যৌন হয়রানির অভিযোগ কমিটি: বাইরের সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা নেই
Published: 11th, December 2025 GMT
কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে ২০০৯ সালে যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল, অভিযোগ তদন্ত ও পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি থাকবে। নিরপেক্ষতা রাখার জন্য ওই অভিযোগ কমিটির দুজন সদস্যকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নিতে হবে, যাঁরা জেন্ডার ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কাজ করেন।
তবে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় অভিযোগ কমিটিতে বাইরের কাউকে রাখার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাপ্যতা সাপেক্ষে বাইরের সদস্য রাখা যাবে।
বাইরের সদস্য রাখার বিষয়টিকে ঐচ্ছিক রাখার বিরুদ্ধে অনেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, বাইরের সদস্য না রাখলে অভিযোগকারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হবে। প্রতিষ্ঠান নিজেদের লোক দিয়ে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জানা গেছে, মূলত পোশাকশিল্প কারখানার মালিকদের সংগঠনগুলোর আপত্তিতে এই বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে না। কারখানা মালিকেরা চান না তাঁদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বাইরের লোকজনের কাছে প্রকাশ হোক।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্টের রায়ের পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইনের খসড়া তৈরি করেছিল। সময়ে সময়ে প্রকল্পের আওতায় সেসব খসড়া জমা দেওয়া হয়েছিল মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে। বাংলাদেশ আইন কমিশন শুরুতে এবং অনেক পরে ২০২১ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন খসড়া তৈরি করে। এর মাঝে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ কিছু প্রতিষ্ঠান খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে। তবে এত বছরেও সেসব খসড়া আইনে রূপ পায়নি। সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আইন করার জন্য উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত এ খসড়ায় অভিযোগ কমিটিতে বাইরের সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে ‘প্রাপ্যতা সাপেক্ষে’ সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। কমিটিতে বাইরের উপযুক্ত সদস্য রাখার মতো এত লোক পাওয়া যাবে না বলে যুক্তি দেখানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বৈঠকে।
চূড়ান্ত খসড়ার বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইন প্রণয়নে এখনো আরও অনেক প্রক্রিয়া বাকি রয়ে গেছে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যৌন হয়রানির অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। তাই অভিযোগ কমিটিতে বাইরের সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক রাখা উচিত। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যদি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিশ্বস্ত হোন বা করিতকর্মা লোক হন, তাহলে তাঁকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করার একটি প্রবণতা থাকে।‘ভুক্তভোগী বিচার পাবে না’
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যৌন হয়রানির অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। তাই অভিযোগ কমিটিতে বাইরের সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক রাখা উচিত। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যদি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিশ্বস্ত হোন বা করিতকর্মা লোক হন, তাহলে তাঁকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করার একটি প্রবণতা থাকে। তিনি বলেন, এমনিতেই সহজে যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে চান না নারীরা। এর ওপর কমিটির মধ্যে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, ভুক্তভোগীরা তাহলে অভিযোগ করতে আসবে না। প্রতিকার না পেলে যৌন হয়রানির ঘটনা আরও বেড়ে যাবে।
খসড়ায় কমিটিতে বাইরের সদস্য না রাখা ও একই প্রতিষ্ঠানে একাধিক কমিটি রাখার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের প্রধান মির্জা তাসলিমা সুলতানা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যৌন হয়রানির কারণে অনেক মেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। কমিটিতে বাইরের সদস্য না থাকলে ভুক্তভোগী বিচার পাবে না।
এমনিতেই সহজে যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে চান না নারীরা। এর ওপর কমিটির মধ্যে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, ভুক্তভোগীরা তাহলে অভিযোগ করতে আসবেন নাসারা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীএকই প্রতিষ্ঠানে একাধিক কমিটি রাখার বিরুদ্ধে অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭টি বিভাগ আছে। এত বিভাগে এত সংখ্যক বাইরের সদস্য রাখা সম্ভব নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কমিটি রাখা দরকার। তা না হলে অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ করা যাবে না।
যা বলছেন পোশাক কারখানার মালিকেরা
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কখনো অভিযোগ কমিটিতে বাইরের লোক রাখার বিষয়ে আপত্তি করেননি। তবে কারখানার ভেতর বাইরের লোক না থাকাই ভালো। তিনি বলেন, ‘বাইরের এত উপযুক্ত লোক খুঁজে বের করা কঠিন। তাঁরা যে নারীর পক্ষে কাজ করেন, সেটা কে সাক্ষ্য দেবে! নারী অধিকারভিত্তিক বা নানা সংগঠনের নাম নিয়ে বিদেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করতে পারেন কেউ।’ সরকারি দপ্তর থেকে বাইরের কোনো ব্যক্তিকে রাখলে তাঁরা আপত্তি করবেন না বলে জানান তিনি।
আর বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, শ্রমিক ফেডারেশনের নারীনেত্রীরা কমিটিতে থাকতেই পারেন। তবে বাইরে সদস্য রাখার বিষয়টি উন্মুক্ত রাখা যাবে না। সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে, কারা থাকতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ৩৩২ ধারায় যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ৩৩২ক ধারায় কমিটিতে জেন্ডার ও যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের দুজন বাইরের সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে কমিটিতে যৌন হয়রানির কোনো কিছু উল্লেখ করা নেই। এ ধারাগুলো নতুন সংযোজন করা হয়েছে।
বাইরের এত উপযুক্ত লোক খুঁজে বের করা কঠিন। তাঁরা যে নারীর পক্ষে কাজ করেন, সেটা কে সাক্ষ্য দেবে! নারী অধিকারভিত্তিক বা নানা সংগঠনের নাম নিয়ে বিদেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করতে পারেন কেউ।বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমহাইকোর্টের সেই রায়
কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে সংস্থার তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ২০০৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০০৯ সালের ১৪ মে রিট আবেদনের পক্ষে নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন।
২০০৯ সালের রায়ের প্রেক্ষাপটে তুলে আনা হয়েছিল, ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের আলোচিত বিক্ষোভের কথা। এ ধরনের নিপীড়নের বিচার চাইতে একটি আইনি কাঠামো চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকদের দাবির কথা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এক নারী কর্মকর্তার আদালতে দ্বারস্থ হওয়া ও উল্টো সামাজিক চাপে হেনস্তা হয়ে চাকরি হারানো, ২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর অভিযোগ এবং পোশাক কারখানা, গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) পুরুষ সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ১৯টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয় রায়ে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে, অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা ও সুপারিশ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব কর্মক্ষেত্রে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠন করবেন। কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হবে, যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী। কমিটির দুজন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হবে। যে প্রতিষ্ঠান জেন্ডার ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করে।
নারীর জন্য আইনটি খুব জরুরি
কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর তৃতীয় অধ্যায়ে ‘প্রশাসনিক কাঠামো, অভিযোগ দাখিল ও তদন্ত ইত্যাদি’ শিরোনামে ৬ ধারার ৫ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি মূলত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত হবে এবং প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ-সম্পর্কিত বিষয়ে দক্ষতা বা আইনগত জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অন্তত দুজন বহিঃসদস্য নিয়োগ করতে হবে।
৬ ধারায় আরও বলা হয়েছে, অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা ও সুপারিশ করার জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করবে। তবে যেখানে কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিস বা প্রশাসনিক ইউনিট বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত, সে ক্ষেত্রে সব প্রশাসনিক ইউনিট বা অফিসে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে একাধিক বিভাগ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করতে পারবে।
প্রাপ্যতা সাপেক্ষে না বলে কমিটিতে বাইরের সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক থাকলে ভালো হতো।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীনঅভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি আহ্বায়কসহ সর্বনিম্ন পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে। কমিটি এর অধিক সদস্যের সমন্বয়েও গঠিত হতে পারবে, তবে সদস্যসংখ্যা বিজোড় হতে হবে। প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, কমিটির আহ্বায়ক হবেন প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মধ্যে একজন উচ্চপর্যায়ে কর্মরত নারী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ নারী সদস্য। কমিটির ৫০ শতাংশ সদস্য নারী হবেন।
বহিরাগত সদস্য অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির কার্যধারা পরিচালনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে নির্ধারিত ফি বা ভাতা পাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাপ্যতা সাপেক্ষে না বলে কমিটিতে বাইরের সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক থাকলে ভালো হতো। তিনি বলেন, নারীর জন্য আইনটি খুব জরুরি। দেশের কোনো আইনে এই প্রথম যৌন হয়রানি বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথাযথ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ করা ও অভিযোগ তদন্ত করার প্রক্রিয়া, আইনের কাঠামোয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রাখা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা, স্থানীয় কমিটি গঠন, আইন বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নজরদারিতে সরকারি কমিটি গঠন, অভিযোগ কমিটিতে প্রতিকার না পেলে ভুক্তভোগী আদালতে যেতে পারবেন ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়েছে। এসব দিক খুব ইতিবাচক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সদস য র খ র ব ষয়ট য ন হয়র ন র প রথম আল ক ম নব ধ ক র র র জন য প র প যত সদস য ন আইনজ ব গঠন কর ষ ট কর ক জ কর কম ট র আপত ত তদন ত সরক র খসড় য় স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
২২টি যুদ্ধের পর শত্রুমুক্ত হয় কুষ্টিয়া
আজ ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্তদিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম, ২২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অসংখ্য নীরব ত্যাগের মধ্যদিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কুষ্টিয়া থেকে বিতাড়িত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কালেক্টরেট চত্বরে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই কুষ্টিয়া ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম দিকে এখানে ইপিআর, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
আরো পড়ুন:
টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর
৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর
কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রতিরোধে যোগ দেন, যা পরবর্তীতে সুসংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে রূপ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস জুড়ে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা হামলা, সম্মুখযুদ্ধ ও প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় চূড়ান্ত মুক্তির পথ।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৬ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর, খোকসা, কুমারখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর সুসজ্জিত ঘাঁটির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালান। পাকবাহিনীর ক্যাম্প, ব্রিজ, সড়ক ও রসদ সরবরাহ লাইনে ধারাবাহিক আক্রমণ চালিয়ে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়। প্রতিটি যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। তারা কুষ্টিয়ায় অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহরের প্রবেশমুখ, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনার আশপাশে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে গোলাগুলি, মর্টার শেল ও ভারী অস্ত্রের প্রচণ্ড গর্জনে পুরো শহর কেঁপে ওঠে। কৌশলগত স্থানে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে দেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে ও আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তাদের অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং দিনটিকেই ‘কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১১ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত কুষ্টিয়া শহরের কালেক্টরেট চত্বরে তৎকালীন রাজনৈতিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় প্রাদেশিক পরিষদের জোনাল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরীসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত থেকে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানান। এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই প্রতীকীভাবে স্বাধীন কুষ্টিয়ার জন্ম এবং মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালুর সূচনা ঘটে। ।
প্রতি বছরের মতো এবারো কুষ্টিয়া মুক্তদিবস উপলক্ষে কালেক্টরেট চত্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মোনাজাত, র্যালি পরবর্তী শহীদ স্মৃতিস্মম্ভ চত্বরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিবসটি উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। শহীদ পরিবার ও জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরছেন।
ঢাকা/কাঞ্চন/মাসুদ