অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের জ্বালানি–বাজার পরিকল্পিত ধ্বংসের শিকার। বছরের পর বছর ধরে জ্বালানি–বাজার একটি চক্রের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছে। যখন যে সরকারই থাকুক, তাদের কোনো নড়চড় হয় না। ডিপো থেকে পাম্প পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভেজাল মিশিয়ে জ্বালানিকে যানবাহন ধ্বংসের ‘বিষে’ পরিণত করেছে চক্রটি। পুরো সরবরাহশৃঙ্খলাজুড়ে নিম্নমানের ও ভেজাল তেল মিশিয়ে কোটি কোটি ভোক্তাকে পরিকল্পিতভাবে প্রতারিত করে যাচ্ছে তারা। অথচ কর্তৃপক্ষ আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার।

এই অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কেবল ব্যক্তিগত নয়; তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অর্থনীতির স্তরে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে
প্রতিফলিত হচ্ছে।

শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়ছে, জ্বালানির অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে। জনজীবনের প্রাত্যহিক যাতায়াত বিঘ্নিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হচ্ছে; জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতার অভাবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ-বৈশিষ্ট্যও নড়বড়ে হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ভেজাল মিশিয়ে ডিপো থেকেই বাজারে যাচ্ছে নিম্নমানের তেল। ভেজাল তেলের কারণে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের মাইলেজ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। একাধিক ভোক্তা বলেছেন, আগে প্রতি লিটারে ৮-৯ কিলোমিটার মাইলেজ পাওয়া যেত। কিন্তু দুই মাস ধরে মাইলেজ ৫-৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এ বিষয়ে বিএসটিআই অভিযান চালালেও তেলের মান পরীক্ষা হয় না।

আগে তেল চুরি হতো তাপমাত্রার অজুহাত দেখিয়ে। এখন তার সঙ্গে ভেজাল মেশানোর কায়দা যুক্ত হয়েছে। ডিপোতে এনে কম দামের ভেজাল তেল অকটেন-পেট্রলে মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ট্যাংকার মালিক, পাম্প মালিক সবাই জড়িত বলে শক্ত অভিযোগ আছে। কিন্তু মূল উৎস যে ডিপো, সেটিই অভিযানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে এটিকে আর নজরদারিতে অবহেলাজনিত অপরাধ বলা যাচ্ছে না। বরং এটি কাঠামোগত সহায়তায় প্রায় অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক চুরি।

ভেজাল তেলে চলা গাড়ি ও মোটরসাইকেল কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাইলেজ হারাচ্ছে, ট্যাংক ও কার্বুরেটর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে ধাতব ক্ষয় ধরছে এবং অনেক ক্ষেত্রে যানবাহনের কাঠামোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর ফলে একদিকে ব্যক্তির খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবহন খাতের দক্ষতা কমে যাচ্ছে। শিল্প ও বাণিজ্যে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে।

এ জালিয়াতির বিস্তৃত প্রভাব আরও গভীর। প্রতিদিনের যাতায়াত ব্যাহত হচ্ছে, রাষ্ট্রের জ্বালানিব্যবস্থার ওপর আস্থা কমছে, আর্থিক অপচয় বাড়ছে—এভাবে জাতীয় অর্থনীতিও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় তদারকির শৈথিল্য, পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা এবং অপরাধীদের প্রতি শিথিলতা এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে জরুরি তিনটি পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, ডিপো পর্যায়ে তেল পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব ও
বাধ্যতামূলক মান নিরীক্ষা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভেজাল–বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল, আর্থিক জরিমানা ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ভোক্তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য স্বচ্ছ ও সুলভ ব্যবস্থা গড়ে তুলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের গাড়িতে ভেজাল তেল ঢেলে অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ চলতে দেওয়া যায় না। জনগণের অর্থ, সময় ও নিরাপত্তা—এই তিন স্তম্ভ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রকে এখনই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ—কঠোর নজরদারি, কঠিন শাস্তি এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রত্যাবর্তন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ পর ক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষমতায় এলে দুর্নীতিতে লাগাম টানার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করবে বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে দেশে দুর্নীতিতে লাগাম টানার পাশাপাশি যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

নির্বাচন কমিশনের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতির মধ্যে আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলীয় এক অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন তারেক রহমান। বিএনপির উপস্থাপিত দেশ পরিচালনার পরিকল্পনাগুলো জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নেতা–কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তারেক রহমান বলেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ট্র্যাক রেকর্ড বিএনপির আছে। এ কাজটি করতে গিয়েই খালেদা জিয়া সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেছিল। সে সময় এ কমিশনকে এতটাই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল যে সরকারের কোনো বিষয়ে তদন্ত করতে চাইলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। এই নিয়ম স্বৈরাচার সরকার পাল্টে দিয়েছিল। বিএনপি জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় এলে প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে এটি আবার পরিবর্তন করা হবে।

দুর্নীতির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও ঠিক রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মতো আমাদের আরেকটি কাজে সফল হতে হবে। সেটাও দুর্নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটি হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। যেকোনো মূল্যে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।’

বিএনপির মূল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারেক রহমান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অতীত উদাহরণ বিএনপির আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিএনপি যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকেছে তখনো দলের কোনো সদস্য অন্যায় করলে চেষ্টা করেছে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে আইন দিয়ে বিচার করতে।’

বিজয়ের মাস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন তারেক রহমান। আজকের এই অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক দল ও ওলামা দলের নেতারা অংশ নেন।

নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, শিল্পে উন্নতি করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার কাজ অতীতে সফলভাবে করার ট্র্যাক রেকর্ড একমাত্র বিএনপির আছে। প্রতিটি কাজ আবার শুরুর পরিকল্পনা একমাত্র বিএনপিই উপস্থাপন করেছে। এই পরিকল্পনাগুলো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে।

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিএনপির কাছেই নিরাপদ দাবি করে তারেক রহমান বলেন, ‘একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণ আমাদের কাছে শুধু কথার ফুলঝুরি প্রত্যাশা করে না। জনগণ আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে যে আমরা কীভাবে দেশ পরিচালনা করব। জনগণের সমস্যাগুলোকে কীভাবে মিটআপ (মোকাবিলা) করব। পুরো পরিকল্পনা জনগণ আমাদের কাছে দেখতে চান।’

অনুষ্ঠানে বিএনপির যেসব পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে চাই, ইনশা আল্লাহ জনগণের রায় নিয়ে আগামীতে বিএনপি সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। সেই সরকারকে সফল করতে হলে সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিএনপির লাখ লাখ নেতা–কর্মীকে সহযোগিতা করতে হবে। পরিকল্পনা গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, কর্মসংস্থানসহ আটটি বিষয়ে কীভাবে কাজ করবে—এ নিয়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর জন্য ধারাবাহিক কর্মশালা বা ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে বিএনপি। শুক্রবার বাদে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলবে। এতে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ওলামা দলসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন অংশ নেবে। এরপর বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসের বাইরে অন্য কোনো একটি দিনে হবে সমাপনী অনুষ্ঠান।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আজকের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম প্রমুখ।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন আরেক যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান (সোহেল)।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গত ১৫ বছর ছিল ‘মানবাধিকার সংকটের ভয়াবহ সময়’
  • একটা দল ভোটের আগেই মনে করে ক্ষমতায় চলে গেছি: গোলাম পরওয়ার
  • নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত জেলেনস্কি
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরবে: গয়েশ্বর
  • যেকোনো মূল্যে ধানের শীষকে জেতাতে হবে: তারেক রহমান 
  • মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি: তারেক রহমান
  • দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসংহতি আন্দোলনের ১১ দফা প্রস্তাব
  • ক্ষমতায় এলে দুর্নীতিতে লাগাম টানার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করবে বিএনপি
  • আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাই: হাসনাত
  • জনগণ দায়িত্ব দিলে বিএনপি আবার দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত: তারেক রহমান