যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের গলাগলি কতক্ষণ টিকবে
Published: 28th, October 2025 GMT
পাকিস্তান যেন ভূরাজনীতির হাওয়া ঠিকঠাক ধরতে পেরেছে। গত মাসে পাকিস্তান সৌদি আরবের সঙ্গে এক প্রতিরক্ষাচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই সাহসী চুক্তিতে বলা হয়েছে, একজনের ওপর আক্রমণ উভয়ের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে।
এটি এমন এক অঞ্চলে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি অনেক বাড়িয়ে দিল, যেখানে আগে থেকেই নানা শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা।
একই সময়ে ইসলামাবাদ নীরবে বিরল মৃত্তিকা খনিজের নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে আরও বড় ধরনের রপ্তানিচুক্তির পথ খুঁজছে।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনও মনে হয় পাকিস্তানকে আর মামুলি শক্তি হিসেবে দেখছে না।
পাকিস্তানের এই পদক্ষেপগুলো গতি সঞ্চারের ইঙ্গিত দেয়। ইসলামাবাদ ও রিয়াদের বিশ্লেষকেরা একে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্জাগরণ বলে অভিহিত করছেন। দেশটি তার কৌশলগত অপরিহার্যতাকে দেরিতে হলেও ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান–চীনের ‘ত্রিভূজ প্রেম’: মিলনবিন্দু নাকি সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫গাজা শান্তি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের উপস্থিতি মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় মঞ্চে পাকিস্তানের প্রত্যাবর্তনের ধারণাকে আরও মজবুত করেছে।
কিন্তু এ সবকিছু হুট করে ঘটে যাওয়া কোনো বিস্ময় নয়। এটি হলো প্রয়োজন, চাপ এবং অস্থির অঞ্চলে পরিবর্তনশীল সমীকরণের ফল। এখানে চোখজুড়ানো ছবির আড়ালে কিছু কঠিন বাস্তবতাও রয়েছে।
পাকিস্তানের এই কূটনৈতিক তৎপরতার প্রথম উদ্দীপক হলো আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে আসা। আফগানিস্তান থেকে ওয়াশিংটনের আকস্মিক প্রস্থান এমন এক শূন্যতা রেখে গেছে, যা পূরণে এখনো যুক্তরাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে।
শত্রুতাপূর্ণ ইরান ও প্রভাবশালী তালেবানকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অঞ্চলে একটি পাল্টা ভারসাম্য দরকার। ভৌগোলিক অবস্থান, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও আফগান রাজনীতির পুরোনো জটাজালের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান আবার হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে এনেছিল। সেই চুক্তির পাঁচ বছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন তালেবানকে বাগরাম বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে দিতে বলেছেন। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব ফিরে পেতে যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, এর মাধ্যমে তা আন্দাজ করা যায়।
যদি যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়, তাহলে পাকিস্তানই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হয়ে উঠবে। কারণ, একমাত্র পাকিস্তানই হলো সেই রাষ্ট্র, যার হাতে একই সঙ্গে আঞ্চলিক লজিস্টিক–সুবিধা ও রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি ধরে রাখতে পারে।যদি যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়, তাহলে পাকিস্তানই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হয়ে উঠবে। কারণ, একমাত্র পাকিস্তানই হলো সেই রাষ্ট্র, যার হাতে একই সঙ্গে আঞ্চলিক লজিস্টিক–সুবিধা ও রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি ধরে রাখতে পারে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের অস্বস্তি। গত দশকে ওয়াশিংটন দিল্লিকে তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গভীরে টেনে নিয়েছে এবং বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের অবস্থান শক্ত করেছে।
এর সবই পাকিস্তানের কাছে নিরাপত্তাঝুঁকি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত টানাপোড়েন বেড়েছে। দুই দেশের ভিসা ও শুল্কসংক্রান্ত বিরোধ রয়ে গেছে। মস্কোর সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ওয়াশিংটনকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
গত আগস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বেইজিং সফর যে স্পষ্ট সংকেত দিয়েছে, তা হলো, ভারত চাইলে চীনের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষার খেলা খেলতে পারে। অর্থনৈতিক দিক থেকে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে দুর্বল করে দিতে পারে।
আরও পড়ুনডুরান্ড লাইনের দুদিকে ভূরাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তান১৬ অক্টোবর ২০২৫যেহেতু ট্রাম্প এশিয়ায় প্রভাবের ভারসাম্য ধরে রাখতে চান এবং যেহেতু বেইজিংয়ের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতার পাল্টা ভারসাম্য দাঁড় করানো দরকার, সেহেতু ট্রাম্পের কাছে পাকিস্তান আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে অস্থির উদ্দীপক হলো খনিজ কূটনীতি (মিনারেল ডিপ্লোমেসি)। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিরল খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আর এসব খনিজের বড় অংশই আছে বেলুচিস্তানের অশান্ত অঞ্চলে।
এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই লাভজনক। এতে পাকিস্তান বিনিয়োগ পাবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সংগ্রহ করতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবতা আরও কঠিন। দশকের পর দশক ধরে সম্পদ উত্তোলন চলার পরও বেলুচিস্তান পাকিস্তানের দরিদ্রতম প্রদেশ রয়ে গেছে। অবকাঠামো প্রকল্প অচল হয়ে পড়ে আছে। বিমানবন্দরগুলো ফাঁকা। বেকারত্ব চেপে আছে আগের মতোই।
২০২৫ সালের মার্চে প্রাদেশিক পরিষদে পাস হওয়া ‘বেলুচিস্তান মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস অ্যাক্ট’ আগে থেকে মানুষের মনে জমে থাকা অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ আইনের আওতায় ইসলামাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে বেলুচিস্তানে খনির নীতি-প্রস্তাব ও লাইসেন্স অনুমোদনে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছে। এটি রাজনৈতিক পরিসরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে।
আরও পড়ুনভারত ও পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন খেলা০৬ আগস্ট ২০২৫সমালোচকেরা বলেন, এটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে এনেছে। ডানপন্থী ধর্মীয় দলগুলো পর্যন্ত এ আইনের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছে, এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে প্রদেশের সম্পদের ন্যায্য অধিকার থেকে আরও বঞ্চিত করা হবে।
বেলুচিস্তানের বাসিন্দাদের সঙ্গে না রেখে তাদের সম্পদ তোলার এই নীতি খুব বিপজ্জনক। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ে এবং বিদ্রোহ শুরু হতে পারে। বিদেশি কোম্পানিকে খনিজ দিচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় লোকজন কোনো লাভ পাচ্ছে না। এতে বহু বছর ধরে যুদ্ধ আর সেনা অভিযানে ক্ষতবিক্ষত প্রদেশটিতে বঞ্চনার অনুভূতি আরও গভীর হচ্ছে। ইসলামাবাদ যেটিকে সমাধান ভাবছে, কোয়েটার মানুষ সেটিকে তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার আরেক ধাপ হিসেবে দেখছে।
সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, পাকিস্তানের এই নতুন পররাষ্ট্রনীতি আসলে কোনো ‘নবজাগরণ’ নয়; বরং এটি চাপে পড়ে কৌশল পাল্টানো।
যুক্তরাষ্ট্রের মুঠো থেকে আফগানিস্তানের ফসকে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন আর খনিজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রলুব্ধ করার কৌশল—এগুলোই পাকিস্তানের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে বুকে টানার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের মৌলিক দুর্বলতা দূর হবে না। কারণ, প্রয়োজন শেষ হলে পাকিস্তানকে ছুড়ে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র একমুহূর্ত দেরি করবে না।
তাই রিয়াদে সম্মান পাওয়া, গাজা সম্মেলনে উপস্থিতি বা ওয়াশিংটনে করমর্দন—এসব দেখে মনে করা ভুল হবে যে পাকিস্তান কৌশলগতভাবে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। আসলে পাকিস্তান এখন কেবল কৌশল করে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন ঘরের ভেতরই। যদি ঘরের ভেতর শাসন ব্যর্থতা, বৈষম্য ও অবিশ্বাস ঠিক না করা হয়, তাহলে এসব ‘বাইরের সাফল্য’ মোটেও কাজে আসবে না।
এরিক শাহজার ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারের একজন একাডেমিক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র আফগ ন স ত ন প ক স ত নই ইসল ম ব দ ভ রস ম য র জন ত ক উপস থ ত
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে গরু আনতে গিয়ে যুবক নিখোঁজ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে গরু আনতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন সোহেল রানা (২৮) নামের এক যুবক। গত রোববার রাতে সীমান্ত পার হওয়ার পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিখোঁজ সোহেল রানা শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের রামনাথপুর গ্রামের মইনুল ইসলামের ছেলে।
দুর্লভপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাইদুর রহমান জানান, সোহেল রানা কয়েকজন সহযোগীর সঙ্গে রোববার রাতে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গরু আনতে যান। অন্যরা দেশে ফিরে এলেও সোহেল আর ফেরেননি। সোহেল রানার নিখোঁজের বিষয়টি প্রথমে গোপন রেখেছিল তাঁর পরিবার। পরে বিষয়টি জানাজানি হয়। আরেক ইউপি সদস্য মো. সুমির আজ মঙ্গলবার সকালে বলেন, এখন পর্যন্ত সোহেল রানার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
৫৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল সোমবার রাতে বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে এক বাংলাদেশি নিখোঁজের বিষয়টি স্থানীয় লোকজন আমাদের জানিয়েছেন। ঘটনাটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি। এ বিষয়ে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে বিএসএফ জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না।’