ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যেভাবে ইসরায়েলি ‘দখলদার বাহিনী’ হয়ে উঠেছে
Published: 11th, January 2025 GMT
২৮ ডিসেম্বর একদল ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী দখলকৃত পশ্চিম তীরের সিলওয়াদ শহরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর হামলা করে।
ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জলপাই বাগানের মধ্যে দুজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি কৃষকের মুখ ও মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের গাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, দুজনই মারাত্মকভাবে আহত হন।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। তারা তাদের সময় ও সম্পদ নিজদের জনগণের বিরুদ্ধে অভিযানে উৎসর্গ করেছে।
২৯ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার স্নাইপাররা গুলি করে তরুণ সাংবাদিক শাথা আল সাব্বাগকে হত্যা করেন। ২১ বছর বয়সী সাহসী এই সাংবাদিক জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভয়ানক অভিযানের ঘটনাগুলোর তথ্যপ্রমাণ জড়ো করেছিলেন।
মিডল ইস্ট আইকে তাঁর ভাই মুসাব আল-সাব্বাগ বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমার বোনের সঙ্গে তাঁর শিশুও ছিল। তা সত্ত্বেও আমার বোন যখন দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল, তখন স্নাইপার তাঁর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে।’
মারাত্মক অভিযানকয়েক সপ্তাহ ধরে জেনিন শহরে অভিযান পরিচালনা করছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। জেরুজালেম থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত জেনিন এখন একটি অশান্ত শহর। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘অপরাধী’ ও ‘সশস্ত্র জঙ্গি’ যারা জেনিনে ঘাঁটি গেড়েছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে এই অভিযান পরিচালনা করছে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই মারাত্মক অভিযানে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আর এই হামলার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদেরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ৩ জানুয়ারি একজন বাবা ও তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়।
আজকে ফিলিস্তিনিরা নিজেদেরকে আরও নাজুক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। এটা শুধু ইসরায়েলের অপরাধমূলক সহিংস আক্রমণের কারণেই নয়, তাদের কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্বের দিক থেকে আসা সহিংসতার কারণেও।
একদিকে গাজায় গণহত্যা চলছে, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন গড়ে চারটি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মারাত্মক হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, সহিংস অভিযান এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে ইসরায়েলি অভিযানে পশ্চিমারা শুধু নীরব নয়, তারা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে। এতে মার্কিন অর্থায়নপুষ্ট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে চলেছে।
ফিলিস্তিনের একজন কলাম লেখক আমাকে বলেছেন, প্রতিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে লেখা তার একটি কলামের নিচে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য লেখায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশ একটাই উদ্বেগজনক যে আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু ছদ্মনামে তাঁদের লেখা প্রকাশ করছে।
নতুন শত্রুঅনেক ফিলিস্তিনের জন্য পিএর অধীনে বাস করা ও কাজ করা কঠিন।কিন্তু কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবেন না, হত্যা ও গ্রেপ্তার এমন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পিএ নতুন একটা শত্রু খুঁজে পেয়েছে। সেই শত্রু ইসরায়েলি বাহিনী অথবা অবৈধ বসতি স্থাপনকারী নয়।
একজন ফিলিস্তিনি আন্দোলনকর্মী আমাকে খুব অস্পষ্টভাবে বলেছে, ‘তারা (ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ) কোনো ধরনের প্রতিরোধকে সহ্য করতে রাজি নয়। পিএর অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও সমালোচক যে কাউকে তারা গ্রেপ্তার করছে।’
এর সবটাই ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চাপে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিএর বিরুদ্ধে অথবা তারা জেনিনে যা করছে, তার বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনো পোস্ট দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
এদিকে জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যেভাবে চিত্রায়িত করছে, সেটাকে প্রত্যাখ্যান করছে। এবং তারা বলছে তাদের প্রতিরোধ একটা দখলদার সত্তার বিরুদ্ধে বৈধ প্রতিরোধ।
পিএ তাদের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে যেটাই বলার চেষ্টা করুক না কেন, পিএর মূল সেক্যুলার দল ফাতাহর একজন নেতা আমাকে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পিএ যে আচরণ করছে, তিনি মৌলিকভাবে তার বিরোধী।
তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের কী হলো, কী না হলো, সেটা মোটেই ভাবে না পিএ। তারা কেবল ইসরায়েল ও আমেরিকাকে বোঝাতে চায় যে পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম তারা।’
দখলদারির হাতিয়ারগত মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাক্সিওসে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনিনে পিএর অভিযানকে এর ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এটা বোঝাতে উদ্গ্রীব যে তিনি ফিলিস্তিনসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করতে সক্ষম।
এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পিএর এই দমন–পীড়নকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেল ক্যান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ আক্রমণকে উৎসাহিত করেছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন পশ্চিম তীর থেকে আল-জাজিরার সম্প্রচারও বন্ধ করে দিয়েছে।
এ সংকটজনক মুহূর্তে ইসরায়েল যখন গাজা, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে হামলা করে চলেছে, তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের কঠোর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি দখলদারির একটি অস্ত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে।
লুবনা মাসরওয়া সাংবাদিক এবং মিডল ইস্ট আইর ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ব্যুরো প্রধান
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বড় বন্দরে ভারী কাজ করেও চলে না সংসার
দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি হয় চট্টগ্রামে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর দিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি হওয়ার পর সেগুলো বিভিন্ন লাইটার জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন ঘাট হয়ে গুদামজাত হয়। এরপর সেখান থেকে যায় বিভিন্ন বাজারে। লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত শত শত শ্রমিক দিন রাত পরিশ্রম করেন। তারপরও কষ্টে চলে তাদের সংসার।
চট্টগ্রাম মহানগরীর মাঝিরঘাট এলাকায় ১৭টি ঘাটে আমদানি পণ্য খালাস হয়। আর এসব খালাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ৪ হাজার ঘাট শ্রমিক। এই শ্রমিকরা পালাক্রমে কাজ করেন ঘাটে। দিন-রাত হাড় ভাঙা খাটুনির পরও দিন যায় কষ্টে। সময়ের সঙ্গে তাদের শ্রমের মূল্য বাড়লেও তা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়।
চট্টগ্রাম গুদাম ও ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আবদুল খালেক রাইজিংবিডিকে বলেন, “প্রতি বছর মে দিবসে অনেকেই আমাদের স্মরণ করেন। কিন্তু বছর জুড়ে আমাদের অবহেলা আর বঞ্ছনার জীবন। সারা দিন কাজ করে ঘাট শ্রমিকরা ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকে। কিন্তু এর বিনিময়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ভারী বস্তা বহন করে শ্রম দিতে হয়। কখনো কখনো এই পারিশ্রমিকও জোটে না। আবার সব শ্রমিকের প্রতিদিন কাজও জোটে না।”
ঘাট শ্রমিক আবদুল মতিন জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘাটে আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, গম, সার, চিনি, সাদা মটর, পাথর, কয়লা, ফ্লাইঅ্যাশ, বল ক্লে, লাইম স্টোন, জিপসাম, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী পণ্য। এসব পণ্য মাদার ভেসের থেকে লাইটার জাহাজে খালাসের পর মাঝিরঘাটের বিভিন্ন গুদামে আনা হয়। সেখান থেকে শ্রমিকরা খালাস করে বিভিন্ন ট্রাকে লোড করেন, আবার ট্রাক থেকে বিভিন্ন গুদামে মজুদের জন্য আনলোড করেন। প্রতিদিন একজন শ্রমিক একশ’ দেড়শো বস্তা পর্যন্ত পণ্য বহন করেন। ভোর ৬টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা ভারী পণ্য বহনের এসব কাজ করেন। এতে তাদের দৈনিক মজুরি মিলে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা।
মনিরুল মোল্লা নামে আরেক শ্রমিক রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমরা দিনে হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পেলেও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বস্তা বহন অতি পরিশ্রমের কাজ। এ জন্য আমাদের অনেক খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। প্রতিদিন একজন শ্রমিকের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করতে হয় খাওয়ার পেছনে। এতে দিনের আয়ের অর্ধেক চলে যায়। বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে ৫-৬ জন সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। পরিবার সন্তানদের জন্য মাসে এক দুই বার মাছ মাংস খাওয়া সম্ভব হয় না।”
আবদুল সবুর নামের অপর একজন ঘাট শ্রমিক রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমাদের শ্রমে-ঘামে দেশের আমদানি রপ্তানি বড় কার্যক্রম চলে চট্টগ্রামে। কিন্তু আমাদের জীবন চলে অনেক কষ্টে। অসুস্থ হলে কাজ জোটে না, খাবার জোটে না। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন।”
ঘাট শ্রমিক ফরিদুল মোস্তফা বলেন, “৪ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার। প্রতিদিন যা আয় করি তার অর্ধেক চলে যায় ব্যক্তিগত খরচে। বাকি অর্ধেক দিয়ে পুরো সংসার চালাতে হয়। জিনিসপত্রের যা দাম অর্ধেক আয় দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিন বেলা খাওয়াও কষ্ট।”
সফি মোল্লা নামের অপর এক শ্রমিক বলেন, “ভারী কাজ প্রতিদিন করা সম্ভব হয় না। সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক আহত হন। অনেকেই কর্মক্ষমতা হারায়। কিন্তু আমাদের দেখার কেউ নাই। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে অনেক সময় ঘাট বন্ধ থাকে। তখন কাজ থাকে না। এতে আমাদের অভাবের শেষ থাকে না।”
ঢাকা/ইভা