তখন করোনাকাল। বিধিনিষেধে সবাই ঘরবন্দী। একই অবস্থা সুফি সুফিয়ানের (৩৮)। ছোট মেয়ে তখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। মেয়ের মা স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেন, তাই প্রতিদিনই তাঁকে বাইরে যেতে হয়। এ সময় মেয়ে কান্নাকাটি জুড়লে তার হাতে মুঠোফোন তুলে দিতেন। কিন্তু শিশুদের উপযোগী পছন্দমতো বাংলা গানের খোঁজ তিনি ইউটিউব কিংবা ফেসবুকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হন।

বাংলা গানের খোঁজ না পেয়ে সুফি মেয়েকে বাংলা বর্ণ শেখাতে গিয়ে মুখে মুখে বর্ণের গান করেন। তখনই তাঁর খেয়াল হয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোথাও স্বরবর্ণের ‘কার’ নিয়ে কোনো গান নেই। মেয়ের সঙ্গে হেলেদুলে গাইতে গাইতে তাৎক্ষণিক লিখলেন, ‘আ–কার বসে বর্ণ পরে, ই–কার আগে থাকে/ দীর্ঘ ঈ–কার উল্টে দেখো, বর্ণ ধরে রাখে।’ 

মেয়ের যখন নতুন দাঁত ওঠে, এমন অবস্থায় সুফি লিখলেন আরেকটি গান। এর কয়েকটা লাইন এমন, ‘যে করে না ব্রাশ/ তার দাঁতের ফাঁকে করে কালো কালো পোকা বাস/ সর্বনাশ সর্বনাশ সর্বনাশ।’

সুফি সুফিয়ান সিলেট নগরের শিবগঞ্জ লামাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। নগরের বারুতখানা এলাকায় ‘নাগরী’ নামে তাঁর একটা প্রকাশনা সংস্থা আছে। নিজে নাট্যকার, গীতিকার ও গল্পকার। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন একাধিক বই। এর মধ্যে উপন্যাস ‘পরিবন্ধু’, ‘কিশোরপুরান’, ‘টোটকাপুর’, নাটকের বই ‘ছোটোদের নাটক’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তাঁর শিশুতোষ গীতিনাটক ‘ভুতুম প্যাঁচা’ মঞ্চস্থ করেছে গীতবিতান বাংলাদেশ। স্ত্রী জ্যোৎস্না আক্তার ও এক মেয়ে ইয়ালিনা এশালকে নিয়ে তাঁর সংসার।

কথায় কথায় সুফি সুফিয়ান জানান, ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার পর রবি বর্মন নামের তাঁর এক বন্ধুর স্টুডিওতে বসে তিনটি গানের সুর তোলেন। কিন্তু এসব গান গাওয়ানোর শিল্পী পাচ্ছিলেন না। পরে কবি স্বপন দেবের কাছে দুটি গান পাঠিয়ে তাঁর ভাইয়ের মেয়ে আদৃতাকে গাওয়ানোর জন্য বলেন। পরের দিনই আদৃতা গান দুটি গেয়ে পাঠায়। এরপর আদৃতার কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় ওই গানগুলো। এসব রেকর্ড বাসায় বাজিয়ে সুফির মেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করত।

তখন সুফির মাথায় ভর করে শিশুদের জন্য গান লেখার বিষয়টি। তিনি শিশুদের জন্য একের পর এক গান লেখার পাশাপাশি সুর করতে থাকেন। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধু রাফি ইসলামের স্টুডিওতে ফ্রি ভয়েজ নেওয়ার সুযোগ পান। এটি তিনি কাজে লাগান। সেখানে তাঁর লেখা গানের রেকর্ড করার কাজ শুরু করেন।

নিজের লেখা গানগুলো ছড়িয়ে দিতে এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাংলা গানের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করতে সুফি সুফিয়ান ইউটিউবে একটি চ্যানেল চালু করেন। তাঁর চ্যানেলের নাম ‘মিউ ছোটোদের বায়োস্কোপ’। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এখানে একের পর এক তাঁর লেখা ও সুর করা গান আপলোড করতে থাকেন। এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন শিল্পী মিউতে গান করেছে, একজন বাদে সবাই শিশুশিল্পী।

এখানে আপলোড করা প্রতিটি গানই শিক্ষণীয়। শিশুরা এসব গান শুনে ও দেখে শেখার নানা উপকরণ পায়। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ভাগনিকে মডেল সাজিয়ে ভিডিও প্রস্তুত করে চ্যানেলে আপলোড করেছিলেন সুফি। কিন্তু সব গান এভাবে করা সময়সাপেক্ষ, তাই তিনি ইউটিউবে কার্টুন তৈরি করা শেখেন। বিভিন্ন সফটওয়্যার নাড়াচাড়া করে টুডি কার্টুন বানানো শিখে ফেলেন। ভিডিও আর কার্টুন মেকিং—দুটিই তিনি একা করেন।

পরে গানের ধরন অনুযায়ী সুফি নিজেই কার্টুন তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভিডিও তৈরি করতে থাকেন। সেগুলো তাঁর চ্যানেলে আপলোড করেন। কার্টুনে তিনি তৈরি করেন সুনির্দিষ্ট কয়েকটি মডেলও। চ্যানেল চালুর শুরুতে শিল্পী মামুন হোসাইন ও ইরতিজা কাগজীর তৈরি কার্টুনের দুটি মডেলও তিনি ভিডিওতে ব্যবহার করছেন।

সুফি সুফিয়ান বলেন, ‘মিউ ইতিমধ্যে কয়েক মিলিয়ন ভিউ কুড়িয়েছে। এমনও গান আছে, যেটির ভিউ হয়েছে আড়াই মিলিয়ন। এর বাইরে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ ভিউ হয়েছে—এমন গানের সংখ্যাও প্রচুর। কোনো ধরনের বুস্ট ছাড়াই মিউর দর্শক দিন দিন বাড়ছে। শিশুদের কথা ভেবে যে ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করেছি, এটা এখন অনেকের প্রশংসা কুড়াচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মানিকগঞ্জে হালনাগাদ নেই সরকারি ওয়েবসাইট

মানিকগঞ্জে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের ওয়েবসাইটগুলো দীর্ঘদিন ধরে হালনাগাদ না হওয়ায় সেবাগ্রহীতারা ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশনের যুগে জেলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটে নেই সদ্য প্রকাশিত তথ্য, আপডেট নেই নিরাপত্তা প্রোটোকল। এমনকি অনেক লিংক ঠিকমতো কাজও করে না। ফলে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিন দিন পুরনো ও অরক্ষিত ওয়েবসাইটগুলো ‘সাইবার নিরাপত্তা’ ঝুঁকিতে রয়েছে। 

জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল রাইজিংবিডিতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ‘চিকিৎসকের সহকারী পাচ্ছেন নির্বাচন কর্মকর্তার ফোন কল’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কয়েকটি দপ্তর ওয়েবসাইটগুলো হালনাগাদ করলেও বেশিরভাগ ওয়েবসাইট বছরের পর বছর অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে। 

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি সরকারি দপ্তরকে নিয়মিত ওয়েবসাইট হালনাগাদ করতে হবে। মাসে অন্তত একবার আপডেট নিশ্চিত করতে হবে। আর অ্যাক্সেসিবিলিটি ও নিরাপত্তা মানদণ্ডও পূরণ করতে হবে। কিন্তু মানিকগঞ্জে খুব কম ওয়েবসাইটই এসব মানদণ্ড অনুসরণ করছে।

জেলার সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, এলজিইডি, বন বিভাগ, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি দপ্তরসহ অন্তত ১৫টির বেশি ওয়েবসাইটে সর্বশেষ তথ্য আপডেট করা হয়নি। কিছু ওয়েবসাইট খুলতেই সার্ভার এরর দেখায়। আবার কোথাও পুরনো নোটিশ এখনো প্রথম পাতায় ঝুলছে। আর কয়েকটি ওয়েবসাইট শুধু কর্মকর্তা কর্মচারিদের তথ্য আপডেট করেন। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য আপডেট করেন না। আবার কোন কোন দপ্তরের কর্মকর্তা কয়েক বছর আগে বদলি হলেও তার নাম এখনও ওয়েবসাইটে শোভা পাচ্ছে। 

বেউথা এলাকার রিয়াদ হাসান বলেন, “ওয়েবসাইটগুলোতে কিছু তথ্য থাকলেও প্রয়োজন মাফিক তথ্য থাকে না। নিয়মিত হালনাগাদ না করায় অনেক সময় নট ফাউন্ড লেখা আসে। এতে সময় নষ্ট হয়, আবার অনেক সময় ভুল তথ্য নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়।”

নারী উদ্যোক্তা খাদিজা বেগম জানান, সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী নির্ধারিত সেবার হালনাগাদ তথ্য ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না। উন্নয়ন প্রকল্পের পূর্নাঙ্গ তথ্যও ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা হয় না। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সরকারি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

সাংবাদিক সোহেল হোসেন বলেন, “আমি প্রায় সময় বিভিন্ন দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিরভাগ সাইটেই বছরের পর বছর কোনো আপডেট নেই। অনেক ওয়েবসাইটে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তথ্য পর্যন্ত সঠিক নয়। যে কর্মকর্তা তিন বছর আগে বদলি হয়ে গেছেন, তার নাম এখনো সেখানে আছে।”

সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, “সরকারি তথ্য পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়েবসাইট। কিন্তু মানিকগঞ্জের ওয়েবসাইটগুলোর এই নাজুক অবস্থা ডিজিটাল সেবাকে পুরোপুরি ব্যাহত করছে। শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী, গবেষক, সাংবাদিক কেউই প্রয়োজনীয় তথ্য সময় মতো পাচ্ছেন না। জেলা পর্যায়ের ওয়েবসাইটগুলো দেখলে মনে হয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের নজরদারি নেই।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, “শুধু হালনাগাদ না থাকা নয়, এসব ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল। কোনো সিস্টেমে কোথায় দুর্বলতা আছে এবং সেই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে কেউ ঢুকতে পারে কি না এটা পরীক্ষা করাই হলো VAPT (ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড পেনেট্রেশন টেস্টিং)। সরকারি নির্দেশে থাকার পরও এসব মানা হচ্ছে না। ফলে এসব ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীরা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। একটি নিরাপদ, গতিশীল ও নিয়মিত পরিচালিত ওয়েবসাইট শুধু প্রশাসনিক সেবাই সহজ করে না; এটি সরকারি সিস্টেমের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি করে। এই পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।”

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( শিক্ষা ও আইসিটি) ফারজানা প্রিয়াংকা বলেন, “ওয়েবসাইটগুলো হালনাগাদ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রতিটি দপ্তরকে ওয়েবসাইট আপডেটের জন্য নির্দেশ দিয়েছি। কয়েকটি দপ্তর কাজ শুরু করেছে, বাকিরাও দ্রুত সম্পন্ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ