পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে, মুক্তিকামীদের উল্লাস
Published: 5th, December 2025 GMT
ঠাকুরগাঁও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় থানা নিয়ন্ত্রণে নেন। পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে পিছু হটে সবশেষ ঠাকুরগাঁও থানার ভুল্লিতে ঘাঁটি গাড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে না আসতে পারেন, তাই তারা বোমা মেরে ভুল্লি সেতুটি উড়িয়ে দেয়। তারা শহরের প্রবেশপথের জায়গায় জায়গায় মাইন পেতে রাখে। মিত্র বাহিনী ভুল্লি সেতু মেরামত করে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে যায়।
তবে মাইনের কারণে শহরে ঢুকতে দেরি হয়। ২ ডিসেম্বর প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সত্যপীর সেতু উড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল একের পর এক শহরে ঢুকে পড়ে। মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। মুক্তিকামী মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েন।
ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোর কথা উল্লেখ আছে ক্ল্যাসিক পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ এমদাদুল হকের লেখা মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও বইয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকাল থেকে শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল আসতে থাকে। পরে তারা এক হয়ে বিশাল মিছিল বের করে। চৌরাস্তায় গণজমায়েত হয়। ভাষণ হয়। মিছিলটি ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। কালীবাড়ি এলাকায় কেরামত আলী মোক্তারের বাড়ির সামনে গিয়ে মিছিলটি থেমে যায়। মিছিলের খবরে দক্ষিণ দিক থেকে দ্রুতগতিতে গাড়িতে করে ছুটে আসে ইপিআরের একদল সৈন্য। ইপিআরের সৈন্যরা ইতিমধ্যে বাঙালি-অবাঙালি ভাগে নিজেদের মতো করে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মোহাম্মদ আলী নামের এক রিকশাচালক সামনে চলে আসেন। ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনটি গুলির শব্দ হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তিনিই মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম শহীদ।
ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার সময়টিতে বহু মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান। কামরুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষকসূচিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ এমদাদুল হকের লেখা সংগ্রামী ঠাকুরগাঁও ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে লেখা হয়েছে, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উপস্থিতি ছিল না। ১৫ এপ্রিল তারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে গুলি করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢোকে। আতঙ্কে মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠাকুরগাঁও শহর জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁওয়ে অনেকগুলো গণহত্যার ঘটনা ঘটে। অন্যতম বড় একটি হলো জাটিভাঙ্গা গণহত্যা। কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের উত্তরের গণহত্যা ১৯৭১ বইয়ে জাটিভাঙ্গা বধ্যভূমি ও গণহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঠাকুরগাঁও সদরের জাটিভাঙ্গা গ্রামটি এখন বধ্যভূমির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। জাটিভাঙ্গা হাটসংলগ্ন পশ্চিম পাশে উপজেলা পরিষদের রাস্তার ওপরে একটি ছোট পুল। এরই নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালের শুকনো মাটি প্রায় এক হাজার মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে মাসে। গড়েয়া, আশপাশের গোপালপুর, পশ্চিম সুকানপুকুর, লউথুতি, ঠাঙ্গামেলী, কালিগঞ্জ, বাহাদুর বাজার, ঝাড়বাড়ি ও বীরগঞ্জ থানার বেশ কিছু এলাকা থেকে ভারতের দিকে পালিয়ে যেতে থাকা নিরীহ প্রায় এক হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়।
শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর। সেদিন তাঁরা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। নুর করিম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঠাকুরগাঁওহত্যাকাণ্ড ও বর্বরতার পথ পাড়ি দিয়ে বিজয়ের দিকে যেতে থাকে ঠাকুরগাঁও। ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার দিনের প্রত্যক্ষদর্শী জেলা শহরের অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক কামরুল ইসলাম। তখন তিনি ছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার সময়টিতে বহু মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান। সেই দিনের কথা ভুলে যাওয়ার নয়।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঠাকুরগাঁও জেলা কমান্ডের আহ্বায়ক নুর করিম বলেন, ৩ ডিসেম্বর সকালে বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন। শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা শহর। সেদিন তাঁরা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। সেই পতাকা পত পত করে উড়তে উড়তে যেন বিজয়ের কথা জানান দিচ্ছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড স ম বর ম হ ম মদ গণহত য প রক শ ঠ ক রগ ত হওয
এছাড়াও পড়ুন:
আজ ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস
আজ ৩ ডিসেম্বর, ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই এবং মুক্তিকামী জনগণের প্রতিরোধে চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে পাকিস্তানি সেনাদের। সেদিন, সকালে হাজার হাজার মানুষ মুক্ত ঠাকুরগাঁও শহরের রাস্তায় বের হয়ে আসেন। বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ।
ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ড আব্দুল মান্নান জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁয়েও পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় নির্যাতন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে মেতে ওঠে তারা। পাশাপাশি চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ। ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও।
আরো পড়ুন:
‘১৭ বছরে ৯৪ হাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা আড়াই লাখ করা হয়েছে’
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে পুলিশে চাকরি
এরই মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষ। তারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলোন দুর্বার প্রতিরোধ। ঠাকুরগাঁও তখন ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম. খাদেমুল বাশার। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ২৯ নভেম্বর এই মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর তারা শক্তি বৃদ্ধি করে সদলবলে প্রবেশ করে ঠাকুরগাঁয়ে।
তিনি জানান, ২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁয়ে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ লড়াইয়ে সে রাতেই শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোরে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়। সেদিন সকাল থেকেই ঠাকুরগাঁও শহরে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। তাদের অনেকের হাতে ছিল প্রিয় স্বদেশের পতাকা।
এলাকাবাসী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ছিল মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত গণকবর আর বধ্যভূমি। ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমিগুলো এখন বেহাল অবস্থায় রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা গণকবরগুলো দেখার কেউ নেই। অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমি এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
আব্দুল মজিদ বলেন, “ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুকানপুর ইউনিয়নে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে মারা যাওয়াদের শুকানপুকুরীতে মাটি চাপা দেয় তারা। আমাদের এই শুকানপুকুরী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি।”
রাজাগাঁও ইউনিয়নের বিমলা রাণী বলেন, “পাকিস্থানি বাহিনী আগে খরিলুপের বাড়িত আইছিল। খরিলুপের বাড়ি থেকে আসিল হামার বাড়ি। হামরা সবাই দৌঁড়াদৌঁড়ি করি। কিন্তু হামাক সবাকে ধরে নিয়ে আসিল। হামার বস্তির তামাক লোকলাকে ধরে নিয়ে আসিছিল। সবাকে লাইন করে দাড়ায় থুইল। ওই সময় মুই গর্বপতি ছিনু। মিলিটারি বন্দুনটা দিয়ে মোর পেটটাতে গুতা দিছে আর মুই কিছু কহিবা পারু না।”
ঢাকা/মঈনুদ্দীন/মাসুদ