প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ব্রিটেন সফর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেখানে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমঝোতার পথ ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারলে ঈদুল আজহার আগের দিন জাতীয় নির্বাচনের পরিবর্তিত সময়সীমা ঘোষণার পরও ‘সংকট’ যখন কাটেনি, তখন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এ দেশের ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী আন্তর্জাতিক মহলগুলোও নিশ্চয় চাইছিল, সেখান থেকে সুস্পষ্ট বার্তা আসুক। অভিন্ন আগ্রহ ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও। 
আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যেই নির্বাচন হবে– ‘যৌথ বিবৃতি’তে এমন কথা কিন্তু নেই। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ওই সময়ে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। এটাই হলো খবর। শুধু মুহাম্মদ ইউনূস এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন, তা নয়; তারেক রহমানও হয়েছেন। আমরা জানি, তারেক রহমান রাজধানীতে আয়োজিত এক বড় জমায়েতে লন্ডন থেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন– ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। তাতে ওই দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন-সংঘাতের শঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। লন্ডন বৈঠকে তিনি ডিসেম্বর থেকে আরও কিছুদিন পিছিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হলেন। সে অর্থে ‘ছাড়’ এসেছে উভয় দিক থেকেই। 

জুনে তো নয়ই; এপ্রিলেও প্রাকৃতিকসহ নানা কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন ছিল। সেসব নিয়ে এর মধ্যে যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছে। সরকারপক্ষ এসব জানত না– তা মনে করার কারণ নেই। এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তারা হয়তো সেটাকে দরকষাকষির উপকরণ করতে চেয়েছে। ডিসেম্বরের পর, রমজানের আগ দিয়ে নির্বাচন হলে মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি যে মেনে নেবে; এটাও শোনা যাচ্ছিল। জামায়াতে ইসলামীর আমিরও মাঝে বলেছিলেন, ওই সময়ে নির্বাচন হতে পারে। ‘হওয়া দরকার’ কথাটাও সম্ভবত বলেছিলেন। লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে এসে তিনি সেটা বলেছিলেন বলে তা বিশেষ গুরুত্বও পেয়েছিল। 

মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) গুরুত্ব পাচ্ছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণরা সামনের কাতারে আছেন বলে। তাদের কেউ কেউ এখনও অন্তর্বর্তী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন। লন্ডন বৈঠক বিষয়ে এ দুই দলের প্রতিক্রিয়ায় মিল-অমিল দুটোই আছে। বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখলেও তারা ‘বিদেশের মাটিতে’ বসে নির্বাচনের নতুন সম্ভাব্য সময়ের ব্যাপারে যৌথ বিবৃতি প্রদানকে ভালোভাবে নেয়নি। 

জামায়াত মনে করে, প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে কথা বলে বিষয়টি স্পষ্ট করলে ভালো হতো। তবে মনে হয় না, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে দলটি অখুশি হবে। ‘পরিবর্তিত বাস্তবতা’ বুঝতে পারছেন জামায়াত নেতারা। সেটা বুঝতে পারলেও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে এনসিপির। তারা বলছেন, লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয় গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচন। 
বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা যৌথ বিবৃতিতে কিন্তু স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রশ্নে পুরো ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। বিএনপিও তেমন ছাড় চাইছে বলে মনে করার কারণ নেই। তবে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ স্পষ্ট হতে হবে। কোন পর্যন্ত অগ্রগতিকে আমরা ‘পর্যাপ্ত’ বলব? 
আগামী মাসের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ হয়ে যাওয়ার কথা, যেটা সংস্কার সম্পর্কিত। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরির এজেন্ডাও রয়েছে। মাঝে মতবিরোধের কারণে দ্বিতীয়টির কাজ ঝুলে যায়। জুলাই সনদ ঝুলে যাওয়ার অবশ্য কারণ নেই। সংস্কারের বাছাইকৃত সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এতে প্রকাশ পাবে। একমত হওয়া সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটাও জানা যাবে তখন। অন্তর্বর্তী সরকারও বলছে, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে পরে– নির্বাচিত সরকারের আমলে। অভিযুক্তদের বিচারকাজও বর্তমান শাসনামলে শেষ হবে না– এটা নিশ্চিত। তবে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মামলার বিচারিক নিষ্পত্তি হতে পারে এরই মধ্যে। সেগুলোর চূড়ান্ত নিষ্পত্তিও সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে। 

বাড়তি সংস্কার ও বিচার সম্পন্নের ব্যাপারে অগত্যা নির্বাচিত সরকারের ওপরেই আস্থা রাখতে হবে। তারা এ দুই প্রশ্নে আন্তরিক না হলে কিছু করার থাকবে না, তাও নয়। সমালোচনা, এমনকি সে প্রশ্নে আন্দোলন রচনার প্রয়োজনীয়তা তখন সামনে আসবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কারা জিতবে– সে বিষয়ে সবারই স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এটাকেও বাস্তবতা বলে মানতে হবে। এটি এড়ানো বা প্রতিহত করার চিন্তা কোনো কোনো মহলে থাকলেও দেশের ব্যাপক মানুষ সে ধারায় নেই। নিকট অতীতে তিন-তিনটি জাতীয় নির্বাচনে তারা আগ্রহভরে অংশ নিতে পারেনি সেগুলোর চরিত্র দেখে। একটি সত্যিকারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মুখিয়ে আছে তারা। তা ছাড়া এমন ধারণা রয়েছে, নির্বাচিত সরকার এলে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। অনিশ্চয়তা কাটবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও হবে গতিশীল। কাজের সুযোগ ও রোজগার বাড়বে। 
শেখ হাসিনা সরকার যে জায়গায় দেশটা রেখে গেছে, সেখান থেকে টেনে তোলার জন্য সংস্কার, এমনকি সংবিধানের কিছু সংস্কার জরুরি বৈকি। লন্ডন বৈঠকে সে বিষয়ে কিছু ‘বাড়তি সম্মতি’ কি আদায় করতে পেরেছেন মুহাম্মদ ইউনূস? এ প্রশ্নও জরুরি। কেননা জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের তুলনায় এ ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে বিএনপি। সত্যি বলতে, নির্বাচন-সংক্রান্ত ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণের দিকে যেতেই তারা আগ্রহী। 

অন্তর্বর্তী সরকারও অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করে ফেলেছে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা ও আলাপ-আলোচনায়। আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে তাদের কিছু উদ্যোগ জটিলতাও সৃষ্টি করেছে। রুটিন তথা প্রতিদিনের কাজগুলোও সুসম্পন্ন করতে পারছে না সরকার। এ অবস্থায় ‘সংস্কারে বিশ্বাসী’ হলেও তার পক্ষে এ নিয়ে দরকষাকষি করা কঠিন– সেটাও বোধগম্য। 
লন্ডনের ‘একান্ত বৈঠকে’ মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে আর কোন কোন বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানার আগ্রহ আছে অনেকের। কিন্তু সাধারণ কারও পক্ষে সেগুলো জানা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অনুমান আর জল্পনা চলতে থাকবে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, দু’পক্ষের দূরত্ব কমে এসেছে এরই মধ্যে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দূরত্বও মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। এর পেছনেও ছিল নির্বাচনের অস্পষ্ট সময়সীমাসহ কিছু ইস্যু। 

বিচার ও সংস্কারকে ‘চলমান প্রক্রিয়া’ হিসেবে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের দিকে যেতে পারলে কোনো কিছুই বাধা হিসেবে থাকবে না। বড় এ লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই বিবেচনায় নিতে হবে বাস্তবতা। এতে কোনো পক্ষকে হয়তো একটু বেশি ছাড় দিতে হবে। দিনের শেষে জাতি জয়ী হলে সেটা পুষিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ ত র ক রহম ন র পর য প ত ব স তবত ব এনপ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ