চট্টগ্রামের রাউজানে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। কখনো প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে, কখনো ছুরিকাঘাত বা পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় অস্ত্রধারী কিংবা মূল আসামিরা ধরা পড়ছে না। উদ্ধার হয়নি ঘটনায় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও। ফলে থামছে না খুনোখুনি। শেষ হয়নি এসব ঘটনায় হওয়া একটি মামলারও তদন্ত।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ১৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সর্বশেষ গত শনিবার যুবদলের কর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে গুলি করে খুন করা হয়। এর আগে ৭ অক্টোবর খুন হন বিএনপির কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হাকিম (৫২)। রাউজানের খামারবাড়ি থেকে ফেরার পথে হাটহাজারীর মদুনাঘাটে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা। এ ঘটনায়ও অস্ত্রধারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

আলমগীর ও হাকিম ছাড়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিরা হলেন বিএনপির কমর উদ্দিন, মো.

ইব্রাহিম, মানিক আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ সেলিম, দিদারুল আলম ও ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম (বিএনপির স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ)। বাকি চারজন আওয়ামী লীগের—আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া, আবু তাহের ও মুহাম্মদ হাসান।

আরও পড়ুনরাউজানে ১৮ দিনের মাথায় আরও এক যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা২৫ অক্টোবর ২০২৫

১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৪০ জনকে। পুলিশের দাবি, এর মধ্যে ৬০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের দাবি, অস্ত্রধারী ও মূল আসামিরা কেউই গ্রেপ্তার হয়নি।

এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুটি পক্ষের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুটি পক্ষের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে। নিহতদের মধ্যে বিএনপির সবাই কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী। প্রতিটি ঘটনার জন্য তাঁরা একে অপরকে দোষারোপ করে আসছেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ইতিমধ্যে অস্ত্রসহ অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তারে খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া তা রোধ করা কষ্টকর।

আরও পড়ুনকয়েক মিনিটে গাড়িতে ২২টি গুলি, ৪ সন্দেহভাজন আটক০৮ অক্টোবর ২০২৫

ঘুরেফিরে ‘সন্ত্রাসী’ রায়হানের নাম

৬ জুলাই রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ইশানভট্টের হাটে অটোরিকশায় করে আসা বোরকা পরা একদল অস্ত্রধারী প্রকাশ্যে বাজারের মধ্যে মুহাম্মদ সেলিম (৪০) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁর মুখে গুলি করা হয়। এই মামলার ১৭ আসামির মধ্যে অন্যতম ‘সন্ত্রাসী’ মোহাম্মদ রায়হান। নিহতের বাবা আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীরা একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না।

আরও পড়ুনমোটরসাইকেলে এসে গাড়িতে থাকা বিএনপি কর্মীকে গুলি করে হত্যা০৭ অক্টোবর ২০২৫যে বা যাঁরা জড়িত থাকুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি বিএনপির কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বেলায়েত হোসেন, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি

২২ এপ্রিল বেলা একটায় রাউজান সদর ইউনিয়নের পূর্ব রাউজান ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপাড়ায় সিএনজি ট্যাক্সি স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় ইব্রাহিম নামের যুবদলের এক কর্মীকে। এই মামলারও অন্যতম আসামি রায়হান।

বোরকা পরে এসে যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে গুলি করে পালিয়ে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হলে আলোচনায় উঠে আসে রায়হানের নাম। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিতেন রায়হান। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির সভায় যোগ দিতে শুরু করেন।

আরও পড়ুনহকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে বিএনপি নেতার হাত-পা ভেঙে দিল দুর্বৃত্তরা২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে রাউজানের চারাবটতল এলাকায় যুবদলের কর্মী আলমগীর আলমকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের ঘটনায় রায়হানের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে আলমগীরের কথোপকথনের একটি ভিডিও গত শনিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেও ‘সন্ত্রাসী’ রায়হানকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে আলমকে।

হত্যার ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলছেন আলমগীর। রায়হানের নাম উল্লেখ করে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি যে শোডাউন করিয়েছ আতঙ্ক সৃষ্টি করে, আমাকে তো মেরেও ফেলতে পারত, তুমি তো ও রকম মানুষ নিয়ে এসে আমাকে মেরে ফেলতে পার।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে তাড়ানোর জন্য তুমি এসব করছ।...ওরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে আমাকে থ্রেট দিতে।’

রায়হানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় জোড়া খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা।

আরও পড়ুন১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির পর মোটরসাইকেলে এসে ব্যবসায়ীকে গুলি১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া রাতে প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত আলমগীরের লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যার পর তাঁর লাশ দাফন করা হয়। রাতে মামলা হওয়ার কথা রয়েছে। ওসি আরও বলেন, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যা সেটা নিশ্চিত। অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করেছে পুলিশ। অভিযানও অব্যাহত আছে।

নিহতের স্ত্রী লাভলী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।’

রাউজানে বারবার খুনের ঘটনায় বিএনপির নাম আসাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনায় যে বা যারা জড়িত থাকুক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি বিএনপির কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুনরাউজানে যুবদল নেতাকে গুলি করে পাহাড়ি পথে পালিয়ে যান বোরকা পরা সন্ত্রাসীরা০৭ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক হত য ক ণ ড ব এনপ র ক খ ন র ঘটন ব এনপ র স এসব ঘটন প রক শ য ম হ ম মদ সন ত র স র জন ত ক ব যবস থ আলমগ র খ ন কর এল ক য় ঘটন য় য বদল

এছাড়াও পড়ুন:

সব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে: মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত ৩১ দফায় রেইনবো নেশনের বিষয়টি রয়েছে; অর্থাৎ সব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়া তোলা হবে।

আজ শুক্রবার বিকেলে গারো জাতিগোষ্ঠীর প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ কথা বলেন। রাজধানীর বনানী বিদ্যানিতেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে এ অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন করা হচ্ছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের সব সম্প্রদায়—বাঙালি, গারো বা অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী—সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা দিয়ে সব ধর্মবর্ণের মানুষকে এক পরিচয়ের বন্ধনে যুক্ত করেছেন। সেই ধারায় খালেদা জিয়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় পৃথক অধিদপ্তর গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি সরকারে এলে ঢাকায় একটি পৃথক সাংস্কৃতিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উৎসবগুলো সরকারিভাবে পালনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যা ও প্রয়োজনগুলো কাছ থেকে দেখেছেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহে গারো সম্প্রদায়ের সমাবেশে অংশ নিয়ে তিনি তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাপন ও উৎপাদনশীলতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

শেষে মির্জা ফখরুল বলেন, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও এই উৎসবে যোগ দিতে পেরে তিনি আনন্দিত ও গর্বিত। গারো সম্প্রদায়ের প্রাণবন্ত সংস্কৃতি বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘গারো সম্প্রদায়সহ দেশের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির গভীর শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। বড় পরিবর্তন আসতে হবে মানসিকতায়—নিজেদের কখনো দুর্বল মনে করা যাবে না। সংখ্যায় কম হতে পারেন, কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশি, আমরা আপনাদের ভাই।’

আজ রাাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে গারোদের ওয়ানগালা উদ্‌যাপন করা হয়। দুই কিশোরী সেজেছে গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাউজানে দুর্বৃত্তের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত
  • রাউজানে ১৮ দিনের মাথায় আরও এক যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা
  • সালমান শাহ হত্যা মামলার আসামিদের দেশত্যাগে সতর্ক পুলিশ
  • সব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে: মির্জা ফখরুল