দলগুলোর মতপার্থক্য সামনে এল আরও তীব্রভাবে
Published: 30th, October 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পর সে মতপার্থক্য নতুন করে তীব্রভাবে সামনে এল।
কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইতিবাচক হলেও এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। ফলে সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে শেষ সময়ে এসে দলগুলোর নতুন করে বিভক্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে আশঙ্কা তৈরি করছে রাজনৈতিক মহলে।
সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক গতিপথ কোন দিকে গড়ায়, এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনের ওপর পড়ে কি না, সে আলোচনাও শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
বিষয়টি গতকাল বুধবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও উঠে আসে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনি কিন্তু এইবার জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ। আপনি এখানে সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কারগুলো করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেবেন। যদি এর থেকে কোনো ব্যত্যয় ঘটে, এর থেকে বাইরে যদি যান, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে।’
কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইতিবাচক হলেও এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি।বিএনপির নেতারা মনে করেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নে যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তাতে জাতিতে বিভক্তি হবে, কোনো ঐকমত্য হবে না। গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভাতেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
তবে কমিশনের সুপারিশে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) উপেক্ষার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, যে বিষয়গুলোতে তাঁরা একমত ছিলেন না, সেখানে তাঁরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। সেই নোট অব ডিসেন্ট সুপারিশে লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল কমিশনের। কিন্তু অবাক হয়ে তাঁরা লক্ষ করলেন, সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে সেই বিষয়গুলো নেই। নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা তো ঐক্য হতে পারে না।
এটাকে প্রতারণা বলে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘.
মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের সদস্যরা সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দেন। এর পরপরই বিএনপি এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়।
অবাক হয়ে তাঁরা লক্ষ করলেন, সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে সেই বিষয়গুলো নেই। নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা তো ঐক্য হতে পারে না।মূলত সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের অনুল্লেখ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ—এই তিন বিষয় চূড়ান্তভাবে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিকে মুখোমুখি করছে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দল যদি সংস্কার নিশ্চিত করতে চায়, বাস্তবায়ন চায়, তাহলে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারে না। তা ছাড়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সম্পর্ক যেসব কথা বলা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। ভিন্নমতের ওপর কখনো সিদ্ধান্ত হয় না, সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে—এটাই বিশ্বের নিয়ম। ভিন্নমতের কোনো কার্যকারিতা থাকে না, ভিন্নমত শুধু রেফারেন্স হিসেবে থাকে। কমিশন যে সুপারিশগুলো করেছে, সে ব্যাপারে সবাই ঐকমত্য হয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। এই ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গণভোটের সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। এগুলোর মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
মূলত সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের অনুল্লেখ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ—এই তিন বিষয় চূড়ান্তভাবে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিকে মুখোমুখি করছে।দলগুলোর মতভিন্নতা
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করার বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্মপরিধিতে ছিল না। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জুলাইয়ের পর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এই আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা বলে আসছেন, জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়, তার ভিত্তিতে একটি নতুন অধ্যাদেশ করে গণভোট হবে। বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার পক্ষে। তারা মনে করে, এটি হলে আগামী সংসদকে আলাদা কোনো ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে।
বিএনপি আরও মনে করে, কোন কোন প্রস্তাবে কোন কোন দলের ভিন্নমত আছে, সেগুলো জুলাই সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করে যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সুতরাং গণভোটে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে যারা জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হবে, তারা ভিন্নমত অনুসারেই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চেয়েছিল, সংস্কার টেকসই করতে সংবিধান আদেশ না হলেও জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। গণভোট হতে হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে। ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোও সনদ ও গণভোটে থাকবে। গণভোটে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রায় এলে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যেভাবে ঐকমত্য কমিশনে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের ক্ষমতা দিতে হবে।
কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, সুপারিশে নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই। এটা তো কোনো ঐকমত্য হয়নি। এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই কমিশন দেবে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভিন্ন তৎপরতা
বিএনপি সংস্কার বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানালেও এর বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, তা এখনো স্থির করেনি। গণভোটসহ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াত যুগপৎ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সনদের পূর্ণ প্রতিফলন নেই বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গতকাল ঢাকায় এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এবং সরকারের কিছু পদক্ষেপে আমরা আজ গভীর হতাশা প্রকাশ করছি। এগুলোর মাধ্যমে জাতিতে ঐক্যের বদলে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, কমিশনের দেওয়া সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে তার হুবহু প্রতিফলন নেই।’
সুপারিশে কিছু দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তাভাবনা জাতির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করেছেন বলে মন্তব্য করে কমিশনের সংলাপে নেতৃত্ব দেওয়া সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। আমি বিপক্ষেই খেলছিলাম মনে হয়। সেই হিসেবে জাতির পক্ষের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, সংবিধান সংশোধনের ৪৮টি দফা প্রস্তাব তফসিল আকারে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, এই দফাগুলোর ওপর গণভোট হবে। অথচ এই বিষয় নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
অন্যদিকে সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে অবিলম্বে গণভোটের তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গণভোটের তারিখ ঘোষণায় যত দেরি হবে, জাতীয় নির্বাচন তত সংকটের মধ্যে পড়বে। কমিশনের সুপারিশে গণভোটের তারিখ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রতিক্রিয়া জানানো এবং আন্দোলনরত দলগুলোর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার লক্ষ্যে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে পাঁচ দফা অভিন্ন দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
জানা গেছে, পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে আগামী ৩ নভেম্বর জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দলের শীর্ষ নেতারা আবার বৈঠকে বসবেন।
জুলাই সনদে বাস্তবায়নে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ দেখার পরই এনসিপি সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, দুই ধরনের সংস্কারের জন্য স্বতন্ত্র বাস্তবায়ন রূপরেখা কমিশন পেশ করেছে। সংবিধান-সম্পর্কিত নয়, এমন সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে প্রজ্ঞাপন ও অধ্যাদেশের খসড়া কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। কালবিলম্ব না করে অতি সত্বর এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। প্রথম খসড়া, তথা প্রস্তাব-১ বাস্তবায়নের পথে সরকারকে যেতে হবে।
গণভোটে প্রদত্ত সংবিধান সংস্কার বিলের খসড়া দ্রুত প্রণয়ন এবং জনগণের কাছে উন্মুক্ত করতে সরকারকে আহ্বানও জানান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব ন ট অব ড স ন ট স দ ধ ন ত হয় জ ল ই সনদ ভ ন নমত র ব এনপ র সরক র র ও এনস প দলগ ল র গণভ ট র জনগণ র ইসল ম গতক ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ভিন্ন কোনো দেশের কারণে ঢাকা–বেইজিং সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না: চীনের রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশকে ‘চীনমুখী’ দেখে সেই পথ থেকে সরে আসার কথা যখন বলছে যুক্তরাষ্ট্র, তখন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রের কারণে ঢাকা–বেইজিং সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এ কথা বলেন তিনি। তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের কল্যাণে। বাংলাদেশ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত করে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নির্দেশনায় নয়। তাই বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের মাধ্যমে এই সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সাবেক কূটনীতিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ফরমার অ্যাম্বাসাডরস (এওএফএ–আউফা) তাদের নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে এদিন চীনের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করে। চীনের রাষ্ট্রদূত বক্তৃতা দেওয়ার পর প্রশ্নোত্তরপর্বে অংশ নেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য রাষ্ট্রদূতের ঢাকা–চীন সম্পর্ক নিয়ে এক বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ইয়াও ওয়েনের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মনোনীত রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। সেই শুনানিতে বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল। সেখানে প্রশ্নোত্তরপর্বে ক্রিস্টেনসেন বলেছিলেন, ঢাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির ঝুঁকির বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরবেন।
আজকের অনুষ্ঠানে সেই শুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীন ও আত্মনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করি। এটাই বাংলাদেশের অতীতের সরকারগুলো অনুসরণ করে এসেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশনা ছাড়া পরিচালিত হয়েছে। চীনের অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীন ও নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নীতি অনুসরণকে সমর্থন করা। আপনাদের কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশনায় পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অবস্থানকে আমরা সমর্থন করি।’
আন্তসম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার মতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক জনগণের কল্যাণে। বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজপথের জনগণের বিষয়ে আমরা মুগ্ধ। বাংলাদেশের জনগণের ওপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখুন। গত মার্চে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীনে গিয়েছিলেন। ভুলে যাবেন না গুরুত্বপূর্ণ সফরটি ছাড়াও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের তিনটি প্রতিনিধিদলের গুরুত্বপূর্ণ সফর হয়েছে চীনে। ওই তিন দলের নেতারাসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারাও চীন সফর করেছেন। তাঁরা দুই দেশের মাঝে সহযোগিতা চান। এটাই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের শক্তি। এই সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের স্বার্থের ভিত্তিতে।’
বৈশ্বিক অঙ্গনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা চললেও বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে এবং তা তৃতীয় কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে নয় বলে মন্তব্য করেন ইয়াও ওয়ান। তিনি বলেন, ‘তাই আমাদের এই সহযোগিতা অন্যের দ্বারা পরিচালিত হবে না। নির্বাচনের পরও বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে দুই দেশের এই সহযোগিতা আরও এগিয়ে যাবে। সহযোগিতা আরও টেকসই হবে। এই সম্পর্ক বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
আউফা সভাপতি আব্দুল্লাহ আল আহসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন শাহেদ আক্তার, গোলাম মোহাম্মদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের মহাসচিব গাউসুল আজম সরকার।
‘রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চীনের সক্ষমতার বাইরে’মতবিনিময়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে প্রশ্ন করা হয় চীনের রাষ্ট্রদূতকে। দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে থাকা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায় বাংলাদেশ। ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আসছেন বিশ্লেষকেরা।
ইয়াও ওয়েন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চীনকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই অনুরোধ করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও তাঁরা চেষ্টা করেছেন। তবে বিষয়টি একা চীনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়, এটি চীনের সক্ষমতার বাইরে। এটি অত্যন্ত জটিল সংকট। এর সঙ্গে অনেক স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) জড়িত। আমরা যখন ২০২৩ সালে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছি, অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো আমাদের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করেছে। প্রত্যাবাসন হোক, কিছু দেশ ও সংস্থা তা চায় না।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব অংশীদারের ভূমিকা রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, চীন তার ভূমিকা পালন করবে।
‘তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কাজ হচ্ছে’তিস্তা অববাহিকা নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ চীনের অর্থায়ন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। অন্তর্বর্তী সরকারেরর সময়ে এসে তার কোনো অগ্রগতির খবর আছে কি না, মতবিনিময় সভায় তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ইয়াও ওয়েনের কাছে।
ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশ ও উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের কাছে এ প্রকল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁরা জানেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিগত সরকারের কাছে তিস্তা প্রকল্পে একটি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব করেছিলেন তাঁরা। এর জন্য দুটি ভাগে প্রকল্পটিকে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথমটি বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদীর ওপর বাঁধ তৈরি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে একটি শহরতলির মতো করে গড়ে তোলা, যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম থাকবে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত অর্থাৎ আড়াই বছর তিস্তা প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি বলে জানান চীনের রাষ্ট্রদূত। তবে এরপর সাড়া পান জানিয়ে তিনি বলেন, গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে প্রস্তাব পান তাঁরা। এরপর চীনা বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেন।
ইয়াও ওয়েন জানান, এ প্রকল্পে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে সাত-আট বছর লাগবে তা সম্পূর্ণ হতে।
বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁরা চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে ‘কঠিন পরিশ্রম’ করছেন। অবকাঠামো নির্মাণের আগে যে নথিপত্র সইয়ের বিষয় রয়েছে, তা আগামী নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদী।
ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৩০টি চীনের প্রতিষ্ঠান ১০০ কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে।’
আরও পড়ুনচীন সংযোগে ঝুঁকি আছে, তা বাংলাদেশকে বোঝাব : ক্রিস্টেনসেন২৪ অক্টোবর ২০২৫বাংলাদেশ–চীন–পাকিস্তান সম্পর্কশক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে চীন ভূমিকা রাখতে চায় বলে জানান রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তিনি আরও বলেন, সার্ক অকার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান ত্রিদেশীয় সুসম্পর্ক এই অঞ্চলের অগ্রগতিতে নতুন ভূমিকা রাখবে।
চীনের প্রেসিডেন্টের বৈশ্বিক সুশাসন উদ্যোগ (জিজিআই) নিয়ে প্রশ্ন করলে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বছরের সেপ্টেম্বরে সাংহাই কো–অপারেশন সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট জিজিআই ঘোষণা করেছেন। এটা ঘোষণা করা হয়েছে বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। সবার জানা যে একটি দেশ তার নীতির মাধ্যমে বিশ্বে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করছে। ফলে দক্ষিণের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো চীনের কাছে যায়। আন্তর্জাতিক আইনকে সুরক্ষা দিতে এবং বিশ্বকে একত্র করতে তারা চীনকে ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানায়।
‘ফলে আমাদের এসব আন্তর্জাতিক আইনকে সুরক্ষা দিতে হবে। না হলে পুরো বিশ্বের জন্য জঙ্গলের শাসন কায়েম হয়ে যাবে। এ কারণেই চীন জিজিআই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে,’ বলেন তিনি।