কলমের কালি ফুরিয়ে গেলে সেটির জায়গা হয় ময়লার ঝুড়িতে। এরপর তা মাটি-পানিতে মিশে সৃষ্টি করে দূষণ। কিন্তু এমন কলম যদি বানানো যায়, যা থেকে গাছের জন্ম হবে, কেমন হবে সেটা? এমনই পরিবেশবান্ধব এক উদ্যোগ নিয়েছে বরগুনার আমতলী উপজেলার আমিরুল ইসলাম নামের এক স্কুলশিক্ষার্থী।

১৬ বছর বয়সী আমিরুল তৈরি করেছে পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম, যা ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দিলে কিংবা পুঁতে দিলে জন্মাবে ফলদ গাছের চারা। রঙিন কাগজে মোড়ানো কলমের দাম ১০ টাকা, সাদা কাগজে মোড়ানোটির দাম ৫ টাকা। তার এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে।

আমতলী এমইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন সে প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখনই মাথায় আসে একটি ভিন্নধর্মী কলম তৈরির ভাবনা। দুই মাসের চেষ্টার পর, গত বছরের নভেম্বরে সে একধরনের বিশেষ কলম তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর কাঠামো তৈরি হয় শক্ত কাগজ দিয়ে আর ভেতরে সংযোজন করা হয় বিভিন্ন ফলদ গাছের বীজ। কলমের কালি শেষ হলে সেটি মাটিতে ফেলে দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই এই কলম থেকে গাছের চারা জন্ম নেবে।

পদ্ধতিটি সহজ, তবে বুদ্ধিদীপ্ত। আমিরুল জানাল কীভাবে এই কলম তৈরি করেছে সে। প্রথমে বিভিন্ন রঙের কাগজের ভেতর কালির শিষ স্থাপন করা হয়। এরপর বিশেষ আঠা দিয়ে মুড়িয়ে কলমের কাঠামো শক্ত করা হয়। মূল চমক লুকিয়ে আছে কাগজের ভেতরে, যেখানে রাখা হয় ফলদ গাছের একটি বীজ। কলম ব্যবহারের পর মাটিতে ফেললেই তা থেকে চারা গজাবে এবং একসময় বড় গাছ হবে।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের ‘টুয়ার্ডস আ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে ঢাকার বাইরে অন্যান্য নগরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে তা হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে ৯ কেজি থেকে বেড়ে প্রায় ২৩ কেজি হয়েছে। দেশে সারা বছরে যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মেশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া।

শিক্ষার্থী আমিরুলের পরিবেশবান্ধব কলম উদ্ভাবনের চিন্তা আসে দূষণের এমন ভয়াবহতা থেকেই। আমিরুল বলে, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে বিদ্যালয়ে ক্লাসে স্যারদের কাছে শুনেছি। আমাদের পাঠ্যবইয়েও এ নিয়ে একটা অধ্যায় ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দূষণের ব্যাপারে আমার উদ্বেগ বাড়ে। নিজের মধ্যে এই দূষণ রোধে কিছু করার তাগিদবোধ করতে থাকি। কিন্তু কী করব, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে মাথায় আসে আমরা যদি শুধু প্লাস্টিক বলপেনটাকে পরিবেশবান্ধব করতে পারি, তাহলে এই দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারি। কিন্তু এটাকে জনপ্রিয় করতে হলে এর সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করতে হবে, নাহলে খুব সহজে এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। সেই চিন্তা থেকে এর মধ্যে গাছের বীজ সংযোজনের উদ্যোগ নিই।’

আমিরুল ইসলাম বলে, ‘মানুষ গাছ লাগাতে চায় না, কিন্তু কলম তো ফেলবেই। তাই এমন কলম তৈরি করেছি, যা ফেলার পর নিজেই গাছ হয়ে উঠবে। এতে শুধু পরিবেশ রক্ষাই হবে না, ভবিষ্যতে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি হবে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই কলম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’ ইতিমধ্যে সে দুই হাজার কলম তৈরি করে বিক্রি করেছে। দিন দিন তার তৈরি কলমের চাহিদা বাড়ছে বলে তার ভাষ্য।

আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এ হান্নান বলেন, আমিরুলের উদ্যোগটি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির এক চমৎকার উপায়। এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী এই কলম ব্যবহার শুরু করেছে। আমতলীতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকে এই কলম ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে একটা বড় সবুজ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, এমন সৃজনশীল উদ্যোগ অবশ্যই উৎসাহিত করা উচিত। আমিরুলের প্রকল্পকে বড় পরিসরে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কলম ত র পর ব শ আম র ল কলম র কলম ব

এছাড়াও পড়ুন:

বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল

বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।

যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।

শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।

এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।

পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।

শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।

বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।

গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলাম

স্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।

আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার 
  • আমার স্বামীর উপরে কু-নজর পড়েছে: অঙ্কিতা
  • সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন ট্রাম্প
  • ‘আমি থানার ওসি, আপনার মোবাইল হ্যাকড হয়েছে’
  • অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকের প্রশ্নে কেন চটে গেলেন ট্রাম্প, আলবানিজের কাছে নালিশেরও হুমকি দিলেন
  • কালিয়াকৈরে এক মাসে ২০ ডাকাত গ্রেপ্তার 
  • বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
  • আসামিকে আপ্যায়নের ঘটনায় আদালত পরিদর্শকসহ ৬ পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
  • ট্রেন থেকে পড়ে ৮ দিন ধরে হাসপাতালে ছেলে, ফেসবুকে ছবি দেখে ছুটে এলেন মা
  • ভাড়া বাসায় একা থাকতেন বৃদ্ধা, তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার