তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াত, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি
Published: 11th, December 2025 GMT
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি।
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান জামায়াতের কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের।
এর আগে সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটও হবে একই দিন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা ছিল, তার অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘আমরা তফসিলকে স্বাগত জানাই এবং দেশবাসীকেও মোবারকবাদ জানাই।’
তফসিলের মাধ্যমে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনের ওপর বড় দায়িত্ব বর্তেছে উল্লেখ করে জামায়তের এই নেতা বলেন, ‘সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।’
এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, অতীতের তিনটি নির্বাচন—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এবার যেন সেই পুনরাবৃত্তি না ঘটে। একটি উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান দেশবাসী।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আদৌ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন আগে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে ইসির (নির্বাচন কমিশন) সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ জানিয়েছি। ইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছে। এখন আমরা দেখতে চাই, তারা বাস্তবে কী পদক্ষেপ নেয়।’
তফসিল ঘোষণার পরও পাঁচ দফা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি আমরা পেয়েছি। তবে গণভোটের দাবিটি (জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট) বহাল আছে। গণভোটে সংস্কারসমূহের পক্ষে জনগণকে “হ্যাঁ” ভোট দেওয়ার আহ্বান আমরা অব্যাহত রাখব।’
শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা শিগগিরই
জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের জোটের আসন সমঝোতা প্রসঙ্গে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনেই প্রাথমিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে আট দলের শীর্ষ নেতারা আলোচনায় বসবেন। খুব শিগগিরই আমরা যৌথভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করব। আশা করি, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ঘোষণা দিতে পারব।’
সর্বাধিক আসনে জয়ের লক্ষ্যে যেসব আসনে যাঁদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে জানান জামায়াতের এই নেতা। তিনি বলেন, আট দলের শীর্ষ নেতারা এবং বিভিন্ন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও মনোনয়ন বিবেচনায় রাখা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
আইনশৃঙ্খলার অবনতি: অপরাধীরা কেন এতটা বেপরোয়া
প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে যে সংবাদগুলো আমাদের সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে, তা হলো হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই ও নৃশংস সব অপরাধের খবর। সাধারণ মানুষের মনে আজ এক বড় প্রশ্ন—আইনশৃঙ্খলা কি কেবলই কিতাবি বুলি? অপরাধীরা কেন দিন দিন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত বেশ কিছু কারণ উঠে আসে। অপরাধীদের এই ‘বেপরোয়া’ হয়ে ওঠার পেছনে কেবল একটি কারণ দায়ী নয়, বরং এটি একটি বহুমুখী সংকটের সমষ্টি।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দীর্ঘসূত্রতাঅপরাধীদের বেপরোয়া হওয়ার প্রধান কারণ হলো ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’। যখন একজন অপরাধী দেখে, গুরুতর অপরাধ করেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সহজেই বেরিয়ে আসা যায়, তখন তার সাহস বহুগুণ বেড়ে যায়। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার নজির সমাজে এতটাই প্রবল যে সাধারণ মানুষ বিচার চাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা এবং সাক্ষীর অভাবে বিচার না হওয়া অপরাধীদের জন্য একধরনের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ হিসেবে কাজ করে।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও পেশিশক্তির দাপটআমাদের সমাজব্যবস্থায় অপরাধ ও রাজনীতির এক অশুভ আঁতাত লক্ষ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা কোনো না কোনো প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে। যখন কোনো অপরাধী জানে যে তার মাথার ওপর ‘বড় ভাই’ বা ‘গডফাদার’-এর হাত আছে, তখন সে পুলিশ বা প্রশাসনকে তোয়াক্কা করে না। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলদারি এখন ওপেন সিক্রেট। এই ক্ষমতার দম্ভই তাদের বেপরোয়া করে তোলে।
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়আইন দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যদি না সমাজের মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত থাকে। বর্তমানে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমরা এক চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং সন্তানদের ওপর নজরদারির ঘাটতি কিশোর অপরাধ বা ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ তৈরির মূল কারণ। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রমাণ করে, সমাজে সহনশীলতা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
মাদকের ভয়াবহ বিস্তারঅপরাধ জগতের জ্বালানি হলো মাদক। দেশের আনাচকানাচে মাদকের সহজলভ্যতা যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই অনেকে ছিনতাই, ডাকাতি, এমনকি খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ফলে তার পক্ষে যেকোনো নৃশংস কাজ করা সম্ভব হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতাপুলিশ বা প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক সময় জনবলসংকট, পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। আবার রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তখন অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়।
এই অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
যেসব পদক্ষেপ নিতে হবেআইনের সুশাসন: অপরাধী যে–ই হোক, তার রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় বিবেচনা না করে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশি সংস্কার: পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি জনবান্ধব ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
সামাজিক প্রতিরোধ: পাড়া-মহল্লায় মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা ও পারিবারিক সময় দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কর্মসংস্থান: বেকারত্ব অপরাধের অন্যতম কারণ। যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে অপরাধপ্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে।
আইনশৃঙ্খলার এই অবনতি কোনো একক গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, এটি আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের সংকট। অপরাধীরা যখন বেপরোয়া হয়, তখন সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ভূলুণ্ঠিত হয়। একটি নিরাপদ, সুন্দর ও ভীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কেবল এক অরাজকতার রাজ্য রেখে যাব। এখনই সময় রুখে দাঁড়ানোর।
হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়