জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, তাতে অনেকগুলো অসংগতি দেখছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, ঐকমত্য কমিশনে আলোচিত হয়নি বা ঐকমত্য হয়নি, এমন বিষয়ও এতে সংযুক্ত করা হয়েছে। সুপারিশমালার সঙ্গে দেওয়া সংযুক্তিতে ভিন্নমতের কোনো উল্লেখ নেই।
এই বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এর মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার পর সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেই স্বাক্ষরিত সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ, সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে।
এই বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, হয়তোবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমস্যাটা নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে। এখানে একটা নতুন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে যে সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে একটা আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় দলের পক্ষ থেকে নেতৃত্বদানকারী বিএনপির এই নেতা বলেন, আসন্ন যে নির্বাচনটা হবে, সেই নির্বাচনটা হবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। এখন সেই সংসদ সদস্যদের যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেটা তো জাতীয় সংসদেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন জাতীয় সংসদে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তো আলোচিত হয়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ের কোনো সুপারিশ বা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হওয়ার পরও এই সুপারিশমালার মধ্যে হঠাৎ করে যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, উনারা এই সিদ্ধান্তটা আরোপ করতে পারেন না। চাপিয়ে দিতে পারেন না।’
ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্তের সুযোগ নেই
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা ওই নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।’
এই বিষয়ে গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির অবস্থান ছিল যে গণভোট আর নির্বাচন একই দিনে হবে দুটো ব্যালটের মাধ্যমে। এই ব্যাপারে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের দিন দুইটা ব্যালটের মাধ্যমে গণভোট হবে।
আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের অনেকগুলো রেকমেন্ডেশন (সুপারিশ) ছিল, যেগুলো ঐকমত্যে আসে নাই।.
উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচন প্রসঙ্গে
সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ৮৪টি দফা সম্ভবত, সেখানে বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্নমত আছে। বিস্ময়করভাবে আজকে যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সঙ্গে, সেখানে এই ভিন্নমতের (নোট অব ডিসেন্ট) কোনো উল্লেখ নেই।’
গণভোটে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রায় এলে যে প্রক্রিয়ায় এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই ভিন্নমতসহ সেটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকবে বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ভিন্নতা দেখছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যে প্রশ্নগুলো আমি দেখলাম, এখানে বলা হয়েছে আপার হাউসে অর্থাৎ উচ্চকক্ষে নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসনের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এই রকম তো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ১০০ সদস্যের এবং তারা কীভাবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে, সেটার ব্যাপারে তো ঐকমত্য হয়নি।’
উচ্চকক্ষের এখতিয়ার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বলা আছে যে অর্থবিল এবং আস্থা বিল বাদে, আস্থা ভোট বাদে সব বিষয় উচ্চকক্ষে উত্থাপন করা হবে। এখানেও কর্মপরিধি কার্যপরিধি-সংক্রান্ত নোট অব ডিসেন্ট আছে যে উচ্চকক্ষ যেহেতু নির্বাচিত নয় সরাসরি সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনীসহ অন্যান্য বিষয় তাঁরা বিবেচনা করতে পারেন না। জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কারও নেই। এই বিষয়গুলো আলোচিত হওয়ার পরেও নোট অব ডিসেন্ট থাকার পরেও তাঁরা সরাসরি এই আদেশের সংযুক্তিতে রেখেছেন। এগুলো কোনোভাবে বিবেচনা করা যায় না।’
‘অটো পাসের’ মতো বিষয় সংবিধানে থাকতে পারে না
আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। সংবিধানের কোনো বিষয় সংশোধিত হওয়ার পরে এটা একটা আইন। সেই আইনটা পার্লামেন্টে যথাযথভাবে পাস হওয়ার পরে যখন স্পিকার সই করে রাষ্ট্রপতির কাছে দেবেন, রাষ্ট্রপতি সই হওয়ার পরে সেটা তখন আইনে পরিণত হবে। সেটা সংবিধান সংশোধন হোক বা অন্য আইন, ...পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল, আমি জানি না।’
এই আইনগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রে এবং সুপারিশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আরও অনেক বিষয় আছে। এখানে কয়েক শ পৃষ্ঠার সংযুক্তি আছে। এগুলো দেখে আমরা খুব শিগগির কালকে অথবা তার পরের দিন বিস্তারিত কথা বলব।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন আহমদ জ ল ই জ ত য় সনদ ঐকমত য র হওয় র পর য ক ত কর ব এনপ র আল চ ত দ বল ন অন ষ ঠ উল ল খ সদস য গণভ ট ত হয়ন
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় পার্টি সুযোগ পাওয়া মানে আওয়ামী লীগই নির্বাচনে অংশ নিল: আখতার হোসেন
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, আওয়ামী লীগ দলটির আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী জাতীয় পার্টি। এই জাতীয় পার্টি আসলে জাতীয় পার্টি নয়, জাতীয় পার্টি মানেই আওয়ামী লীগ।
আখতার হোসেন আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখলেও জাতীয় পার্টির সুযোগ পাওয়ার অর্থ হলো, আওয়ামী লীগই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল।
আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গণঅধিকার পরিষদের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতার হোসেন এ কথা বলেন।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেটি সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য যাঁরা বক্তব্য দিচ্ছেন, দেশবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন, তাঁদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
আখতার হোসেন আরও বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়েও এক হয়েছে দলগুলো। তারপরও এখান থেকে কিছু অর্জন করা যায়নি। দেশকে এই সংকট থেকে উত্তরণ করতে হলে জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রতিটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। বাধা কোথায়, সেটি খুঁজে বের করতে হবে বলে মন্তব্য করেন আখতার হোসেন। যদি কারও দলীয় স্বার্থের কারণে সনদ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, সেই দলের সঙ্গে কথা বলে তাদের দলীয় স্বার্থ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে হবে বলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক হতে হবে বলে মন্তব্য করেন৷
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের সভাপতিত্বে এবং মুখপাত্র ফারুক হাসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ, খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ্ কায়সার।
বক্তব্য দেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আকবর খান, এনডিপির চেয়ারম্যান আবু তাহের, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে চোখ হারানো শ্রমিকনেতা রুবেল হোসেন, অভ্যুত্থানে শহীদ মিরাজ হোসেনের বাবা আবদুর রব, ইমাম হাসান ভূঁইয়ার ভাই রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া, শহীদ গোলাম নাফিজের মা নাজমা আক্তার।