‘জুলাই অভ্যুত্থানকে সাহিত্য–সংস্কৃতিতে একটা আন্দোলন হিসেবে হাজির করা যেতে পারে’
Published: 6th, February 2025 GMT
এত দিন যে লিখতে পারা যায়নি, এখন যে যাবে, এটাই সাহিত্যের জন্য একটা নয়া বন্দোবস্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার সমালোচনা করেও কেউ যদি সাহিত্য তৈরি করতে চান, তাঁকে সেটা করতে দেওয়া উচিত। না হলে ‘জুলাই ফ্যাসিজম’ নামে আলাদা একটা ফ্যাসিস্ট বন্দোবস্ত তৈরি হতে পারে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে সাহিত্য বা আর্ট-কালচারে একটা মুভমেন্ট (আন্দোলন) হিসেবে হাজির করা যেতে পারে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনের সিরিজ বক্তব্যের প্রথম পর্বের আলোচনায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেছেন। ‘জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ভাষা নির্মাণ’ শিরোনামে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কবি হাসান রোবায়েত বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকে ক্রিটিক (সমালোচনা) করেও যদি কেউ সাহিত্য তৈরি করেন, আমার মনে হয় তাঁকেও তাঁর মতো করে সেটা সেলিব্রেট করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর কণ্ঠরোধ করতে হবে বলে আমি মনে করি না। জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে (চেতনা) ক্রিটিক করেও কেউ সাহিত্য তৈরি করতে চাইলে তাঁকে সেটা করতে দেওয়া উচিত। না হলে তখন “জুলাই ফ্যাসিজম” নামে আলাদা একটা ফ্যাসিস্ট বন্দোবস্ত তৈরি হতে পারে। এত দিন লিখতে পারা যে যায়নি, এখন যে যাবে, এটাই আমার কাছে মনে হয় সাহিত্যের জন্য একটা নয়া বন্দোবস্ত।’
জুলাই অভ্যুত্থানকে সাহিত্য বা আর্ট-কালচারে একটা মুভমেন্ট (আন্দোলন) হিসেবে হাজির করা যেতে পারে উল্লেখ করে হাসান রোবায়েত বলেন, ‘আমাদের এখানে বাঙালির বাইরেও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছেন। তাঁদের সাহিত্য তো আমরা জানি না। তো, জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী সাহিত্য বলতে কি আমরা বাংলা সাহিত্যের কথা চিন্তা করব? অন্য ভাষার সাহিত্যগুলো কেন তাদের হিস্যা বুঝে পাচ্ছে না, বাংলা ভাষা–সাহিত্য অন্য ভাষা–সাহিত্যগুলোকে ডমিনেট করছে কি না, তাদের নিজেদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে কি না—এ বিষয়গুলোর ফয়সালা করা গেলে একটা নতুন বন্দোবস্ত হবে বলে আমার মনে হয়।’
এ সময় আমজনতার বোধগম্য ভাষায় সংবিধান বা গঠনতন্ত্র লেখার আহ্বানও জানান হাসান রোবায়েত। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর সংবিধান যদি নতুন করে লেখা হয়, তাহলে তা জটিল ভাষায় লেখা যাবে না। এটা এমন ভাষায় লিখতে হবে, যা পড়ে সংবিধানের মূল বিষয়গুলো অন্তত আমজনতা বুঝতে পারে।
‘মুখের ভাষার মর্যাদা দরকার’
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃতায়িত বাংলাকে বাংলাদেশের বাংলা ভাষার লেখ্য রূপ করে তোলা হয়েছে বলে আলোচনায় অভিযোগ করেন কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ফয়েজ আলম। তিনি বলেন, ‘ভাষার মধ্যে আমার চিন্তা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বয়ান জমাচ্ছি, তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষা আমাদের বইয়ের ভাষা নয়। আমরা কথা বলি এক ভাষায় আর পড়ি আরেক ভাষায়। তাহলে কোন ভাষায় আমরা লিখব? কথ্যরীতির একটা আদর্শ রূপ আমাদের আছে।’
দেশের মাটি ও জনসমাজ থেকে উঠে আসা সাহিত্যই নতুন প্রজন্মকে পড়াতে হবে উল্লেখ করে ফয়েজ আলম আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের কথাবার্তা ও স্লোগান আমাদের মুখের ভাষায় হয়েছে। কিন্তু প্রায় অপাঠ্য একটা ভাষাকে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন দরকার আমাদের পেছনের ভুল সংশোধন করে দেশের মানুষের ভাষা ও সাহিত্যকে সামনে নিয়ে আসা। আমাদের মুখের ভাষাটাকে মর্যাদার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।’
আমরা কী করতে চাই, এটা ঠিক হলে ভাষা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে বলে আলোচনায় মন্তব্য করেন কবি এস এম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন শান্ত সময়ের কবিতা দরকার।’ এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’ কবিতার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
আয়োজনে আরও বক্তব্য দেন কবি বায়েজিদ বোস্তামী।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।