ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যেভাবে ইসরায়েলি ‘দখলদার বাহিনী’ হয়ে উঠেছে
Published: 11th, January 2025 GMT
২৮ ডিসেম্বর একদল ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী দখলকৃত পশ্চিম তীরের সিলওয়াদ শহরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর হামলা করে।
ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জলপাই বাগানের মধ্যে দুজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি কৃষকের মুখ ও মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের গাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, দুজনই মারাত্মকভাবে আহত হন।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। তারা তাদের সময় ও সম্পদ নিজদের জনগণের বিরুদ্ধে অভিযানে উৎসর্গ করেছে।
২৯ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার স্নাইপাররা গুলি করে তরুণ সাংবাদিক শাথা আল সাব্বাগকে হত্যা করেন। ২১ বছর বয়সী সাহসী এই সাংবাদিক জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভয়ানক অভিযানের ঘটনাগুলোর তথ্যপ্রমাণ জড়ো করেছিলেন।
মিডল ইস্ট আইকে তাঁর ভাই মুসাব আল-সাব্বাগ বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমার বোনের সঙ্গে তাঁর শিশুও ছিল। তা সত্ত্বেও আমার বোন যখন দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল, তখন স্নাইপার তাঁর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে।’
মারাত্মক অভিযানকয়েক সপ্তাহ ধরে জেনিন শহরে অভিযান পরিচালনা করছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। জেরুজালেম থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত জেনিন এখন একটি অশান্ত শহর। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘অপরাধী’ ও ‘সশস্ত্র জঙ্গি’ যারা জেনিনে ঘাঁটি গেড়েছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে এই অভিযান পরিচালনা করছে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই মারাত্মক অভিযানে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আর এই হামলার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদেরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ৩ জানুয়ারি একজন বাবা ও তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়।
আজকে ফিলিস্তিনিরা নিজেদেরকে আরও নাজুক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। এটা শুধু ইসরায়েলের অপরাধমূলক সহিংস আক্রমণের কারণেই নয়, তাদের কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্বের দিক থেকে আসা সহিংসতার কারণেও।
একদিকে গাজায় গণহত্যা চলছে, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন গড়ে চারটি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মারাত্মক হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, সহিংস অভিযান এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে ইসরায়েলি অভিযানে পশ্চিমারা শুধু নীরব নয়, তারা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে। এতে মার্কিন অর্থায়নপুষ্ট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে চলেছে।
ফিলিস্তিনের একজন কলাম লেখক আমাকে বলেছেন, প্রতিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে লেখা তার একটি কলামের নিচে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য লেখায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশ একটাই উদ্বেগজনক যে আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু ছদ্মনামে তাঁদের লেখা প্রকাশ করছে।
নতুন শত্রুঅনেক ফিলিস্তিনের জন্য পিএর অধীনে বাস করা ও কাজ করা কঠিন।কিন্তু কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবেন না, হত্যা ও গ্রেপ্তার এমন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পিএ নতুন একটা শত্রু খুঁজে পেয়েছে। সেই শত্রু ইসরায়েলি বাহিনী অথবা অবৈধ বসতি স্থাপনকারী নয়।
একজন ফিলিস্তিনি আন্দোলনকর্মী আমাকে খুব অস্পষ্টভাবে বলেছে, ‘তারা (ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ) কোনো ধরনের প্রতিরোধকে সহ্য করতে রাজি নয়। পিএর অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও সমালোচক যে কাউকে তারা গ্রেপ্তার করছে।’
এর সবটাই ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চাপে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিএর বিরুদ্ধে অথবা তারা জেনিনে যা করছে, তার বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনো পোস্ট দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
এদিকে জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যেভাবে চিত্রায়িত করছে, সেটাকে প্রত্যাখ্যান করছে। এবং তারা বলছে তাদের প্রতিরোধ একটা দখলদার সত্তার বিরুদ্ধে বৈধ প্রতিরোধ।
পিএ তাদের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে যেটাই বলার চেষ্টা করুক না কেন, পিএর মূল সেক্যুলার দল ফাতাহর একজন নেতা আমাকে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পিএ যে আচরণ করছে, তিনি মৌলিকভাবে তার বিরোধী।
তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের কী হলো, কী না হলো, সেটা মোটেই ভাবে না পিএ। তারা কেবল ইসরায়েল ও আমেরিকাকে বোঝাতে চায় যে পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম তারা।’
দখলদারির হাতিয়ারগত মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাক্সিওসে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনিনে পিএর অভিযানকে এর ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এটা বোঝাতে উদ্গ্রীব যে তিনি ফিলিস্তিনসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করতে সক্ষম।
এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পিএর এই দমন–পীড়নকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেল ক্যান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ আক্রমণকে উৎসাহিত করেছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন পশ্চিম তীর থেকে আল-জাজিরার সম্প্রচারও বন্ধ করে দিয়েছে।
এ সংকটজনক মুহূর্তে ইসরায়েল যখন গাজা, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে হামলা করে চলেছে, তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের কঠোর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি দখলদারির একটি অস্ত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে।
লুবনা মাসরওয়া সাংবাদিক এবং মিডল ইস্ট আইর ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ব্যুরো প্রধান
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার এক নতুন আলোচনায় এসেছে গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রস্তাব ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, সরকার যদি চায় তাহলে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে বা আলাদা দিনেও গণভোট আয়োজন সম্ভব। এজন্যই কমিশন সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগাম প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্থানীয় সরকার, তথ্য, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহনসহ ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- একদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা, অন্যদিকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ।
গণভোটের প্রস্তুতি নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “গণভোট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে এটি হবে কি না, কবে হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যদি গণভোট আয়োজনের নির্দেশ আসে, তাহলে যেন তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য প্রস্তুতি রাখা।”
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সভায় বলেন, “সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখে।”
সভায় আরো জানানো হয়, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে খসড়া ভোটকেন্দ্র তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়।
ভোটকেন্দ্র, অবকাঠামো ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
সভায় আলোচনা হয়, দেশের ৪২ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব স্থানে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
ইসির নির্দেশে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা যেন ভোটের আগে মেরামত ও প্রবেশযোগ্য হয়। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় হেলিপ্যাড সংস্কারের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে জরুরি পরিবহন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলাচলে সমস্যা না হয়।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, ভোটের দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের লজিস্টিক সহায়তা ও যানবাহন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেডিকেল টিম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। প্রতিটি টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। দুর্গম এলাকায় ইউনিয়নভিত্তিক সহায়ক টিমও থাকবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র্যাবকে যৌথভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, যিনি আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকি করবেন।
প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা
ইসি জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রেরণে এবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভোট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিভিএমএস) ব্যবহার করা হবে। এতে কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফলাফল জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা চাই ফলাফল যেন দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়। সেই জন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।”
তিনি আরো জানান, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
গণভোটের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২(১)-এর উপধারায় বলা আছে যদি সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানতে হয়, তবে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই গণভোটের বিষয়টি সামনে এসেছে।
তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সংবেদনশীল। কিছু দল মনে করছে, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চাপ বেড়ে যাবে; আবার কেউ কেউ বলছে, এতে ব্যয় কমবে ও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।
একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে, যেন সরকার যেদিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবে, সেদিনই কাজ শুরু করা যায়।”
অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও বাজেট বরাদ্দ
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন একা আয়োজনের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রায় ৮,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণভোট যুক্ত হলে ব্যয় আরো ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের সচিব বৈঠকে জানান, বাজেট সংস্থান বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে শুধু অপরিহার্য খাতে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা
ইসি সচিব বলেন, “আমরা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছি। শিক্ষক, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এতে থাকবেন।”
ইসি চায়, ভোটগ্রহণে যেন নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের তালিকা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রচার কৌশল
ভোটার সচেতনতা বাড়াতে ইসি সংসদ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এয়ারটাইম ব্যবহার করবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটাধিকার ও আচরণবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইসি যৌথভাবে এই প্রচার অভিযান পরিচালনা করবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষক ও প্রবাসী ভোটার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা ও অনুমতি প্রক্রিয়া দ্রুত করা হবে। একই সঙ্গে ইসি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম চালু করছে। আগামী ১৬ নভেম্বর এর ট্রায়াল অ্যাপ উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আখতার আহমেদ।
সরকারি সফরে সচিবদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিল ইসি
বৈঠকে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা সরকারি সফরে দেশের যেখানেই যান না কেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সরকারের পূর্ণ সহায়তা চায়। কারণ নির্বাচন কমিশন একা এই বিশাল আয়োজন করতে পারে না, সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও ঢাকা-১৪ আসনের ভোটার তৌহিদুর রহমান বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয় যে সরকার গণভোটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং ইসি চাইছে আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে যাতে কোনো অঘটন বা বিলম্ব না ঘটে।”
তিনি বলেন, “এখন অপেক্ষা সরকারের সিদ্ধান্তের। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কি একসঙ্গে হবে, নাকি আলাদা দিনে। যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই আগাম প্রস্তুতি বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”
ঢাকা/এস