রমজানে পণ্য আমদানির উদ্যোগ বেশি, চিন্তা কারসাজি ও ডলার নিয়ে
Published: 13th, January 2025 GMT
পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খোলা বাড়িয়েছেন। বিগত ছয় মাসের হিসাবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানি বেড়েছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) নিত্যপণ্যের চাহিদা, আমদানি ও আমদানির ঋণপত্র খোলা এবং স্থানীয় উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হবে না। বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা নেই। চিন্তার বিষয় হলো মার্কিন ডলারের দাম। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও স্থানীয় বাজারে কারসাজির কারণে অনেক সময় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারি দরকার। অতীতে দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। বাজারে দাম বেড়ে যায়।
সরকার ভোজ্যতেল, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যে যে শুল্কছাড় দিয়েছে, তা যেন সাধারণ মানুষ পান, সেটা নিশ্চিত করার তাগিদও দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
ব্যবসায়ীরাও বলছেন, সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হবে না। বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা নেই। চিন্তার বিষয় হলো মার্কিন ডলারের দাম। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। রোজার বাজার ধরার জন্য ঋণপত্র খোলা হবে জানুয়ারি শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারি মাসেই পাইকারি বাজারে রোজার পণ্যের বেচাকেনা শুরু হবে। তার আগে রোজার বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ৯ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় ট্যারিফ কমিশন। তাতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অপরিশোধিত চিনি, চাল, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুরের ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে।
যেমন এবার খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৮৬ হাজার মেট্রিক টনের। গত বছর একই সময়ে ৪৮ হাজার টন খেজুরের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল; অর্থাৎ খেজুরের ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এবার ১ লাখ ৮৯ হাজার টন ছোলার ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। মসুর ডালের ঋণপত্র খোলার হার ২১ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।
পেঁয়াজের ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। অবশ্য বাজারে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। কারণ, এখন দেশে উৎপাদিত মুড়িকাটা (কন্দ থেকে উৎপাদিত) পেঁয়াজ বাজারে রয়েছে। তাতে পেঁয়াজের দাম কমেছে। পবিত্র রমজান মাসে হালি (বীজ থেকে উৎপাদিত) পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলবে।
এবার খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৮৬ হাজার মেট্রিক টনের। গত বছর একই সময়ে ৪৮ হাজার টন খেজুরের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল; অর্থাৎ খেজুরের ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এবার ১ লাখ ৮৯ হাজার টন ছোলার ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। মসুর ডালের ঋণপত্র খোলার হার ২১ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য নিয়ে দেখা যায়, ছোলার আমদানি শুরু হয়েছে। এ বছরের ১-১১ জানুয়ারি সময়ে প্রায় ৪০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছে। মটর ডাল আমদানি হয়েছে ৫৬ হাজার টন। মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার টন। ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিন আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার টন। অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন; অর্থাৎ পাইপলাইনের পণ্য আসতে শুরু করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এ পরিস্থিতিতে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে কয়েকটি নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর কমানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও খেজুর। এরপর পণ্য আমদানির উদ্যোগ বাড়তে থাকে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুল্কছাড়ের কারণে চাল, ভোজ্যতেল, খেজুরসহ নিত্যপণ্যের দাম রমজানে স্থিতিশীল থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে মসুর ও ছোলার মজুত ও সরবরাহ তদারকি করা দরকার বলে মনে করে সংস্থাটি।
ঋণপত্র খোলা মানেই আমদানি নয়। ঋণপত্রের বিপরীতে পণ্য শেষ পর্যন্ত আমদানি হয় কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী বেশি আমদানি ও সরবরাহ করেন। তাঁদের কারও সরবরাহে বিঘ্ন হলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থাকে। সেদিকেও দৈনিকভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ দরকার।সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমচিনি ছাড়া ভোজ্যতেল, গম, ছোলা, মসুর ও মটর ডালের মতো পণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করে টি কে গ্রুপ। জানতে চাইলে গ্রুপটির পরিচালক শফিউল আতহার প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ছোলার দাম বাড়তি থাকলেও আমদানি পর্যাপ্ত পরিমাণে হবে। ভোজ্যতেল, মসুর, মটর ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট হবে না। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারেও কোনো পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা নেই। তিনি বলেন, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ হতে পারে ডলারের দাম। ডলারের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের আমদানি খরচ বাড়বে। তেমনি বাড়বে শুল্ক–করের পরিমাণও।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মান ধরে রাখা দরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত আগস্টে আমদানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ছিল ১২০ টাকার মতো। তবে সংকটের কারণে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২৩-১২৪ টাকায়ও ডলার কিনতে হয়েছে আমদানিকারকদের। এখন আমদানিতে আনুষ্ঠানিক দর ১২৩ টাকা। এই দামে আমদানির জন্য ডলার পাওয়া যাচ্ছে।
সার্বিকভাবে ডলার–সংকট কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী দেশে প্রায় ২ হাজার ১৬৮ কোটি ডলার, যা গত আগস্টের শুরুতে ছিল ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার। এই সময় বকেয়া বিদেশি দেনা একটি বড় অংশ (৩৫০ কোটি ডলার) পরিশোধ করা হয়েছে।
চাল আমদানির সুযোগ ও শুল্ক কমানো হলেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। চাল আমদানি ততটা বাড়ছে না। এদিকে ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি চার টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ঋণপত্র খোলা মানেই আমদানি নয়। ঋণপত্রের বিপরীতে পণ্য শেষ পর্যন্ত আমদানি হয় কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী বেশি আমদানি ও সরবরাহ করেন। তাঁদের কারও সরবরাহে বিঘ্ন হলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থাকে। সেদিকেও দৈনিকভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ দরকার।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডলারের দাম বেশি এবং বিশ্ববাজার চড়া। ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয় কিছুটা বেশি পড়বে। অন্য কোনো কারণে যাতে দাম না বাড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সব গরু বিক্রি করে দিলেন সেই ডিআইজি প্রিজন
নিজের বাংলোতে গড়ে তোলা খামারের সব গরু বিক্রি করে দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) টিপু সুলতান। গতকাল মঙ্গলবার ১২ লাখ টাকায় তিনি খামারে থাকা গরু–বাছুর বিক্রি করে দেন। ফলে সরকারি বেতনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আর ডিআইজি প্রিজনের গরুর খামারে কাজ করতে হচ্ছে না।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী আবদুর রশিদ আজ বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যারের খামারে থাকা সব গরু বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের গরুর খামারে আর কোনো কাজ নেই।’
গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘চট্টগ্রাম কারাগারে দুধ বিক্রি করছেন ডিআইজি প্রিজন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাবিধি অনুযায়ী, কোনো কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্দীদের কাছে কোনো সামগ্রী বিক্রি কিংবা ভাড়া দিতে পারেন না। তা ছাড়া এভাবে তরল দুধ সরবরাহ করা বন্দীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সাবেক কারা কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) টিপু সুলতান চট্টগ্রামে যোগ দেন গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি। ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে আসার সময় গরুগুলো সঙ্গে নিয়ে আসেন তিনি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব সীমানাদেয়াল–সংলগ্ন এলাকায় নিজের কার্যালয় ও বাংলোর পাশে খামার গড়ে তোলেন তিনি। খামারে উৎপাদিত দুধ তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে বিক্রি করে আসছিলেন।
কারাগারে বাইরে থেকে দুধসহ রান্না করা কোনো খাবার কারাবন্দীদের দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু গোপালগঞ্জের বাসিন্দা ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতান সে নিয়ম মানেননি। ১০ মাস ধরে নিয়মিত তাঁর খামার থেকে গড়ে ২০ লিটার করে দুধ কারা ক্যানটিনে সরবরাহ করা হতো। বাইরে খুচরা মূল্য ৮০ টাকা লিটার, পাইকারি দর ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ডিআইজি প্রিজন কারাগারে বিক্রি করেছেন ১০০ টাকা দরে। সেই হিসাবে দৈনিক ২ হাজার টাকা এবং প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করতেন তিনি।
প্রথম আলোয় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপর কারাগারে দুধ বিক্রি বন্ধ করে দেন ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতান। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি দেশের ৬৮ কারাগারে গরু পালনে সরকারি কর্মচারী ও অর্থ ব্যবহার না করতে নির্দেশনা জারি করেছে কারা অধিদপ্তর। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেনের পক্ষে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের সই করা এক চিঠিতে বিষয়টি জানানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, কারা কর্মকর্তারা গরু পালনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিবিধান অনুসরণ করছেন না। এখন থেকে গরু পালনের ক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তাকে কারা মহাপরিদর্শকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। পাশাপাশি মানতে হবে কিছু শর্ত। এগুলো হলো কারাগারে দুটির বেশি গরু পালন করা যাবে না, কারা এলাকায় গরু পালনের ক্ষেত্রে কারাগারের পরিবেশ কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না, গরু পালনের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করা যাবে না, ব্যয় করা যাবে না সরকারি কোনো অর্থ, ব্যক্তিগত গরু পালনের কাজে বন্দীদের ব্যবহার করা যাবে না, সরকারি কোনো স্থানে ঘাস চাষ করা যাবে না, গরু পালন কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ বিল ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করতে হবে, গরুর সংখ্যা দুইয়ের অধিক নেই এবং নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে—প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে লিখিত প্রত্যয়ন দিতে হবে।