লেখা শেষে গাছ হবে, এমন কলম বানাল বরগুনার আমিরুল
Published: 20th, February 2025 GMT
কলমের কালি ফুরিয়ে গেলে সেটির জায়গা হয় ময়লার ঝুড়িতে। এরপর তা মাটি-পানিতে মিশে সৃষ্টি করে দূষণ। কিন্তু এমন কলম যদি বানানো যায়, যা থেকে গাছের জন্ম হবে, কেমন হবে সেটা? এমনই পরিবেশবান্ধব এক উদ্যোগ নিয়েছে বরগুনার আমতলী উপজেলার আমিরুল ইসলাম নামের এক স্কুলশিক্ষার্থী।
১৬ বছর বয়সী আমিরুল তৈরি করেছে পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম, যা ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দিলে কিংবা পুঁতে দিলে জন্মাবে ফলদ গাছের চারা। রঙিন কাগজে মোড়ানো কলমের দাম ১০ টাকা, সাদা কাগজে মোড়ানোটির দাম ৫ টাকা। তার এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে।
আমতলী এমইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন সে প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখনই মাথায় আসে একটি ভিন্নধর্মী কলম তৈরির ভাবনা। দুই মাসের চেষ্টার পর, গত বছরের নভেম্বরে সে একধরনের বিশেষ কলম তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর কাঠামো তৈরি হয় শক্ত কাগজ দিয়ে আর ভেতরে সংযোজন করা হয় বিভিন্ন ফলদ গাছের বীজ। কলমের কালি শেষ হলে সেটি মাটিতে ফেলে দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই এই কলম থেকে গাছের চারা জন্ম নেবে।
পদ্ধতিটি সহজ, তবে বুদ্ধিদীপ্ত। আমিরুল জানাল কীভাবে এই কলম তৈরি করেছে সে। প্রথমে বিভিন্ন রঙের কাগজের ভেতর কালির শিষ স্থাপন করা হয়। এরপর বিশেষ আঠা দিয়ে মুড়িয়ে কলমের কাঠামো শক্ত করা হয়। মূল চমক লুকিয়ে আছে কাগজের ভেতরে, যেখানে রাখা হয় ফলদ গাছের একটি বীজ। কলম ব্যবহারের পর মাটিতে ফেললেই তা থেকে চারা গজাবে এবং একসময় বড় গাছ হবে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের ‘টুয়ার্ডস আ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে ঢাকার বাইরে অন্যান্য নগরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে তা হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে ৯ কেজি থেকে বেড়ে প্রায় ২৩ কেজি হয়েছে। দেশে সারা বছরে যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মেশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া।
শিক্ষার্থী আমিরুলের পরিবেশবান্ধব কলম উদ্ভাবনের চিন্তা আসে দূষণের এমন ভয়াবহতা থেকেই। আমিরুল বলে, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে বিদ্যালয়ে ক্লাসে স্যারদের কাছে শুনেছি। আমাদের পাঠ্যবইয়েও এ নিয়ে একটা অধ্যায় ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দূষণের ব্যাপারে আমার উদ্বেগ বাড়ে। নিজের মধ্যে এই দূষণ রোধে কিছু করার তাগিদবোধ করতে থাকি। কিন্তু কী করব, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে মাথায় আসে আমরা যদি শুধু প্লাস্টিক বলপেনটাকে পরিবেশবান্ধব করতে পারি, তাহলে এই দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারি। কিন্তু এটাকে জনপ্রিয় করতে হলে এর সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করতে হবে, নাহলে খুব সহজে এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। সেই চিন্তা থেকে এর মধ্যে গাছের বীজ সংযোজনের উদ্যোগ নিই।’
আমিরুল ইসলাম বলে, ‘মানুষ গাছ লাগাতে চায় না, কিন্তু কলম তো ফেলবেই। তাই এমন কলম তৈরি করেছি, যা ফেলার পর নিজেই গাছ হয়ে উঠবে। এতে শুধু পরিবেশ রক্ষাই হবে না, ভবিষ্যতে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি হবে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই কলম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’ ইতিমধ্যে সে দুই হাজার কলম তৈরি করে বিক্রি করেছে। দিন দিন তার তৈরি কলমের চাহিদা বাড়ছে বলে তার ভাষ্য।
আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এ হান্নান বলেন, আমিরুলের উদ্যোগটি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির এক চমৎকার উপায়। এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী এই কলম ব্যবহার শুরু করেছে। আমতলীতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকে এই কলম ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে একটা বড় সবুজ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, এমন সৃজনশীল উদ্যোগ অবশ্যই উৎসাহিত করা উচিত। আমিরুলের প্রকল্পকে বড় পরিসরে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কলম ত র পর ব শ আম র ল কলম র কলম ব
এছাড়াও পড়ুন:
কোরবানির গরু কেনার আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতে ব্যবসায়ী জাকিরকে হত্যা করা হয়
রাজধানীর সবুজবাগের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের সঙ্গে থাকা আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতেই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তাঁকে ছয় টুকরা করে লাশ বস্তায় ঢুকিয়ে কাছের একটি ঝোপের ভেতরে পুঁতে রাখা হয়। এর আগে আজহারুল ইসলাম (গ্রেপ্তার) মুঠোফোনে সবুজবাগের ভাইগদিয়ায় তাঁর ভাড়া বাসায় জাকিরকে (৫৫) ডেকে নেন।
গ্রেপ্তার আজহারুল ইসলাম (৩৯) আজ শুক্রবার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আদালত তাঁর জবানবন্দি নিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার শুক্কুর আলী (৪৪), মো. রাজীব (২৬) ও স্বপনকে (২৫) পাঁচ দিন করে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তার শুক্কুর আলী পেশায় রাজমিস্ত্রি এবং বাকিরা রংমিস্ত্রি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সবুজবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সামছুল আমিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আজহারুল, শুক্কুর আলী, রাজীব ও স্বপন জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় দুপুরে তাঁদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠানো হয়। এর মধ্যে আজহারুল আদালত জবানবন্দি দেন। অপর তিনজন জবানবন্দি দিতে রাজি হননি। পরে তাঁদের সাত দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তাঁদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজহারুল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, জাকির হোসেনের সঙ্গে তাঁদের চারজনের (আজহারুল, শুক্কুর আলী, রাজীব ও স্বপন) বন্ধুত্ব ছিল। তাঁরা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। মাঝেমধ্যে জাকিরের সঙ্গে তাঁর ভাইগদিয়ার ভাড়া বাসায় তাঁরা একসঙ্গে মদ্যপান করতেন। ৪ জুন রাতে জাকির নন্দীপাড়ায় শেখের বাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তখন আজহারুল মুঠোফোনে জাকিরকে তাঁর বাসায় ডেকে নেন। ওই বাসায় আজহার একা থাকতেন। আগেই জাকির তাঁদের জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে কোরবানির গরু কেনার আড়াই লাখ টাকা আছে এবং ডেমরার আমুলিয়া পশুরহাট থেকে কোরবানির জন্য গরু কিনবেন। জাকির তাঁর বাসায় পৌঁছানোর পর ওই টাকার ওপর তাঁদের সবার লোভ জাগে। তাঁরা টাকা ছিনিয়ে নিতে গেলে জাকির বাধা দেন। তখন ইস্পাতের পাইপ দিয়ে জাকিরের মাথায় সজোরে আঘাত করেন আজহারুল। এতে জাকির অচেতন হয়ে যান। এ সময় তাঁর কাছ থেকে এক হাজার টাকার দুটি বান্ডিল ছিনিয়ে নিয়ে সেই টাকা শুক্কুর আলীর কাছে জমা রাখেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, আজহারুল আদালতকে জানান, জাকিরকে বাঁচিয়ে রাখা হলে তাঁরা সবাই ফেঁসে যাবেন—এমন আশঙ্কায় জাকিরকে হত্যা করে লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জাকিরের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এরপর শুক্কুর, রাজীব ও স্বপন তাঁর শরীর টুকরা টুকরা করেন। পরে লাশের ছয়টি টুকরা রঙের দুটি পাত্রে ভরে একটি অটোরিকশায় করে দক্ষিণ ভাইগদিয়ায় নিয়ে যান। শুক্কুর, রাজীব ও স্বপন অন্য পথ দিয়ে দক্ষিণ ভাইগদিয়ায় আসেন। তখন তাঁরা সবাই মিলে বালতিভর্তি লাশের টুকরাগুলো পাশের ঝোপে নিয়ে যান। এরপর সেখানে খুঁড়ে লাশের টুকরাগুলো পুঁতে রাখেন।
আজহারুল আদালতকে বলেন, জাকিরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া টাকা ভাগাভাগি করার আগেই তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
পুলিশ কর্মকর্তা সামছুল আমিন বলেন, আজহারুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাহেরচরে। বাকি তিনজন ঢাকার সবুজবাগের ভাইগদিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা।
প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাকির হোসেন সপরিবার সবুজবাগ থানার ভাইগদিয়া এলাকায় থাকতেন। ৪ জুন জাকির হোসেন নিখোঁজ হন। এরপর স্বজনেরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান পাননি। পরদিন জাকির নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাঁর স্ত্রী রেখা বেগম সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর মধ্যে জাকিরের খোঁজ না পাওয়ায় তিনি ১০ জুন আজহার আলীসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সবুজবাগ থানায় একটি অপহরণের মামলা করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা সামছুল আমিন বলেন, এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এলাকার ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আজহারুলকে শনাক্ত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আজহারের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যায় জড়িত অভিযোগে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অপর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাতে জাকির হোসেনকে ভাইগদিয়ায় দাফন করা হয়।
সবুজবাগ থানার ওসি ইয়াছিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে জাকিরকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করলেও তদন্তে এখন পর্যন্ত এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। জাকির হত্যায় আরও একজন জড়িত। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।