পরিবহন খাত বাঁচাতে দোষীদের ধরুন
Published: 25th, October 2025 GMT
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের জ্বালানি–বাজার পরিকল্পিত ধ্বংসের শিকার। বছরের পর বছর ধরে জ্বালানি–বাজার একটি চক্রের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছে। যখন যে সরকারই থাকুক, তাদের কোনো নড়চড় হয় না। ডিপো থেকে পাম্প পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভেজাল মিশিয়ে জ্বালানিকে যানবাহন ধ্বংসের ‘বিষে’ পরিণত করেছে চক্রটি। পুরো সরবরাহশৃঙ্খলাজুড়ে নিম্নমানের ও ভেজাল তেল মিশিয়ে কোটি কোটি ভোক্তাকে পরিকল্পিতভাবে প্রতারিত করে যাচ্ছে তারা। অথচ কর্তৃপক্ষ আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার।
এই অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কেবল ব্যক্তিগত নয়; তা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অর্থনীতির স্তরে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে
প্রতিফলিত হচ্ছে।
শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়ছে, জ্বালানির অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে। জনজীবনের প্রাত্যহিক যাতায়াত বিঘ্নিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হচ্ছে; জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতার অভাবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ-বৈশিষ্ট্যও নড়বড়ে হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ভেজাল মিশিয়ে ডিপো থেকেই বাজারে যাচ্ছে নিম্নমানের তেল। ভেজাল তেলের কারণে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের মাইলেজ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। একাধিক ভোক্তা বলেছেন, আগে প্রতি লিটারে ৮-৯ কিলোমিটার মাইলেজ পাওয়া যেত। কিন্তু দুই মাস ধরে মাইলেজ ৫-৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এ বিষয়ে বিএসটিআই অভিযান চালালেও তেলের মান পরীক্ষা হয় না।
আগে তেল চুরি হতো তাপমাত্রার অজুহাত দেখিয়ে। এখন তার সঙ্গে ভেজাল মেশানোর কায়দা যুক্ত হয়েছে। ডিপোতে এনে কম দামের ভেজাল তেল অকটেন-পেট্রলে মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ট্যাংকার মালিক, পাম্প মালিক সবাই জড়িত বলে শক্ত অভিযোগ আছে। কিন্তু মূল উৎস যে ডিপো, সেটিই অভিযানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে এটিকে আর নজরদারিতে অবহেলাজনিত অপরাধ বলা যাচ্ছে না। বরং এটি কাঠামোগত সহায়তায় প্রায় অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক চুরি।
ভেজাল তেলে চলা গাড়ি ও মোটরসাইকেল কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাইলেজ হারাচ্ছে, ট্যাংক ও কার্বুরেটর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে ধাতব ক্ষয় ধরছে এবং অনেক ক্ষেত্রে যানবাহনের কাঠামোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর ফলে একদিকে ব্যক্তির খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবহন খাতের দক্ষতা কমে যাচ্ছে। শিল্প ও বাণিজ্যে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে।
এ জালিয়াতির বিস্তৃত প্রভাব আরও গভীর। প্রতিদিনের যাতায়াত ব্যাহত হচ্ছে, রাষ্ট্রের জ্বালানিব্যবস্থার ওপর আস্থা কমছে, আর্থিক অপচয় বাড়ছে—এভাবে জাতীয় অর্থনীতিও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় তদারকির শৈথিল্য, পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা এবং অপরাধীদের প্রতি শিথিলতা এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে জরুরি তিনটি পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, ডিপো পর্যায়ে তেল পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব ও
বাধ্যতামূলক মান নিরীক্ষা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভেজাল–বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল, আর্থিক জরিমানা ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ভোক্তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য স্বচ্ছ ও সুলভ ব্যবস্থা গড়ে তুলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের গাড়িতে ভেজাল তেল ঢেলে অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ চলতে দেওয়া যায় না। জনগণের অর্থ, সময় ও নিরাপত্তা—এই তিন স্তম্ভ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রকে এখনই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ—কঠোর নজরদারি, কঠিন শাস্তি এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রত্যাবর্তন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জার্মানির নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
নবনিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজ আজ বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। একই সঙ্গে তাঁর দায়িত্বকালে বাংলাদেশ ও জার্মানির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন।
বৈঠকে রাষ্ট্রদূত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আরও বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছে, যা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। রাষ্ট্রদূত সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসে আলাপ করতে দেখে ভালো লাগছে। নির্বাচনের পরও এ ধরনের সংস্কার উদ্যোগ অব্যাহত থাকা উচিত।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করে সনদে স্বাক্ষরের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা ঐক্য ও পরিবর্তনের প্রতি যৌথ অঙ্গীকারের প্রতীক। তিনি আরও বলেন, এটি আসন্ন নির্বাচনের আগে আস্থা তৈরিতেও সহায়ক হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বৈঠকে রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জার্মানিতে পড়াশোনার আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রদূত দুই দেশের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে স্বাগত জানান। এ ছাড়া তাঁরা রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি এবং এ বিষয়ে জার্মানির সহায়তা নিয়েও আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইউরোপে জার্মানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তিনি আশা প্রকাশ করেন যে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। অধ্যাপক ইউনূস তরুণ প্রজন্মের শক্তির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তরুণেরা এখন সহজেই মত প্রকাশ করতে পারে, একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এবং অন্যায় চিহ্নিত করতে পারে। তবে তিনি ভুয়া তথ্যের ঝুঁকির ব্যাপারেও সতর্ক করেন। তিনি বলেন, ‘ভ্রান্ত তথ্য আসন্ন নির্বাচনের আগে আমাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।’