈরিতে সাধারণ চিনির পরিবর্তে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে থাকেন।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ ও ঘনচিনি আটক করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী আমদানিকে কেন্দ্র করে কাস্টমসে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মালামাল আনা হচ্ছিল। গত দুই মাসে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন নম্বর থেকে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’

তারেক মাহমুদ আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন ফোন করে নিজেকে সাজ্জাদ পরিচয় দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। তবে কোন সাজ্জাদ, তা বলেননি। আমাদের ধারণা, কাস্টমসে অনিয়ম ধরার কারণেই এ হামলা হতে পারে।’

হামলার শিকার আসাদুজ্জমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এক ব্যক্তি ফোন করে ভয় দেখান, মেরে ফেলার হুমকি দেন। কসমেটিকসের দুটি চালান ছেড়ে দিতে বলেন। এ ঘটনায় পরদিন বন্দর থানায় একটি জিডি করেছিলাম। এ রকম নানা সময়ে হুমকি পেয়েছি।’

কী বলছে পুলিশ

ডবলমুরিং থানার কর্মকর্তারা বলছেন, কাস্টমস হাউসের সাম্প্রতিক জব্দ-অভিযান এবং হামলার সময়কার ঘটনাপ্রবাহ—দুটি বিষয়ই তদন্তের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পণ্য জব্দ ও অভিযানের ঘটনাগুলোর সঙ্গে হামলার সম্পর্ক আছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ওই কর্মকর্তারা যেসব চালান আটকে দিয়েছেন, সেখানে বড় অঙ্কের আর্থিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তাই প্রতিশোধমূলক হামলার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে ছিলেন। তদন্তে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক স টমস কর মকর ত র দ ই কর মকর ত প রথম আল ক আস দ জ জ র জন য চ ল নট পর ক ষ আমদ ন র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

হাটহাজারীতে ট্রাক ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নিহত ১

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখী সংঘর্ষে মো. কাওসার (২৬) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি মাইক্রোবাসের চালক বলে জানা গেছে। 

শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে হাটহাজারী উপজেলার নয়াহাট এলাকায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

আরো পড়ুন:

কুমিল্লায় ট্রলি উল্টে খালে, গোসলরত ৩ নারীর মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে গাড়িচাপায় মাদরাসা শিক্ষকের মৃত্যু

নাজিরহাট হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক মো. শাহেদ দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, শুক্রবার সকালে ফটিকছড়ি থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর অভিমুখী মাইক্রোবাসটি নয়াহাট ফরহাদাবাদ স্কুল অতিক্রম করার সময় বিপরীতমুখী ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসের চালক কাওসার ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন মাইক্রোবাসের ৫ যাত্রী।

মো. শাহেদ আরো জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনগুলো জব্দ করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ঢাকা/রেজাউল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ