সুখ এমন একটি শব্দ, যার পেছনে পৃথিবীর সব মানুষ নিরন্তর ছুটে চলে। তবে এই শব্দের অর্থ সবার কাছে এক নয়। জীবনের অবস্থান, আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুখের সংজ্ঞাও বদলে যায়। ধনীদের কাছে যেখানে সুখ মানে আরাম-আয়েশ, বিলাসিতা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সেখানে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে সুখের অর্থ অনেক সহজ, অনেক বাস্তব এবং অনেক বেশি অনুভবের। তারা সুখ খোঁজে বড় স্বপ্নে নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট প্রাপ্তির মধে৵।

নিম্নবিত্ত মানুষ প্রতিদিন সংগ্রাম করে জীবনযাপন করেন। তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিন যেন নতুন একটি যুদ্ধ। সকাল শুরু হয় জীবিকার চিন্তায়, আর রাত শেষ হয় পরের দিনের ভাবনায়। তবু এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তারা সুখ খুঁজে নিতে জানে। এক বেলা পেট ভরে খেতে পারা, কাজ শেষে ক্লান্ত দেহে শান্তির ঘুম, সন্তানদের হাসিমুখ—এই সাধারণ বিষয়গুলোই তাদের কাছে অমূল্য সুখ। যেখানে ধনী মানুষ অনেক কিছু পেয়েও তৃপ্ত না, সেখানে এই মানুষগুলো অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।

নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের সবচেয়ে বড় উৎস হলো পরিবার। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা। একজন বাবা সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করেন শুধু এই আশায় যে সন্তানেরা দুই বেলা খেতে পারবে। একজন মা নিজের কষ্ট লুকিয়ে সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চান। ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা, দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, একসঙ্গে বসে সাধারণ খাবার খাওয়া—এই ছোট ছোট মুহূর্তই তাদের কাছে জীবনের বড় সুখ হয়ে ওঠে।

তা ছাড়া নিম্নবিত্ত মানুষের চাওয়ার পরিধি খুব বড় নয়। তাঁরা আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখেন না, বিলাসী জীবনের কল্পনায় বিভোর হন না। তাঁদের চাওয়া খুব সাধারণ—একটু নিশ্চয়তা, একটু শান্তি আর পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি। এ কারণে তাঁরা ছোট সুখে বড় আনন্দ পান। কেউ নতুন জামা কিনতে না পারলে সন্তানের পুরোনো জামা সেলাই করে নতুন করে পরাতে পেরে আনন্দ পান। আবার কোনো দিন সন্তানের ভালো ফল দেখে ভুলে যান নিজের সব কষ্ট।

নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের আরেকটি দিক হলো সহনশীলতা। তাঁরা কষ্ট সহ্য করতে জানেন, অভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। অনেক সময় প্রতিকূলতার মধে৵ও তাঁদের মুখে হাসি লেগে থাকে। এই হাসি তাঁদের চরিত্রের শক্তি প্রকাশ করে। তাঁরা জানেন জীবনের পথ সহজ নয়, তবুও জীবনের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা কমে না; বরং কষ্টের মধে৵ও তাঁরা হাসতে শেখেন, আনন্দ খোঁজেন।

এই ব্যস্ত শহরে এমন সুখের চিত্র অহরহ। যেমন একজন রিকশাচালক সারা দিন রোদ-বৃষ্টিতে মানুষের বোঝা টেনে নিয়ে বেড়ান। শরীর ভেঙে গেলেও রাতে ঘরে ফিরে যখন সন্তান তাঁর কাছে ছুটে আসে, তখন সে সব কষ্ট ভুলে যায়। সন্তানের সেই নিষ্পাপ হাসিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ।

একজন পোশাকশ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তবু মাসের শেষে যখন তিনি বেতন পান এবং সেই টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনেন, তখন তাঁর মনে গভীর তৃপ্তি অনুভব হয়। পরিবারের মুখে হাসি ফুটলেই তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন।

নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখ ক্ষণস্থায়ী হলেও গভীর। হয়তো আজ ভালো খেতে পেলেন, কাল পেলেন না; আজ কাজ আছে, কাল নেই। তবুও যখন সুযোগ আসে, তাঁরা সেই সুখ পুরো হৃদয় দিয়ে উপভোগ করেন। তাঁরা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা জানেন, তবুও বর্তমানকে উপভোগ করতে শেখেন। এটাই তাঁদের জীবনের বিশেষ দিক।

আমরা অনেক সময় সুখকে বড় বড় জিনিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি—বড় বাড়ি, দামি গাড়ি, প্রচুর টাকা; কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন আমাদের শেখায় সুখ আসলে মানুষের মনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যাঁর মন তৃপ্ত, সেই মানুষই সুখী। টাকা সুখ কিনতে পারে; কিন্তু শান্তি কিনতে পারে না। নিম্নবিত্ত মানুষ হয়তো ধনী নয়; কিন্তু অনেক সময় তাঁরা শান্তির দিক দিয়ে ধনীদের থেকেও ধনী।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে কষ্ট বেশি; কিন্তু সেই কষ্টের মধে৵ই তাঁরা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পান। তাঁরা মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে জানেন। সাহায্যের হাত বাড়ান, সহানুভূতি বোঝেন, অন্যের দুঃখে কাঁদতে পারেন। এই মানবিক গুণাবলিই তাঁদের সুখকে অর্থবহ করে তোলে।

পরিশেষে বলা যায়, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের সংজ্ঞা বইয়ের পাতায় লেখা কোনো তত্ত্ব নয়; বরং জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠা এক অনুভূতি। তাঁদের সুখ বড় না হলেও সত্যিকারের। তাঁদের আনন্দ অল্প হলেও গভীর। তাঁরা আমাদের শেখায়—জীবন মানে শুধু পাওয়ার হিসাব নয়; বরং যা আছে তা নিয়ে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতাই প্রকৃত সুখ। তাই বলা যায়, সুখের সংজ্ঞা শিখতে চাইলে আমাদের উচিত নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনকে কাছ থেকে দেখা, বোঝা ও সম্মান করা।

তাসনিম জাহান শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ব র র সন ত ন র জ বন র প আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্যচিত্র আজো দেশের মানুষকে কাঁদায়: অধ্যাপক রইছ


“বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্যচিত্র আজো দেশের মানুষকে কাঁদায় এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দণ্ডহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্য মারাত্মক হুমকি,”- এমন মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্‌দীন।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সাজিদ ভবনের নিচতলায় শিক্ষক সমিতির লাউঞ্জে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই কথা বলেন।

আরো পড়ুন:

জবিতে ভর্তির আবেদন ৫ ডিসেম্বর ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত বৃদ্ধি

জবির ৫ শিক্ষার্থীকে মারধর, আটক ৪

২০১২ সালের এই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বর্বরতায় একজন নিরীহ নাগরিককে ভুল পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জানিয়ে অধ্যাপক রইছ উদ্দীন বলেন, “এই নৃশংস ঘটনা বাংলাদেশের বিবেককে আহত করেছে এবং মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশ্বজিৎকে মৃত্যু শুধু একজন মানুষের প্রাণহানি নয়; এটি ছিল মানবতা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর বর্বর আঘাত।”

অধ্যাপক  রইছ উদ্‌দীন বলেন, 'আজকের এ দিনে আমি বিশ্বজিৎকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং ফ্যাসিবাদের পতনে তার আত্মত্যাগকে গভীরভাবে অনুধাবন করছি। আমি বিশ্বাস করি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ, সংগঠন বা ক্ষমতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যার ন্যূনতম বৈধতা কারো নেই।'

তিনি আরো বলেন, “বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্যচিত্র আজও দেশের মানুষকে কাঁদায়, এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দণ্ডহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্য মারাত্মক হুমকি। আমি গভীর শোকের সঙ্গে স্মরণ করছি, নিহত বিশ্বজিৎ দাসকে, তাঁর শোকাহত পরিবারকে এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামরত সকল মানবাধিকারকর্মীকে।”

অধ্যাপক  রইছ উদ্‌দীন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হলেও সাজাপ্রাপ্তদের দণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেন কোনো বিলম্ব বা শিথিলতা না ঘটে; এটি রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের দৃঢ় আহ্বান; রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও ছাত্র সংগঠনের সহিংসতা কঠোরভাবে নির্মূল করতে হবে।”

“উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় সন্ত্রাসমুক্ত করা শুধু প্রশাসনের দায়িত্বই নয়, আমাদের সকলকেও এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে; নিরীহ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। বিশ্বজিৎ দাসের মতো নিরীহ মানুষ যেন কখনো আর রাজনৈতিক সংঘর্ষের বলি না হয়, তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো পেশাদার, নিরপেক্ষ ও মানবিক ভূমিকা পালন করতে হবে; বিশ্বজিৎ-এর স্মৃতি সংরক্ষণে স্থায়ী উদ্যোগ প্রয়োজন,” বলেন তিনি।

অধ্যাপক  রইছ উদ্‌দীন বলেন, “ইতোমধ্যে এ মর্মে টোকেন একটি স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।”

সংবাদ সম্মেলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ইমরানুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ বিলাল হোসাইনসহ সমিতির অন্যান্য নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা এবং সাংবাদিক প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে বিশ্বজিৎ দাস হত্যা দিবস স্মরণে জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রইছ উদ্‌দীনের নেতৃত্বে ‘বিশ্বজিৎ চত্বরে’ পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠন নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পসরা সাজিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিলছে তাৎক্ষণিক ঋণসুবিধাও
  • বাফেলোতে মসজিদের সামনে দীর্ঘ সময় আইস পুলিশের অবস্থান
  • মিরসরাইয়ে বিএনপির ২ পক্ষের সংঘর্ষে যুবক নিহত
  • প্রায় ৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশি সহায়তায় সচিবালয় ছাড়লেন অর্থ উপদেষ্টা
  • ‘আমিরুল বিশ্বসেরাদের একজন হতে পারে’
  • চার নায়িকার ‘ট্রাইব্যুনাল’, দেখা যাবে ঈদে
  • কামিন্স তো ফিরেছেনই, অ্যাডিলেড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডে আরও যাঁরা আছেন
  • সন্তান জন্মে কেন সি সেকশন দরকার হয়
  • বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্যচিত্র আজো দেশের মানুষকে কাঁদায়: অধ্যাপক রইছ